১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘ব্যবহারের’ রাজনীতি

বায়তুল মোকাররম মসজিদ - ছবি : সংগৃহীত

মুসলিম বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ওলামায়ে কেরামদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ইসলামের সেবক, রক্ষক ও পোষকের যে দাবি তারা অহরহ করে থাকেন তাদের ওই ভূমিকা সে ক্ষেত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক ছিল। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে তাদের যথার্থ ভূমিকা রয়েছে। অন্যত্র থেকে উদাহরণ দেয়ার আগে এই ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া থেকে উদাহরণ দেয়া যাক। ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননে যখন মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে, যখন ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয় তখন এই ওলামায়ে কেরামই প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত সেই মুক্তি সংগ্রাম শতাব্দীব্যাপী আলোড়ন তোলে। হজরত শাহ আবদুল আযীয, সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, ইসমাইল শহীদ উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে রক্তস্রোতের সূচনা করেন, বালাকোট হয়ে তা তিতুমীরের বারাসাতে প্রবাহিত হয়। দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের গোলামির বিরুদ্ধে কালক্রমে ফকির বিদ্রোহ, খেলাফত আন্দোলন ও ফরায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে ওলামায়ে কেরামদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পরবর্তীকালে ক্রমেই ওলামায়ে কেরামদের ভূমিকা হ্রাস পায়, সেখানে মুসলিম মানসধারী সেক্যুলার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।

স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ থেকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গতানুগতিক মুসলিম নেতৃত্বের বাইরে থাকলেও ইসলাম, মুসলমান তাদের রাজনৈতিক চিন্তায় প্রবাহমান থাকে। ওলামায়ে কেরামদের একদল আল্লামা হোসাইন আহমেদ মাদানী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অবিভক্ত ভারতের পক্ষে থাকে। অপর অংশ মাওলানা সাব্বির আহমেদ উসমানী, মাওলানা শিবলী নোমানী, মাওলানা কেরামত আলী যৈনপুরী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দেশ বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ওলামায়ে কেরামদের সেই কাক্সিক্ষত ভূমিকার খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। মুসলিম লীগের খাজা গজাদের প্রবল প্রতাপে সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না। তাই মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় সাধারণ মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ ওলামায়ে ইসলাম গঠন করেন। মৌলভী ফরিদ আহমেদ নেজামে ইসলাম নামে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। এভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলে ওলামায়ে কেরামদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কিন্তু তারা এ দেশের মানুষের পরিবর্তিত রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবনে ব্যর্থ হন। তাদের ভাষায়- মুসলমানদের পবিত্র ভূমির প্রতি বিশ^স্ত থাকেন অথবা চরম আদর্শিক সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন। এটি একটি অপ্রিয় সত্য কথা যে, গোষ্ঠীগতভাবে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশগ্রহণে ব্যর্থ হন। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলেম-ওলামা ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হলে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ গৃহীত হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে বারবার নিশ্চিত করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। জমিয়াতুল মুদাররেসীন বা মাদরাসা-শিক্ষকদের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। তিনি টঙ্গী বিশ^ ইজতেমা ময়দান ও কাকরাইল মসজিদের জায়গা দেন। মারাত্মক অপরাধী ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ইসলাম তথা ওলামায়ে কেরামদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশিত হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয় সমঝোতার পথ আরো প্রশস্ত হয়। এরশাদ তার ক্ষমতা সংহতকরণে ওলামায়ে কেরামকে ব্যবহারে সক্ষম হন। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনকালে ইসলামি মূল্যবোধ তথা মধ্যপন্থার নীতি অনুসৃত হয়। ২০০১ সালের সরকারেই জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্ট হলে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রথমবারের মতো ওলামায়ে কেরামদের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। এতে জনগণের ধর্মনিরপেক্ষ অংশ বিশেষত বুদ্ধিজীবী সমাজ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে কার্যত ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন ঘটে। সংবিধানে এরশাদ ঘোষিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকলেও জিয়াউর রহমান সংযোজিত ‘আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা বিশ্বাস’ পরিত্যক্ত হয়। এই আদর্শিক সুবিধাবাদ, বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রদর্শিত হয়।

১. সংবিধান থেকে ইসলামি ভাবধারা বিতাড়ন, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জঙ্গিত্ব আরোপ, ইসলামি লেবাসের প্রতি আক্রমণ এবং শিক্ষাব্যবস্থা তথা পাঠক্রমে ইসলামি বিষয়াদি প্রত্যাহার ইত্যাদি কারণে গরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে।
২. পাশ্চাত্যের অনুসরণে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের জন্য ইসলামকে দায়ীকরণ এবং মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জঙ্গিত্ব আরোপে ওলামায়ে কেরাম ক্ষুব্ধ হন।

