২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সময়-অসময়

কোর্ট-কাচারির দুর্নীতি কি দুর্নীতি?

প্রতীকি ছবি - সংগৃহীত

‘দুর্নীতি’ কী, এর কোনো ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দুদক আইন অর্থাৎ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধি ২০০৭-এ নেই। তবে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ ধারায় Criminal Misconduct-এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। আইনটি ১১ মার্চ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে কার্যকর হয়, অথচ পাকিস্তান হিসেবে জন্মলাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। দুর্নীতির বিচার হয় আদালতে, কিন্তু আদালত কার্যালয় কতটুকু দুর্নীতিমুক্ত তা-ও বিবেচনায় নেয়া দরকার।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন কর্মকর্তা যথাক্রমে- মো: নজিম উদ্দিন, মো: রফিকুল ইসলাম ও ইয়াসমিনকে দুর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এই দুর্নীতি বিচারকগণ জানেন, তারপরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আদালত প্রাঙ্গণের ঘুষ যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আদালতের কোনো আদেশ বাড়তি টাকা ছাড়া রিলিজ করা যায় না। ফলে গরিব মানুষের ভোগান্তি দিন দিন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। যারা বিনা দোষে গায়েবি মামলায় আসামি, তাদের রিলিজ অর্ডার রিলিজ হওয়ার আগে জামিনের সময়সীমা শেষ হয়ে যায়, টাকার শ্রাদ্ধ তো আছেই।

অন্য দিকে কোনো কোনো বিচারকের নামে দুর্নীতি করার সরাসরি অভিযোগ রয়েছে, এ কথাও অস্বীকার করা যায় না।

সিসি ক্যামেরায় ঘুষ দেয়া-নেয়ার দৃশ্য দেখে সুপ্রিম কোর্টের উল্লিখিত তিন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু যে ঘুষ আদালত প্রাঙ্গণে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে, তা উৎখাতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিরা সফলতা পাননি। আদালত প্রাঙ্গণের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে অনেক ঘটনা নীরবে নিঃশেষ হয়ে যায়। গত ১০ অক্টোবর জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, যা নিম্নরূপ-
‘নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলেন ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী (৬৫)। সাতক্ষীরার জোড়া পুলিশ হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওবায়দুর রহমান খুলনা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ছয় মাস আগে উচ্চ আদালতের আদেশে এ হত্যা মামলা থেকে ওবায়দুর খালাস পান। তার কারামুক্তির আইনগত কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৩ বছর জেলে থাকার পর গত রোববার সকাল ৯টায় মারা যান তিনি। আর এক বিকেলে কারাগারে পৌঁছে ফাঁসির দণ্ড থেকে তার খালাসের আদেশ।


ওবায়দুরের স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন জানান, তার স্বামী বিনা দোষে ১৩ বছর জেল খেটেছেন। তিনি এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তিনি তার নিরপরাধ স্বামীর জেল খাটা ও যথাযথ চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।’ আমরা জাতি হিসেবে কতটুকু বিবেকমান, এই একটা সংবাদ পাঠ করলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝে নিতে পারবে। ১৩ বছর জেলে থাকাবস্থায় খালাস পাওয়ার পরও ওবায়দুর রহমান মুক্ত আকাশের নিচে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারলেন না, বরং সাজামুক্ত একজন ব্যক্তিকে ফাঁসির প্রকোষ্ঠেই বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে বিনা চিকিৎসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হলো।

ওবায়দুর রহমানের এই আর্তনাদ রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রনায়ক বা প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান বিচারপতির কর্ণকুহরে পৌঁছবে কি না জানি না, তবে সরকার বা বিচার বিভাগ যদি জবাবদিহিমূলক হতো, তবে নিশ্চয়ই এর জবাব জাতির কাছে পৌঁছত। এ বিষয়টিকে টেস্ট কেস হিসেবে নির্ধারণ করে সরকার বা বিচার বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জাতির সামনে উপস্থাপন করতেন, তবে দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলার একটি চিত্র জাতির সামনে উন্মোচিত হতো, কিন্তু তারা এটা করবেন না এ জন্য যে, এতে অনেকের নিজ চেহারা উন্মোচিত হবে।


একটি জাতি মজবুত হয় জবাবদিহির মাধ্যমে। কারণ, জবাবদিহির মাধ্যমেই ভাগ্যহত মানুষ যারা ক্ষমতায় নাগাল পায় না তাদের কিছু পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন জবাবদিহি। যে জাতি জবাবদিহিকে বাদ দিয়ে শুধু ওপরওয়ালাকে সন্তোষ করার জন্য ব্যস্ত থাকে, যার বিনিময়ে তারা একটি ‘আনন্দ ভুবন’ করায়ত্ত করে, তবে ভাগ্যহত বা ভোগভুগীদের দাঁড়ানোর কোনো স্থান বা অবলম্বন থাকে না। ফলে সভ্যতা পরিণত হয় বর্বরতায়।


আদালতের কর্মপরিধি শেষ হয় সাজা বা খালাসের মাধ্যমে। অপরাধ বিশেজ্ঞদের মতে, কারাগারকে শাস্তির বা সাজা ভোগের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা অপরাধীকে সংশোধন বা কারেকশন (ঈড়ৎৎবপঃরড়হ) করার একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। অপরাধীদের ‘সংশোধন’ করার ফলে পৃথিবীর অনেক কারাগার পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।


কারণ, সেখানে অপরাধীকে সংশোধন করার পদ্ধতি নিশ্চয়ই প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কারাগার কারা কর্তৃপক্ষের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। যার জন্য অল্প অপরাধী জেল খেটে ভয়ঙ্কর অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গবেষণা নেই, অন্য দিকে সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ বিধায় দিন দিন জটিলতা বাড়ছে, জাতি দিকনির্দেশিত হচ্ছে উল্টো পথে। আমাদের দেশে কারাগারগুলো কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা ভুক্তভোগীরা জানেন। তা ছাড়া, নিচে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরো তথ্য পাওয়া যায়, যা থেকে সহজেই অনুমেয়, জাতির পায়ে কুঠারাঘাত করার জন্য দায়ী কে?


গত ২৯ অক্টোবর জাতীয় পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি মতে, ‘গত শুক্রবার দুপুরে ভৈরবে রেল পুলিশের হাতে জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস বিপুল অর্থ ও মাদকসহ আটকের পর এ প্রশ্ন উঠেছে। তার হেফাজত থেকে উদ্ধার করা টাকার উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস নিজেও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, ওই টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা ছাড়া বাকি সব টাকা কারাগারের বিভিন্ন খাত থেকে অবৈধ উপায়ে অর্জন করা। তিনি এ-ও বলেছেন, ওই টাকার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি পার্থ কুমার বণিক ও চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকের ভাগও রয়েছে।


তবে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এ দুই কর্মকর্তা। জানা গেছে, কারাগারে বাইরে থেকে কোনো স্বজন বন্দীর কাছে ৫০০ টাকা পাঠালে ভেতরে সেই টাকা হয়ে যায় ৪০০ টাকা। কমিশন বাবদ ১০০ টাকা কারা ক্যান্টিনে কেটে নেয়া হয়। বন্দীর সাথে স্বজনদের অফিস সাক্ষাৎ নামে আদায় করা হয় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। কারা হাসপাতালে থাকতে হলেও বন্দীকে গুনতে হয় প্রতি মাসে ১২-১৫ হাজার টাকা।

বন্দী ভয়ঙ্কর আসামিদের রোগী সাজিয়ে কারা মেডিক্যাল ও বাইরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এভাবে প্রতি মাসে বিভিন্ন খাত থেকে অবৈধভাবে আয় করা লাখ লাখ টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয় এক শ্রেণীর কারা কর্মকর্তাদের মাঝে। জামিনে মুক্তি পাওয়া একাধিক আসামি জানান, ‘দুর্নীতির খাতগুলো হচ্ছে বন্দীদের সাথে স্বজনদের সাক্ষাৎ, বন্দী বেচাকেনা, খাদ্যপণ্য সরবরাহ, মাদক সরবরাহ, মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া, ক্যান্টিনে দ্বিগুণ দামে খাবার বিক্রি, টাকার বিনিময়ে হাজতিকে হাসপাতালে রাখার সুবিধা, বন্দীর কাছে টাকা পাঠানো ইত্যাদি।


চট্টগ্রাম কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের বন্দীকে কারা হাসপাতালে রাখা হয় টাকার অঙ্ক বুঝে। কয়েদিরা বন্দীদের কাছ থেকে এককালীন ও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করেন। সময়মতো চাঁদা না দিলে হাজতিরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।’ এ ঘটনা শুধু চট্টগ্রামের কারাগারের নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের কারাগারের চিত্র। কারাগারের প্রধান গেটে লেখা রয়েছেÑ ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।’ অথচ সর্বপ্রকার দুর্নীতির সাথে কারা কর্তৃপক্ষ জড়িত। কারাগারগুলো মাদক সেবনের নিরাপদ স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ ও দুর্নীতি, কিন্তু বিচার হয় শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা যাবে না মর্মে সরকার আইন পাস করেছে। কারণ, জনগণকে শোষণ করাতে সরকারের কোনো আপত্তি নেই, তবে যেকোনো অবস্থায় সরকারের প্রতি অনুগত থাকলেই হলো। বিরোধী পন্থীদের নিপীড়ন, নির্যাতন, ন্যায্য অধিকার থেকে যতটুকু বঞ্চিত করা যায় তার ওপরই নির্ভর করে কোন আমলা সরকারের প্রতি কতটুকু অনুগত। যেখানে গণতন্ত্র থাকে না সেখানে আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং আমলাদের দুর্নীতি রেওয়াজে পরিণত হয়। আমলাদের নিয়ন্ত্রক সরকার এবং বিরোধীদলীয়দের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করতে পারলেই পোক্ত হয় আমলাদের আমলাগিরি এবং বর্তমানে বাংলাদেশে তাই চলছে, অথচ নিষ্পেষিত হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।


লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী, আপিল বিভাগ
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ৩ মামলা তৃণমূল সংগঠনের মজবুতির জন্য কাজ করতে হবে : মাওলানা আব্দুল হালিম ‘দেশ ও জাতি দুঃসময় পার করছে’ ওসমানীনগরে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ২ সহ-অধিনায়ক হতে পারেন রিজওয়ান মেক্সিকোয় মেয়র প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহেও ক্লাস বন্ধ ঘোষণা দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের

সকল