১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা

-

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হলো প্রতিরক্ষা সম্পর্ক। বাংলাদেশ একসময় ভারতের সবচেয়ে বড় পণ্য আমদানিকারক দেশ ছিল। কিন্তু কোনো সময় ভারতের প্রতিরক্ষাসামগ্রী আমদানিকারক দেশের তালিকায় দেশটি ছিল না। এর পেছনে একটি কারণ ছিল- ভারত অন্য দেশের প্রতিরক্ষা প্রয়োজন মেটানোর জন্য অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত করার চেয়েও নিজ প্রতিরক্ষা প্রয়োজনের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিত। কিন্তু তার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী ও আঞ্চলিকভাবে প্রধান প্রতিযোগী হওয়া চীনের প্রভাবের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক এক দিকে অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক হয়, অন্য দিকে প্রতিপক্ষ দেশটির দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা নির্ভরতা তৈরি করে, যার বিশেষ প্রভাব থাকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রতিরক্ষাসামগ্রী রফতানির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে অগ্রাধিকারের দুই দেশ হলো বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। দেশ দু’টি আবার চীনা প্রতিরক্ষাসামগ্রী আমদানির সবচেয়ে বড় দুই দেশ।

বাংলাদেশ এখন নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তন বা ধারাবাহিকতার মুখোমুখি। এই নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে আগাম অনুমান করা কঠিন। বাংলাদেশে অবাধ ও জনমতের প্রতিফলন ঘটার মতো নির্বাচনের নিশ্চিত ধারা এখন নেই বলে সরকারে আগামীতে কারা আসবে, কিভাবে আসবে, তা নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা মুশকিল। তবে এ ব্যাপারে প্রতিবেশী ভারতের একটি প্রধান ভূমিকা থাকবে বলে মনে করা হয়। আর ভারতের অনাগত স্বার্থের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্কের বিষয়টি।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের এই সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়ানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রয়েছে। ভারত এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হওয়ার পেছনে যে ক’টি কারণ রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে প্রথমত, সামরিক ক্ষেত্রে আরো বাড়তি যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপারে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, ভারত চাইছে তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বেশি পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র কিনুক। বর্তমানে বাংলাদেশ বেশির ভাগ অস্ত্র চীন থেকে কেনে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যৌথ বা সম্মিলিত অভিযান চালানোর মতো একটি সুযোগ চুক্তির মাধ্যমে ভারত রাখতে চায়।

ভারত কেন দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী এই প্রসঙ্গে বিশ্লেষক সুবীর ভৌমিক উল্লেখ করেছেন, ‘ভারতের একটি মূল্যায়ন হচ্ছে- অন্যসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তা সেভাবে এগোয়নি। এখানে ভারতের যে সমস্যা রয়েছে, তার একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার সমস্যা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে চীন। এটা মাথায় রেখেই এ ধরনের একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি ভারত করতে চাইছে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য।’

সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা থাকায় সার্বিক বিচারে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো চুক্তি বা সমঝোতা বাংলাদেশের জন্য খুবই স্পর্শকাতর। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জামিল ডি. আহসানের মতে, ‘প্রতিটি দেশেরই সামরিক নীতি থাকে, এগুলো নিজস্ব এবং গোপনীয় বিষয়। তাই প্রতিরক্ষা বিষয়টি বা প্রতিরক্ষা চুক্তি যেমন স্পর্শকাতর, তেমনি ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটাও কিন্তু স্পর্শকাতর।’

বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির কৌশলগত প্রভাব নিয়ে নানা শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় ঋণ বাস্তবায়ন এবং সার্বিক সহযোগিতার বিস্তার ঘটাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দিল্লিতে মোট চারটি চুক্তি সই হয়েছে। স্বাক্ষরিত প্রথম চুক্তিটি হলো, বাংলাদেশ-ভারত কাঠামোগত সহযোগিতা চুক্তি। যাকে বলা হচ্ছে, ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে, প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনার জন্য ভারত বাংলাদেশকে যে ৫০ কোটি ডলার ঋণের ঘোষণা দিয়েছে তা দিয়ে বাংলাদেশের যা প্রয়োজন এবং ভারতের যা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সেই ভিত্তিতেই প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনা হবে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভারতের কাছে চাহিদা অনুসারে দাবিপত্র পেশ করবে। ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের পুরোটাই ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে খরচ করতে হবে না। এর ৩৫ শতাংশের মতো তৃতীয় দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনে বাংলাদেশ খরচ করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারতের অনুমতি নিতে হবে। দ্বিতীয় চুক্তিটি হলো, খুলনায় নৌবাহিনীর শিপইয়ার্ডের সাথে ভারতের জাহাজ মন্ত্রণালয়ের। এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের প্রয়োজন অনুযায়ী নৌ জাহাজ বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে তৈরি করবে। তৃতীয় চুক্তিটি হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিরক্ষা কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থী বিনিময়। এতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সমঝোতার বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য সবসময় স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত বছর এপ্রিলে ভারত সফরের আগে থেকেই প্রতিরক্ষা সমঝোতা নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে কি না, সেই সংশয় বিভিন্ন মহল প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেসব আশঙ্কা উপেক্ষা করে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের জন্য ভারত দীর্ঘমেয়াদি একটি রূপরেখা চুক্তি সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল ঢাকার কাছে। মনোহর পারিকর ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বিভিন্ন স্তরে আলোচনার পর বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পরিবর্তে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখায় দুই দেশের এখনকার সহায়তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে নতুন কিছু ক্ষেত্রের কথাও বলা হয়। এর প্রস্তাব অনুসারে, প্রতিরক্ষা খাতের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে দুই পক্ষ প্রশিক্ষণ, সামরিক বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষক ও পর্যবেক্ষক, সামরিক শিক্ষা পাঠ্যক্রম ও তথ্যবিনিময় করবে। সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সহযোগিতাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে দুই পক্ষ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কর্মকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে উভয়পক্ষ সমুদ্রগামী জাহাজ ও উড়োজাহাজের সফর বিনিময়ের আয়োজন করবে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় উভয়পক্ষ সমন্বিত টহল কিংবা যৌথ মহড়া পরিচালনা করবে। প্রতিরক্ষা শিল্পের সহযোগিতার ক্ষেত্রে যৌথ বিনিয়োগ, মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, কারিগরি সমর্থন, অভিজ্ঞতা বিনিময়, প্রশিক্ষণ এবং সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়গুলো যুক্ত আছে।

স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কাজটি কেমন হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য প্রতিরক্ষা সচিব এবং সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পর্যায়ে বার্ষিক সংলাপ হবে। এই আলোচনা প্রতি বছর পালা করে হবে বাংলাদেশ ও ভারতে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় যেসব গোপন তথ্যবিনিময় হবে, সেগুলো যাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়, তা দু’পক্ষ নিশ্চিত করবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রক্রিয়ার সময় দুই পক্ষ গোপনীয়তা মেনে চলবে। দুই দেশের সামরিক অংশীদারিত্ব নিয়ে ভারতের সরকার ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট থিংকট্যাংকগুলো অনেক দিন ধরে কাজ করছে। এ ব্যাপারে ভারতের অবজারভার ফাউন্ডেশন যে সুপারিশ করেছিল তাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে চুক্তির খসড়ায় বিষয়গুলো বিন্যাস করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে অবজারভার ফাউন্ডেশনের এক নিবন্ধে বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব স্থির কিন্তু দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে স্থলসীমানা বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের একটি ইঙ্গিত। এই ধারা ধরে রাখতে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ ও সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো দরকার। কারণ, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণে সশস্ত্রবাহিনী সবসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে সূচিত বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা বেশ জরুরি। যদিও এই সম্পৃক্ততা ১৯৭১-এর পরে মাত্র কয়েক বছর টিকে ছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর, ১৯৭৫ সালে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করলে এই সম্পর্ক পরিবর্তন হয়ে যায়। এমনকি দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে ভারতের সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব কিনা এ বিষয়ে সংশয় ছিল।

নিবন্ধটিতে বলা হয়, ‘শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ উদ্যোগে এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রূপান্তর করার চেষ্টা চালায়। ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কে উন্নয়ন শুরু হয়। তখনকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদ সম্পর্ক উন্নত করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ২০০৭ সালে তিনি ভারত সফরও করেন। ভারত তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা জানায়, যা সাধারণত সরকারপ্রধানদের দেয়া হয়। তখন থেকেই সরকারের পাশাপাশি উভয় সেনাবাহিনীর সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।

দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে নিয়মিত সফর বিনিময় শুরু হয়। ভারত ও বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। দুই সেনাদলের সহযোগিতা বাড়াতে সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনাও বাড়ে। এই পদক্ষেপগুলোতে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা সৃষ্টি হয় ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসতে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধমহড়ায় ভারতকে আর শত্রু হিসেবে চিত্রিত করা হয় না। এটি পরিবর্তনের বড় ইঙ্গিত।’

অবজারভার ফাউন্ডেশন উল্লেখ করে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপ। এ ধরনের একটি পদক্ষেপ সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের এই আচরণ ভারতের আস্থা অর্জন করতে সাহায্য করেছিল।

চীনের সাথে সম্পর্কের ওপর নিবন্ধটিতে বেশি জোর দেয়া হয়। এতে বলা হয়, চীনের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সংযোগগুলোও উপেক্ষা করা যায় না। চীন শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারীই নয় বরং তাদের অফিসারদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের একটি প্রধান গন্তব্য। দেশটি চীনা অস্ত্রের অন্যতম বড় ক্রেতা। বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সবক্ষেত্রেই চীনা অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। দুই দেশের মধ্যে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল ধরনের চুক্তি। বর্তমানে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন ও উন্নত অস্ত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে। এর বিশাল অংশ চীন থেকে আসছে, যার মধ্যে আছে চীনের তৈরি সাবমেরিনও।

ভারতের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহের ব্যাপারে পরামর্শ করার বাধ্যবাধকতা বা এ ধরনের এমন একটি বিধান রাখার কথা বলা হয় যাতে চীনের অস্ত্র নির্ভরতা কমিয়ে সেখানে ভারতের তৈরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম পর্যায়ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ভারতের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমদানির পরিবর্তে বিদেশী অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন শুরু করার পর এগুলো বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রফতানির পরিকল্পনা করে। মূল্যের দিক থেকে তা চীনের সাথে প্রতিযোগিতামূলক হবে বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে ভারতের বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো সহযোগী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলছে। এ ব্যাপারে রুশ গণমাধ্যম স্পুটনিক একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিরক্ষা খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তা আদানি ও টাটাসহ অন্য শিল্পগ্রুপগুলোর সাথে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তি পর্যায়ে সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে এ লবির জোরালো চাপ রয়েছে বলে জানা গেছে। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোর প্রতিরক্ষা সরবরাহে ভারত স্থান করে নিতে পারলে এসব দেশকে কৌশলগত প্রভাব বলয়ে রাখতে এটি বিশেষ সহায়ক হবে। এজন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে।

গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে ভারতের প্রস্তাবিত চুক্তিতে (এর একটি অংশ বিশেষ স্বাক্ষরিত হয়েছে) ‘সামরিক বাহিনীর সাথে সামরিক বাহিনীর’ বৃহত্তর সহযোগিতা, ভারত থেকে বাংলাদেশে সামরিক সমরাস্ত্র বিক্রয় ও সরবরাহ এবং পারস্পরিক অনুভূত হুমকির বিরুদ্ধে সমন্বিত অপারেশন চালানোর ব্যবস্থা থাকবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব:) আ ন ম মুনীরুজ্জামান এক সেমিনারে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক যা-ই করি না কেন, এর বাস্তবায়ন হবে একই ধারায়। কেন সামরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হলো আর কেনইবা ভারত জোরালোভাবে প্রস্তাবটি দিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত ভারতের গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, যৌথ উৎপাদনে তারা যেতে চাইছে। যার অর্থ হবে, আমাদের কেনাকাটার ওপর কিছু বাধ্যবাধকতা চলে আসা। মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সবসময় সীমাবদ্ধতা থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে আমাদের সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সম্ভবত বাংলাদেশে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির আরো কিছু বিষয় স্বাক্ষরের প্রশ্ন আসতে পারে। এটি হতে পারে বাংলাদেশের সাথে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যতম প্রধান তাৎপর্যপূর্ণ দিক। যেটি অন্য দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককেও কম-বেশি প্রভাবিত করতে পারে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement