২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচন ভাবনা ও জনপ্রত্যাশা

নির্বাচন ভাবনা ও জনপ্রত্যাশা - ছবি : নয়া দিগন্ত

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম হলো নির্বাচন। সে নির্বাচনটি অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হতে হয়। একটি দেশে সরকারের প্রকার ভেদে কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা দেশটির সংবিধান দিয়ে নির্ধারিত। আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় পদ্ধতির উভয় ধরনের সরকারব্যবস্থায় শাসিত হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থার উল্লেখ থাকলেও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়, যা নানা পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী প্রণয়ন অবধি বলবৎ ছিল। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা আজো অব্যাহত আছে।

সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যায়, যদিও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি মেয়াদ পূর্তির আগেও সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। ’৭২-এর সংবিধানে সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান ছিল তাতে বলা ছিল- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিধানটি কার্যকর থাকাকালীন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠÑ এ ছয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু এ ছয়টি সংসদের কোনোটিই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি অভ্যুদয়ের পর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি- এ তিনটি দলের রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ ঘটে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দু’টি দল ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় পদ্ধতি উভয় ধরনের সরকারব্যবস্থায় শাসিত হয়; অপর দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় পূর্বাপর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা কার্যকর ছিল।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল পরবর্তী দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যে বিরোধ, তা হলো একটি সরকারের মেয়াদ অবসানের পর কোন ধরনের সরকারের অধীন সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী সমভিব্যাহারে পঞ্চম সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনটি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী একযোগে বর্জন করায় এটি দশম সংসদ নির্বাচনের মতো একতরফা ছিল।

ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনটি যে মাত্রায় কলুষতা ও অনিয়মে ভরপুর ছিল, তা দশম সংসদ নির্বাচনের অনুরূপ; তবে এ দুটি নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য হলো প্রথমটি অনুষ্ঠান-পরবর্তী বিরোধীদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংসদের প্রথম অধিবেশনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিধানবিষয়ক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রবর্তন করে সংসদ অবলুপ্ত করা হয়। অপর দিকে শেষোল্লিখিতটিকে সংবিধানের ধারাবাহিকতায় নিছক নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলা হলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে বিরোধীদের দাবির উপেক্ষায় এ সংসদটি মেয়াদ পূর্ণ করতে চলেছে। প্রথমোল্লিখিত অনুষ্ঠানকালীন আওয়ামী লীগ দেশের প্রধান বিরোধী দল ছিল, অপর দিকে শেষোল্লিখিত অনুষ্ঠানকালীন বিএনপি দেশের প্রধান বিরোধী দল ছিল। তা ছাড়া প্রথমোল্লিখিত বিপরীতে শেষোল্লিখিত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বর্জন করে। জাতীয় পার্টি দশম সংসদে একাধারে সরকারের অংশীদার ও বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এ ধরনের ব্যবস্থা গণতন্ত্রের রীতিনীতির সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দশম সংসদের ১৫৪ জন সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সংসদ গঠন বিষয়ে সংবিধানে যে বিধানের উল্লেখ রয়েছে তাতে বলা আছেÑ একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ৫০ জন মহিলা সদস্য সর্বমোট ৩৫০ সদস্য সমন্বয়ে সংসদ গঠিত হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, যে সংসদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের অর্ধেকেরও অধিক আসনের ১৫৪ জন সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সে সংসদটি যথাযথভাবে সংবিধানের বিধানাবলির আলোকে গঠিত কি না?

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন-পরবর্তী সংসদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান করা হয়, তাতে বলা ছিল মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসান ছাড়া, অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিধানটি প্রবর্তন-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দু’টি নির্বাচনের প্রথমটিতে আওয়ামী লীগ এবং শেষোক্তটিতে বিএনপি বিজয়ী হয়।

অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসানের পর দলীয় রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনবিষয়ক সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে গঠন করায় এটি সংবিধান অনুসৃত পন্থায় গঠিত হয়েছিল এমন দাবির যৌক্তিকতা আছে কী? অতঃপর সেনাসমর্থিত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল সেটি সংবিধানসম্মত পন্থায় গঠিত হয়নি এবং সে সরকারটিকে অদ্যাবধি সংসদে অনুমোদন দেয়া হয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বাতিলবিষয়ক আপিল মামলার রায়ে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণায় আদালতের মাধ্যমে ওই সরকারের সময়ের কৃতকার্যকে অযাচিতভাবে বৈধতা দেয়া আইনানুগ হয়েছে কি না, এ প্রশ্নটির নিরসন হওয়া জরুরি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেখানে আদালতে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়, সেখানে একই আদালত সংসদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একটি অসাংবিধানিক সরকারের কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস নেয়।

এ দেশে একসময় বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল, কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তীব্র বিরোধিতার মুখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপসাধন করে। এ ব্যবস্থাটি বিলোপে যদিও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়কে উপলক্ষ হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু সে রায়টি পর্যালোচনায় দেখা যায় প্রধান বিচারপতিসহ সাতজন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চারজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে এবং তিনজন বহালের পক্ষে মতামত দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে মতামতদানকারী চারজনের মধ্যে একজন অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পর রায় দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করায় দেওয়ানি কার্যবিধির ভাষ্য অনুযায়ী এটি আইন সম্মত হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন ওঠে। আর তাতে দেখা যায়, এটি ৩:৩ একটি বিভক্ত রায়। এমন রায়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিচারকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক নয় কী।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এ যাবৎকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১০টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ছয়টি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন এবং চারটি ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারবহির্ভূত সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এর অধীন প্রথম ও দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এর অধীন দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দু’টি নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এর অধীন তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দুটি নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচনটি কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুসৃত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। নবম সংসদ নির্বাচন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। এ চারটি নির্বাচনের কোনোটিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার বিজয়ী হতে পারেনি। উপরোল্লিখিত ১০টি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনায় যে চিত্র পাওয়া পায় তাতে এ দেশের জনমানুষের আগাম অনুধাবনের অবকাশের সক্ষমতার প্রকাশ ঘটে।

সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় সংসদ বহাল থাকাবস্থায় ক্ষমতাসীন দলীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের অধীন আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায় সে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এমন ধারণাপোষণ অমূলক।

বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মন্ত্রিসভায় কে অন্তর্ভুক্ত হবেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার অধীন বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায়ও প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি ছিলেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। সরকার প্রধান ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি হলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদে বহাল থাকার কারণে তারা সরকারে বহাল থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয় লাভে ব্যর্থ হলে সে ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতা হতে সরে দাঁড়াবেন এমন নিশ্চয়তা আছে কি?

সংসদ বহাল থাকাবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে একই আসন থেকে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং অপর সবাই প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হবেন। এটি একটি অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এ ধরনের অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমসুযোগসংবলিত মাঠ সৃষ্টির জন্য কোনোভাবেই সহায়ক নয়। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের পূর্বে সংসদ ভেঙে দেয়ার কারণে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় না।

আমাদের সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। দশম সংসদ নির্বাচনের সময় দেখা গেছে, মন্ত্রিসভার আকার ছোট করে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত সরকার নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরূপ সরকার নিয়োজিত থাকলেও নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের মন্ত্রী পদে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন না এবং নির্বাচনী কাজে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন না। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এ দু’টির কোনোটিরই অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এটি একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। সংবিধানে বলা আছে নির্বাচন কমিশনারেরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। আমাদের দেশে এ যাবৎকাল পর্যন্ত দলীয় সরকার কর্তৃক যতগুলো নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে এর মধ্যে একটি ব্যতীত অপর সবই দলীয় সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট ছিল। যে নির্বাচন কমিশনটি দলীয় সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণ করেনি সেটি কমিশন হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। সাবেক সচিব আবু সাঈদের নেতৃত্বে এ নির্বাচন কমিশনটি ১৯৯৬ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় নিয়োগ লাভ করে এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও এ কমিশনটি বহাল থাকে।

ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার কর্তৃক নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেয়ার সময় বরাবরই লক্ষ করা গেছে কমিশনে দলের নীতি ও আদর্শ এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থাভাজন ছাড়া অপর কেউ বিবেচনায় স্থান পায় না। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ কার্যটি সমাধা করা হলেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরে এ নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটানোর আইনগতভাবে কোনো সুযোগ নেই। বিগত একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় বাছাই কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকার্য সমাধা করা হয়েছে দেশবাসীকে এমন ধারণা দেয়ার প্রয়াস নেয়া হলেও তা যে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী হয়েছে দেশের সচেতন জনমানুষ এটি অনুধাবনে সক্ষম।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকার সংসদে এ তিনটি দলের অনুপস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক বিল পাসের সময় এ দেশের সাধারণ জনমানুষ যে এ ব্যবস্থাটির সপক্ষে ছিল সে সময়কার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে এর সমর্থন পাওয়া যায়। অনুরূপ ২০১১ সালে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এর জোটভুক্ত দলগুলোর দাবির উপেক্ষায় সংসদে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে প্রত্যক্ষ করা গেছে জনমানুষের সমর্থন এ ব্যবস্থাটি বহালের সপক্ষে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে জনমত যাচাই ছাড়া কোনো আইন প্রণীত হয় না। এ কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় জনমত এর সপক্ষে ছিল এবং বাতিলের সময় জনমত এটির বিপক্ষে ছিল।

জনমত যাচাই ছাড়া কোনো আইন প্রণয়ন প্রত্যাশিত নয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবক্তা হলেও জন-আকাক্সক্ষার বিপরীতে স্বীয় স্বার্থ রক্ষার মানসে তারা এ ব্যবস্থাটির বিলোপসাধন করেছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সহায়ক নয়। আর তাই ক্ষমতাসীনদেরই দায়িত্ব এমন সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে মসৃণ পালাবদলের নিশ্চিয়তা দেয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement