১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
অবলোকন

শ্রীলