১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চক চক করিলেই সোনা হয় না

-

অবশেষে ২৭ লাখ এজাহারভুক্ত নেতাকর্মীর মাথায় ৯৫ হাজার মামলা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শত প্রতিকূলতার মধ্যেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সিলভার লাইন দেখা যাচ্ছে। বিএনপির ভাষ্য মতে, ‘২০০৯ সাল থেকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট মিথ্যা মামলার সংখ্যা ৯০ হাজার ৩৪০টি, আসামির সংখ্যা ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জন, জেলহাজতে থাকা আসামির সংখ্যা ৭৫ হাজার ৯২৫ জন, মোট হত্যার সংখ্যা এক হাজার ৫১২ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিএনপি নেতাকর্মীর নিহতের সংখ্যা ৭৮২ জন, বিভিন্ন দলের মোট গুমের সংখ্যা এক হাজার ২০৪ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত থেকে গ্রেফতার দেখানো হয় ৭৮১ জন এবং বিএনপির গুম ছিল ৪২৩ জন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীরা গুম রয়েছেন ৭২ জন এবং গুরুতর জখম ও আহত হয়েছেন ১০ হাজার ১২৬ জন।’

শেখ হাসিনা সরকারের কয়েকজন এমপি/মন্ত্রী রয়েছেন যারা ইতোমধ্যে বিএনপি বিশেষজ্ঞ (!) বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। যেমন- বিএনপিকে স্বাধীনতাবিরোধী, জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক প্রভৃতি আখ্যা ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত ছাড়াও বিএনপির দোষক্রটি খুঁটিনাটি প্রকাশ করাই ছিল তাদের কাজ। সরকার জাতিকে সুকৌশলে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে, স্বাধীনতার চেতনা ও বিরোধীপন্থী। এমতাবস্থায়, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই চেতনার চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে বিভিন্ন পন্থায়। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ডে বিএনপিকে জড়িয়ে অনেক কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে। কিন্তু কিবরিয়াপুত্র ড. রেজা কিবরিয়া বিএনপির ‘ধানের শীষে’ নির্বাচন করার জন্য আগ্রহী হয়েছেন। পিতার হত্যার বিচার নিয়ে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘বিএনপি বিচার করেনি, তারপরও দুই বছর ক্ষমতায় ছিল বিশেষ সরকার তারাও বিচার করতে পারল না। এরপর আওয়ামী লীগ টানা সাড়ে ৯ বছর ধরে ক্ষমতায়, তারা কেন বিচার করল না?’

ক্ষমতাসীনদের ‘স্বাধীনতার চেতনা’ বর্তমানে একটি ট্রেড মার্ক যার ‘গুড উইল’ বিক্রি করা সহজতর হয়েছে। জামায়াত-শিবিরবিরোধী স্লোগানের সরকার আকাশ বাতাস মুখরিত করছে, তাদের জেলে পুড়ছে, নির্বাচন করার নিবন্ধন দিচ্ছে না কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে না। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে অনেক নাটকীয়তার আবির্ভাব ঘটে। তবে আলোচনা-পর্যালোচনায় জনগণ জাতীয় নীতিনির্ধারণের কিছু স্লোগানের সাথে পরিচিতি লাভ করে, যা পণ্যসামগ্রী বিক্রির মতো জনগণকে আকৃষ্ট করার নিত্যনতুন ব্যতিক্রমধর্মী স্লোগান মাত্র। রাজনীতিও একটি পণ্যসামগ্রীর মতো, যখন যেভাবে জনগণের কাছে বাজারজাত করা যায়। রাজনীতি এখন আর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে নেই। স্লোগান দেয়া, পুলিশের পিটুনি খাওয়া, জেলখাটা, রাজপথে গুলি খাওয়াই রাজনীতিবিদকে পাওনা। আর যখন নির্বাচন আসে তখন দলীয় মার্কাপ্রাপ্তি যুদ্ধে নেমে যায় দল ছুট ছাড়াও টাকাওয়ালা, ব্যাংক লুটেরা, ভূমিদস্যু, ব্রুকেট, পুলিশ/সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা, যারা কোনো না কোনোভাবে জনগণকে শোষণ করে আসছে।

অন্য দিকে ত্যাগ তিতিক্ষা বা নির্মল মন নিয়ে দেশ সেবার ব্রত নিয়ে যারা নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে আসছে, তারা নিজেকে জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য ‘নির্বাচন’ নামক একটি মহড়ার সময় যখনই আসে তখনই আর্বিভাব হয় লুটেরাদের, যারা দু’হাতে উজাড় করে দেয় অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ। সব রাজনৈতিক দলেই থাকে তাদের আনাগোনা, তারা ব্যবসা করে সরকারি দলের পার্টনারশিপে এবং তল খাতির করে বিরোধীদের সাথে, অর্থাৎ এক জাগায় বসতে পারলেই হলো। গত ১৯ নভেম্বর দশজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বিরোধী দলে অবস্থান নিয়েছেন। এতদিন সরকারি জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ওই সাবেক সেনারা কোনো কথা বলেননি। এখন নির্বাচন সামনে রেখে এসেছেন রাজনীতিতে ভাগ বসাতে। দুঃখজনক এই যে, নীতিবান(!) রাজনৈতিক দলগুলোও এদের লুফে নেয়। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথা যারা বেশি বলেন, তারাই নির্বাচনপূর্ব সময়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। ভবিষ্যৎ লেখায় এ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করা হবে, তবে এখন নয়, ৩০ ডিসেম্বরের পর, যার জন্য জাতি এখন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ও বিপক্ষে কথা বলে ক্ষমতাসীনরা জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ভাগটা এমনই যে, যারা সরকারের পক্ষে তারাই মুক্তিযুদ্ধের বা চেতনার পক্ষের শক্তি, বাকি বিরোধীরা সবাই (সরকারিদের মতে) জামায়াত-শিবিরের ছত্রছায়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনারবিরোধী। সরকার বিএনপিসহ রাজনৈতিকভাবে যাকেই জবাই করুক না কেন, তা স্বাধীনতাবিরোধী বলে চালিয়ে দেয়, যার ফলে সরকারবিরোধী সংখ্যা দিনে দিনে এখন ক্রমেই বাড়ছে।

‘ছদ্মাবরণ’ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আওয়ামী লীগের কাছের লোকেরাই এখন ধানের শীষের মার্কার জন্য লাইন ধরছে, যা বিএনপির মার্কা হিসেবে পরিচিত। ফলে স্বাধীনতারবিরোধী শক্তি হিসেবে বিএনপিকে চিহ্নিত করার জন্য সরকার যতই চেষ্টা করেছে, তা ফলদায়ক হয়নি এ কারণে যে, সরকার অসত্য ঘটনা সাজিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য লড়ছে, যা জাতির স্বার্থে নহে।

বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট শিশুকিশোরদের ‘কানা মাছি ভোঁ ভোঁ’ খেলাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। পিতা একদল, পুত্র অন্য দল থেকে নমিনেশন প্রার্থী, পরিবারের একাধিক সদস্য একই দল থেকে প্রার্থী, দল করেনি এমন লোকও প্রার্থী, দল ছেড়ে চলে গিয়েছিল বা অন্য দলে যোগ দিয়েছিল তারাও সে দলের প্রার্থী, দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বা দলের দুঃসময়ে দল থেকে চলে গিয়েছিল তারাও প্রার্থী, যারা এক দিনের জন্য দর্লীয় কর্মকাণ্ডে রাজপথে ঝুঁকি নেয়নি, তারাও জোরদার প্রার্থী এবং এসব সাধু বেশি প্রার্থীদের তদবিরে ঘর্মাক্ত বিএনপি মাঠকর্মীদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সবাই বলেন যে, রাজনীতি বা রাজনীতির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা রাজনীতিবিদ তৈরির সূতিকাগার রাজনৈতিক দল। নমিনেশন বণ্টনে যদি সুর্নিদিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকে তবে দলটির সাংগঠনিক শ্রীবৃদ্ধি হবে কিভাবে? এবং রাজনীতিবিদই তৈরি হবে কোথা থেকে? মানুষের যখন চক্ষু লজ্জা থাকে না, তখন সে নগ্ন হতে দ্বিধাবোধ করে না। এখন স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাজনীতির মাঠ এখন চক্ষু লজ্জাহীনদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারেনি। ফলে রাজনীতির গুণগত মান সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ কোথায়? রাজনীতির গুণগত মান বাড়াতে হলে রাজনৈতিক দলকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে নয় প্রতিষ্ঠানিকভিত্তিতে দাঁড় করাতে হবে। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নেয়া দরকার।

রাজনৈতিক দল একটি কর্মী ব্রিগেডভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয় যেখানে প্রমোশন ও ডিমোশন হওয়ার স্কোপ অর্থাৎ পুরস্কার তিরস্কারের পদ্ধতি রাজনৈতিক দল চালু করা বাঞ্ছনীয়। সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীরা নির্বাচনিক মাঠ দখল করে বিধায় দল যখন খাদে পড়ে যায়, তখন সে সুবিধাবাদী চক্রকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যার মূল্য দিতে হয় দলীয় প্রধান ও দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। সুবিধাবাদী নেতাদের দল ত্যাগের সুযোগ থাকলেও দলই তৃণমূল মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের শেষ অবস্থান, নতুবা থাকতে হয় কারাগারে। দেশী-বিদেশী কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে বিএনপির নেতৃত্ব যদি বিএনপির হাতে না থাকে, তবে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের পস্তাতে হবে অনেক বেশি। নিজস্ব আঙ্গিকে দলকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সচেষ্ট হতে হবে অনেক দৃঢ়তার সাথে। রাজনীতির গুণগত মান উন্নতির জন্য একে গরুর হাটের সাথে তুলনা করলে চলবে না। যেমন কোরবানির গরু এক হাটে বিক্রি না হলেও অন্য হাটে বিক্রি হওয়ার নজির চালু রয়েছে। গুণগত মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে দলের মূল নেতৃত্ব থেকে আসতে হবে।

গবেষণা সেল থাকতে হবে, বিরোধী দলে থাকতে হবে ছায়া মন্ত্রিসভা, এমনকি স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ছায়া প্রশাসন থাকলে জনগণ উপকৃত হতো। শুধু পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে জনগণের চিড়া ভেজে না। বিশ্লেষণধর্মী তথ্যমূলক বক্তব্য জনতা শুনতে চায়। মাঠপর্যায় থেকে মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব দায়িত্বপূর্ণ নেতৃত্বকে নিতে হবে। জনগণের অসহায়ত্ব অনেক বেশি। কারণ জনগণ দেশ পরিচালনার পার্টনারশিপ থেকে বঞ্চিত। ফলে দেশের মালিক জনগণ দেশ পরিচালনায় অবদান রাখায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এ উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে পারলে রাজনীতিতে গুণগত মান উন্নয়ন হবে। 
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (আপিল বিভাগ)
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement