২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও প্রিন্সিপল অব নন-রিফউলমেন্ট

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও প্রিন্সিপল অব নন-রিফউলমেন্ট -

কথা ছিল মাত্র ১৫০ জনের প্রথম একটি দল নিয়ে গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হবে। বাংলাদেশ সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও তা শুরু হয়নি। শুধু বাংলাদেশই বা বলি কেন, মিয়ানমারও একইভাবে প্রস্তুত ছিল। আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল বাস। কিন্তু যাদের যাওয়ার কথা তারাই রাজি হলো না। কেউ কেউ উপস্থিত হয়ে জানিয়ে দিলো মিয়ানমারে না ফেরার কথা। কেউ কেউ প্রত্যাবাসন এড়াতে আগেই পালিয়ে যায়।

আর এভাবেই বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুতেই হোঁচট খেল। গত বৃহস্পতিবার দিনভর প্রচেষ্টা চালিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। প্রত্যাবাসনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা দফায় দফায় চেষ্টা চালালেও রোহিঙ্গারা একযোগে সেøাগান ধরে বলে : ‘আঁরা ন-যাইয়্যুম, আঁরা ন-যাইয়্যুম’- ‘আমরা যাবো না, আমরা যাবো না’। এ সময় এরা হাত তুলে কাগজে লেখা নানা দাবির কথা প্রদর্শন করে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যথার্থ দাবি হচ্ছে : ‘আমরা কখনোই নাগরিকত্ব ও অধিকার ছাড়া মিয়ানমারে ফিরে যাবো না।’

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ দেখিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই প্রত্যাবাসন স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছে, বর্তমানে রাখাইনে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। অপর দিকে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে রাজি কি না, জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী প্রত্যাবাসন সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পক্ষ থেকে তা যাচাই করার প্রক্রিয়াও শেষ হয়নি। কক্সবাজারে শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও ত্রাণ কমিশনার (আরআরআরসি) আবুল কালাম গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম দিন ৩০ পরিবারের ১৫০ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের যাবতীয় ভৌত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন পেলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তবে ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ফিরাজ আল-খতিব গত বুধবার বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা গত বুধবার সারা দিন প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্মতির বিষয়টি জানার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি জানার প্রয়াস আরো চলবে। তালিকায় থাকা সব পরিবারের সাথে কথা বলার পর ইউএনএইচসিআর এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারকে জানাবে। তবে তিনি এ-ও বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে ইউএনএইচসিআর মনে করে না। অন্য আরেকটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সাথে যুক্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা এখনই রাখাইনে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়।

শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিঘিœত হওয়ার পেছনে তিনটি বড় ধরনের যৌক্তিক কারণ আলোচনায় এসেছে। প্রথমত, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো নিরাপদ অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান আছে কি না? দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে ইচ্ছুক কি না? এবং সর্বোপরি বর্তমানে রাখাইনে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে কি না? প্রশ্নগুলো যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, যে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে, তাদেরকে সেই অনিরাপদ পরিবেশে আবারো মিয়ানমারে পাঠানো কোনোমতেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। তাদের ওপর দিয়ে যে নিধনযজ্ঞ ও অত্যাচার আর নিপীড়ন চলেছে তা ইতিহাসে বিরল।

এ পরিস্থিতিকে বর্ণনা করা হয় একটি ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হিসেবে। তা ছাড়া, এদেরকে বিশ্বের ‘মোস্ট পারসিকিউটেড পিপল’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। অতএব স্বাভাবিক ও যৌক্তিক দাবি হচ্ছে, তাদের নিরাপদ পরিবেশ জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পুরোপুরি নিরাপত্তা বিধান করেই মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে হবে। এই নিরাপত্তা বিধানে বিন্দুমাত্র ঘাটতি রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য সেই নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হচ্ছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করা যাবে না। কারণ, মাঝে মধ্যেই আমরা গণমাধ্যমে খবর পাই, এখনো কিছু রোহিঙ্গা জান বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। এতে এটুকু নিশ্চিত, এখনো রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নেই। অতএব, নিরাপদহীন পরিবেশে এদের মিয়ানমারে পাঠানো মোটেও উচিত হবে না। তা ছাড়া, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের এই নির্যাতনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে এদের নাগরিকত্বহীনতা। সে দেশটিতে এদের নাগরিকত্ব এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হলে এ ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন ও নিধনযজ্ঞের শিকার হতে হতো না। তাই এদের নাগরিকত্ব না দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠালে আবারো নতুন করে এরা নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকারে পরিণত হবে। সেজন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়েই তাদের ফেরত পাঠানো উচিত। কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেও এ সুপারিশটি ছিল অন্যতম। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, নাগরিকত্ব না দিয়ে কেন আজ তাদের ফেরত পাঠানোর এই উদ্যোগ?

সর্বোপরি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারটি সতর্কতার সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে। সে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ দেখিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই প্রত্যাবাসন স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছে, বর্তমানে রাখাইনে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। আমরা জানি, পাশের দেশ ভারতেও মিয়ানমার থেকে যাওয়া কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন। ভারত চায় অনেকটা জোরজবরদস্তি করে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে। সেখানেও আন্তর্জাতিক নীতির কোনো লঙ্ঘন ঘটে কি না, সে প্রশ্নটি আলোচনায় এসেছে।

ঘড়হ-ৎবভড়ঁষবসবহঃ নামে আন্তর্জাতিক আইনের একটি মৌলনীতি রয়েছে। এই মৌলনীতি বলে, গ্রহীতা কোনো দেশ আশ্রয়প্রার্থীকে এমন কোনো দেশে ফেরত পাঠাতে পারবে না, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর সদস্য হওয়া, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের ধারক-বাহক হওয়ার কারণে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে পারে। এটি কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল। এটি সেসব দেশের ওপরও প্রযোজ্য, যেগুলো ১৯৫১ সালের ‘কনভেনশন রিলেটিং টু দি স্ট্যাটাস অব রিফিউজিস’ এবং এর ‘১৯৬৭ প্রটোকল’-এর অংশ নয়। এটি ‘ট্রুুসিয়েল ল অব ন্যাশনস’-এরও নীতি। এটি শরণার্থীদের বেলায় প্রযোজ্য হয়।

ভারত গত ৪ অক্টোবর সাতজন রোহিঙ্গাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়, যেখানে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানোর সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবং যেখানে তাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার হাতে।

ভারত ভাবছে, দেশটির বিভিন্ন অংশে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাসকারী ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। অথচ এ ক্ষেত্রে ভারতের দায় আছে Non-refoulement নামের আন্তর্জাতিক আইনি নীতি বা লিগ্যাল পলিসি মেনে চলার। ফলে ভারত থেকে ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে অনেকটা জোর করেই মিয়ানমারে পাঠানোর ব্যাপারটি নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন অব্যাহতভাবে চলে আসছে বহু বছর আগে থেকেই। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ পরস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারের এই অপকর্ম তীব্র আকার নেয়। তখন থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বুদ্ধিস্ট ন্যাশনালিস্টরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা চরমভাবে জোরদার করে তোলে। গত বছর এই নির্যাতন নবতর উচ্চতায় নিয়ে পৌঁছানো হয়। ফলে দেশটি থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবেই বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। তাদের ওপর পরিচালিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও চরমপন্থী বৌদ্ধদের ভয়াবহ নির্যাতন ও নিধনযজ্ঞের তথ্যচিত্র জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের তিন সদস্যের মিয়ানমার সম্পর্কিত একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট মতে, সেখানে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও চরম ধরনের নির্যাতন চলেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনার মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে জাতিগত নিধনের ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা পাশের যে দেশে আশ্রয় নিতে পারছে, সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে এবং নিচ্ছে। সাত লাখ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। ৪০ হাজার আশ্রয় নিয়েছে ভারতের বিভিন্ন অংশে। এসব শরণার্থী ঘনবসতি বস্তির মধ্যে অস্বাস্থ্যকর নারকীয় পরিবেশে বসবাস করছে। সেখানে নেই পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও খাবার। ভারতে ১৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী ইউএনএইচসিআরের সাথে নিবন্ধিত। ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের অনেকেরই নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র।

ওপরে উল্লিখিত principle of non-refoulement উল্লেখ রয়েছে ১৯৫১ সালের ‘কনভেনশন রিলেটিং টু দি স্টেটাস অব রিফিউজিস’-এর ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে। এই নীতি আন্তর্জাতিক শরণার্থীদের সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে একটি ভিত্তিস্তম্ভ। এতে বলা আছে, শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী কোনো বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে এমন কোনো ভূখণ্ডে পাঠানো যাবে না, যেখানে তাদের জীবন ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই নীতি বিভিন্ন আকারে-প্রকারে আরো অনেক দলিলপত্রে পরবর্তী সময়ে গৃহীত হয়েছে। যেমন- ১৯৮৪ সালের ‘কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার’-এর ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে একটি রাষ্ট্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে কোনো ব্যক্তিকে অপর এমন দেশে পাঠাতে, যেখানে এমনটি বিশ্বাসের পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে যে, সেখানে পাঠানো হলে সে নির্যাতনের শিকার হতে পারে।

১৯৬৬ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’-এ সরাসরি আমরা এই non-refoulement নীতির উপস্থিতি পাই না। তবে এই কনভেনশনের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, কারো প্রতি নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক ও অপমানকর শাস্তি দেয়া যাবে না। আর এই প্রবিধানটি ব্যাখ্যাত হয়েছে ১৯২০ সালে হিউম্যান রাইটস কমিটি ২০ নম্বর জেনারেল কমেন্টে non-refoulement নীতির উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

এটি সত্য, ভারত একটি নন-সিগনেটরি দেশ হিসেবে রিফিউজি কনভেনশনের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে চলতে বাধ্য নয়। কিন্তু দেশটি পরিত্যাগ করতে পারে না, কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল-এর দায়দায়িত্ব। যেহেতু নন-ফাউলমেন্ট নীতি অর্জন করেছে কাস্টমারি আইনের মর্যাদা, সেজন্য সব দেশ তা মেনে চলতে বাধ্য, সেসব দেশ রিফিউজি কনভেনশনের অংশী হোক বা না হোক। শুধু তাই নয়, প্রিন্সিপল অব নন-ফাউলমেন্ট এখন পরিপক্ষতা অর্জন করেছে jus cogens এর একটি নর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভের, আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত যাকে হেয়প্রতিপন্ন করার কোনো সুযোগ আন্তর্জাতিক কোনো আইনে নেই। রিফিউজি কনভেনশনের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ মতে- একটি দেশকে অনুমতি দেয়া হয় না এই নীতি থেকে সরে যাওয়ার, যেখানে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে এমনটি বিশ্বাস করার যে, সংশ্লিষ্ট শরণার্থীরা দেশটি নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

রোহিঙ্গাদের ভারত থেকে তাড়ানোর সিদ্ধান্তের পক্ষে ভারত দেখাচ্ছে তিনটি যুক্তি। প্রথমত, ভারত বলছে, দেশটি ‘প্রিন্সিপল অব নন-ফাউলমেন্ট’ মেনে চলতে বাধ্য নয়। কারণ দেশটি রিফিউজি কনভেনশনের ও ১৯৮৪ সালের টরচার কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। ভারত এখন পর্যন্ত এসব কনভেনশন অনুসমর্থনও করেনি। দ্বিতীয়ত, এর অভিমত হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠালে আরো রোহিঙ্গা ভারতে প্রবেশের ব্যাপারে উৎসাহিত হবে। এর ফলে ভারতীয় নাগরিকেরা বঞ্চনার শিকার হবে। তৃতীয়ত, ভারত ন্যাশনাল সিকিউরিটির বিষয়টি উত্থাপন করেছে, যা নন-ফাউলমেন্ট নীতির ব্যতিক্রম।

ভারত সরকারের তোলা এসব অভিমত খুবই দুর্বল, যা আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি সত্য, ভারত রিফিউজি কনভেনশনের কোনো অংশী নয়। তাই বলে এই কনভেনশনের দায়ভার থেকে ভারত পরিপূর্ণভাবে মুক্ত নয়। ভারত অনেক মানবাধিকার কনভেনশনের স্বাক্ষরদাতা দেশ, যা ভারতকে পুরোপুরি নন-ফাউলমেন্ট নীতির দায় থেকে অব্যাহতি দেয়নি। যেমন- ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের ‘জেনারেল কমেন্ট ৩১’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস কমিটি’তে স্বাক্ষর করেছে ভারত। এতে বলা আছে : the obligation to respect and ensure the ICCPR rights “entails an obligation not to extradite, deport, expel or otherwise remove a person from their territory, where there are substantial grounds for believing that there is a real risk of irreparable harm.

একই ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে ‘কমিটি অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’-এর ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’-এর জেনারেল কমেন্ট ৬’-এ। এতে বলা হয়েছে : “States shall not return a child to a country where there are substantial grounds for believing that there is a real risk of irreparable harm to the child.”

এসব কনভেনশনাল দায়দায়িত্বের বাইরে ভারতের কাস্টমারি দায় হচ্ছে জোর করে কোনো শরণার্থীকে এমন দেশে পাঠাতে পারবে না, যেখানে তাদের ওপর নির্যাতন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিংবা সেখানে তাদের জীবন ও স্বাধীনতার ওপর হুমকি সৃষ্টি হতে পারে। ভারতের আদালতও ব্যাখ্যা দিয়েছে principle of non-refoulement অনুযায়ী এবং ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারত প্রত্যেক মানুষের জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে বাধ্য, তা সে হোক ভারতের নাগরিক কিংবা অন্য দেশের নাগরিক।

ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় ভারত পারে না, সে দেশে থাকা ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে জোর করে ফেরত পাঠাতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজ দেশে তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। আর তা করার জন্য তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে সে দেশে পাঠানো অপরিহার্য। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই এই গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বিষয়টির ওপর জোর তাগিদ দিতে হবে। নইলে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে পাঠানোর অপর অর্থ তাদেরকে নতুন করে নিধনযজ্ঞ ও নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে ঠেলে দেয়া।


আরো সংবাদ



premium cement