৩. আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগে কিছু নাস্তিক কর্তৃক কুরআন এবং রাসূলে করিম সা:-এর প্রতি অবমাননাকর বিদ্রুপ এবং কটূক্তি একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও নেটওয়ার্কে এসব বক্তব্য দেশের ওলামায়ে কেরামকে আহত করে।
৪. ১৯৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো হুবহু নিষিদ্ধ না হলেও এসব রাজনৈতিক দলের প্রতি নিপীড়ন, নির্যাতন, গ্রেফতার ও হয়রানি প্রকারান্তরে ওলামায়ে কেরামকে আক্রান্ত করে।
৫. ওলামায়ে কেরামদের ভাষায় সমাজে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা সরকারকে দায়ী করতে থাকে।
৬. সারা দেশে এক ও অভিন্ন জঙ্গিবিরোধী খুতবার নামে সরকার নির্দেশিত খুতবায় ওলামায়ে কেরাম অসন্তুষ্ট হন।

এসব দাবি এবং বক্তব্যের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্য একত্রিত হয়। ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত নিষিদ্ধ ও নিষ্ক্রিয় থাকার ফলে একদল ওলামায়ে কেরাম এর প্রতিবাদ করতে অগ্রসর হন। তারা দেশের একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও আলহায়াতুল আলিল জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা আহমেদ শফীর হাতে নেতৃত্ব অর্পণ করেন। ওলামায়ে কেরাম তার নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু শুধু ইসলামের খেদমত, সুরক্ষা ও সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য এই আন্দোলন- এর নাম দেয়া হয় ‘হেফাজতে ইসলাম’। হেফাজতের আমির আল্লামা শফী ঘোষণা করেন, মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে রক্ষা করাই হলো হেফাজতের মূল উদ্দেশ্য।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে তার ও হেফাজতের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ২০১৩ সালের প্রথম দিকে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রবল সরকারি বাধাবিপত্তির মুখেও ওই অবরোধ ব্যাপকভাবে সফল হয়। সরকার দাবিদাওয়ার ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব দেখালে হেফাজত ৫ মে ২০১৩ ঢাকা অবরোধের সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়। ওইদিন দুপুরে সারা দেশ থেকে আগত হেফাজতের লাখ লাখ মানুষ মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমবেত হয়। সব রাজনৈতিক দল হেফাজতের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করলেও ক্ষমতাসীন সরকার এর মাধ্যমে সরকার পতনের কৌশল লক্ষ করে। তারা হেফাজতের আমির আল্লামা শফীকে সমাবেশস্থলে আসতে বাধা দেয়। সমাবেশের সমাপ্তি নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এক অংশ মনে করে, অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে তারা তাদের দাবিদাওয়া আদায় করতে পারবে। অপর দল আল্লামা শফীর নির্দেশের অপেক্ষায় থেকেও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পেতে ব্যর্থ হয়। ক্ষমতাসীন সরকার হেফাজতের অবস্থানকে সরকার পতনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। তারা অবস্থান ধর্মঘটকে বানচাল করার জন্য শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এই নির্মম আচরণে হেফাজতের অনেক লোক মৃত্যুবরণ করে। হেফাজতের পক্ষ থেকে এবং একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মৃত্যুর সংখ্যা ২৫০০ থেকে ৩০০০ বলে দাবি করে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষে হেফাজতের সাত কর্মী, একজন পুলিশ সদস্য ও তিনজন সাধারণ মানুষসহ ১১ জন নিহত হয়। অবশেষে সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব দাবি করেছেন, ওই ঘটনায় কেউই মৃত্যুবরণ করেনি। উল্লেখ্য, ওই ঘটনার পর হেফাজতের প্রায় সব নেতাকে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেফতার করা হয়। হেফাজত দাবি করে, তাদের হাজার হাজার কর্মীকে আটক, লাঞ্ছিত ও হয়রানি করা হয়। অবশ্য সসম্মানে আল্লামা শফীকে তার কর্মস্থলে পৌঁছে দেয়া হয়।

শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এই দমনপীড়নে ভেতরে ভেতরে সংক্ষুব্ধ হয় লাখ লাখ ওলামায়ে কেরাম। সততই সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পেতে থাকে তারা। সরকার ওলামায়ে কেরামের এই গভীর মনোবেদনা অনুভব করে। তারা বিভিন্ন ছল, বল, কল ও কৌশলে তাদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে। এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে- ভীতি প্রদর্শন, সুবিধা প্রদান, নগদ অর্থ বিতরণ এবং একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া। আগেই বলা হয়েছে, হেফাজত কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ, উদ্দেশ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠী নয়; বরং এরা একটি সেন্টিমেন্ট কেন্দ্রিক বিভিন্ন সমীকরণে বিভক্ত জনশ্রেণী। তবে সাধারণ উদ্দেশ্য ইসলামের সম্মান ও সমৃদ্ধি অর্জনে এরা এক ও অভিন্ন। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং এজেন্সিগুলোর তৎপরতায় অবশেষে হেফাজতকে নিষ্ক্রিয়, বিভক্ত ও অবদমনে সক্ষম হয় সরকার। সরকারের এই কঠোর ও কোমল নীতির সুফল দেখা দেয়। হেফাজতকে তুষ্ট করার জন্য সরকার কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে মাস্টার্স বা এমএ ডিগ্রির সমমান দিতে রাজি হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত অভিযোগে বলা হয়, সরকার হাটহাজারী মাদরাসায় জমি ও বিপুল অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আল্লামা শফীর ছেলেকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। অথচ এই সুবিধাজনক সম্পর্কের আগে সরকার আল্লামা শফীকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে। মহিলাদের সম্পর্কে তার কথিত নেতিবাচক উক্তি নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নানা ধরনের নোংরা উক্তি করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় সরকারপ্রধানও বাদ যাননি।

সরকার কওমি মাদরাসার ব্যাপারে নমনীয় সিদ্ধান্তের পর আল্লামা শফী তার সভাসদদের নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। যারা এই কিছু দিন আগেও একে অপরের সম্পর্কে সম্মানজনক বাক্য উচ্চারণ করেননি, তারা এখন একে অপরের প্রশংসা করলেন। হেফাজত আমির বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। হাসিনা খাঁটি মুসলমান। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভুল গাইড করা হয়েছে। এসব উক্তি দৃশ্যত সরকার কর্তৃক মগজ ধোলাইয়ের ফসল। হেফাজত ওই কওমি ডিগ্রির জন্য এবং কথিত হালুয়া-তোহফার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৬২ জন আলেম চিঠি দিয়ে অনুষ্ঠান না করার পরামর্শ দেয়। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানোর কথা বলা হলেও অভ্যন্তরীণ ক্ষোভের মুখে ‘শোকরানা মাহফিল’ নাম দিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রশস্তি গাইবার সিদ্ধান্ত নেয়। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে এই অনুষ্ঠান করার আপত্তি থাকায় কওমি মাদরাসাগুলোর সর্বোচ্চ সংস্থা ‘হাইয়াতুল উলালিল জামিয়াতুল কওমি, বাংলাদেশ’ এই ব্যানার ব্যবহৃত হয়। উদ্যোক্তারা লাখ লাখ ওলামায়ে কেরামের উপস্থিতির কথা বললেও নির্মম স্মৃতির কারণে তাদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ইমামদের ওই সমাবেশে আসতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া, সারা দেশের আলিয়া নেছাবভুক্ত সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসা শিক্ষকদের ঢাকায় আসার নির্দেশ দেয়া হয়। ওই সময়ে জুনিয়র দাখিল মাদরাসা পরীক্ষা থাকায় ওই পরীক্ষা স্থগিত করে পরবর্তী শুক্রবারে পরীক্ষা নেয়া হয়।

ক. সরকারি ও বেসরকারি মাদরাসা শিক্ষকেরা সোহরাওয়ার্দী ময়দানের এ মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি প্রদান করে এবং আল্লামা শফীকে স্বাধীনতা পদক দেয়ার দাবি জানায়। কওমি জননী উপাধি উপস্থাপন করেন গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক ও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড স্থানীয় চেয়ারম্যান মুফতি রুহুল আমীন। তিনি প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মরহুম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর ছেলে। তিনি বলেন, ‘আপনার এ মাতৃত্বে ভূমিকা না থাকলে এই দেশে সাহাবাদের শত্রু, ওলামায়ে কেরামের শত্রু বাংলাদেশের শত্রু জামায়াত-মওদূদীরা তা হতে দিত না।’ প্রবীণ একজন আলেম মন্তব্য করেন, মাওলানা ফরিদপুরী যদি বেঁচে থাকতেন তার ছেলের মোসাহেবি ভূমিকায় হয়তো তিনি লজ্জা পেতেন। ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা এ সনদ প্রদানে অসন্তুষ্ট। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা এ নিয়ে বিষোদগার করেছেন। তাদের আরো আপত্তি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ওই জায়গা থেকেই আদর্শবিরোধী খেতাব দেয়া হয়। এতে একজন কলামিস্ট উভয় পক্ষেই স্পষ্টভাবে কপটতার প্রমাণ পাচ্ছেন। এটাকে তিনি নৈতিক অধঃপতন মনে করেন।

খ. সরকার ও আহমদ শফীর এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে উভয়ের কার্যক্রমের বৈপরীত্য, বৈসাদৃশ্য ও অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। আল্লামা শফীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও বুঝতে সক্ষম, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকারের এসব কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শোকরানা মাহফিলে বলেছেন, ‘দোয়া চাই। সামনে নির্বাচন আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি ইচ্ছা করেন, নিশ্চয়ই আবার তিনি জনগণের সুযোগ আমাকে দেবেন। আর যদি আল্লাহ না চান দেবেন না। আমার কোনো আফসোস থাকবে না। কারণ, আমি সব কিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’

গ. ওলামায়ে কেরাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি উভয়ের কাছে ‘যখন যেমন, তখন তেমন’ উক্তি করে প্রধানমন্ত্রী দু’কূল রক্ষা করতে চাচ্ছেন। এক কূলের ভোট অপর কূলের বুদ্ধিশুদ্ধি দরকার তার। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, ওলামায়ে কেরামদের পক্ষ থেকে যারা এসব আয়োজন করছেন বা সমাবেশে সমবেত হয়েছেন- তারা কি সহৃদয়ে ভাবে, স্বেচ্ছায়, নিজ মন থেকে এসব করছেন? মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন তারা বলেন, মানুষ অপমান, অমর্যাদা ও অসভ্যতাকে সহজে ভুলতে পারে না। আর ইতিহাসের সাক্ষ্যও এই যে, গরিষ্ঠ, সৎ ও শ্রদ্ধাভাজন ওলামায়ে কেরাম কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ তথা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসীদের ভোট দেয়নি। আজকাল আর মানুষ অতি নেতা এবং বকধার্মিকদের কথায় ভোট দেয় না। ভোট দেয় তার নিজ বুদ্ধি বিবেচনায়।

ঘ. নিজামুল মূলক তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়াসাত্তনামা’য় বলেছেন, একজন প্রকৃত আলেম কখনোই বাদশাহর তাঁবেদার হবে না। আর বাদশাহ যদি মহৎজন হয়, সে আলেমের তাঁবেদার হতে চাইবে। ওলামায়ে কেরামদের প্রতি আজো বাংলাদেশের মানুষের সতত শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। কিছু সুবিধাভোগী, স্বার্থপর ও বিভ্রান্ত আলেম সমাজের ভূমিকায় আজ তা ক্ষুণ্ন হতে বসেছে। ইসলামি পরিভাষায়, এদেরকে ‘ওলামায়ে ছু’ বলা হয়। এরা হলো ওলামায়ে হাক্কানির বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আলেম। ‘এক কথায় যারা তাদের অর্জিত ইলম অনুযায়ী আমল করে না এবং ইলমের বিনিময়ে আখেরাত অন্বেষণ না করে বরং দুনিয়া অন্বেষণ করে তারাই ওলামায়ে ছু।’ অনেকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ওলামায়ে ছু হলো দুনিয়াদার আলেম, যাদের ইলম অর্জনের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার ভোগবিলাস অর্জন এবং দুনিয়াদারদের নিকট থেকে পদমর্যাদা লাভ করা। সুতরাং এ দেশের দ্বীনদার সাধারণ ওলামায়ে কেরামের প্রতি গোটা জাতির পক্ষ থেকে নিবেদন- তারা যেন জাতির এ সঙ্কটময় সময়ে বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে ‘তাগুত’ বা অবৈধ শক্তির মোকাবেলা করেন।

মনে রাখতে হবে, ওলামায়ে কেরাম হচ্ছেন এক অনিবার্য সামাজিক শক্তি। এই সামাজিক শক্তির অন্যায়, তোষামোদী, চাটুকারী ভূমিকার কারণে ওলামায়ে কেরামের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। কিছু ওলামায়ে কেরাম বাজারের পণ্য হিসেবে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছেন। অবশ্যই এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে। আর পরিবর্তন না হলে জনগণ বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, আলেমসমাজের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে পারে। এর ফলে সমাজের স্থায়ী ক্ষতি সাধিত হবে। সে ক্ষতি পূরণের ক্ষমতা হয়তো তখন আলেমসমাজের থাকবে না।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
দুবাই পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণ কি কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো? এ দেশের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে : ডাঃ শফিকুর রহমান পিছিয়েছে ডি মারিয়ার বাংলাদেশে আসার সময় ইরানে হামলা : ইস্ফাহান কেন টার্গেট? মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল

সকল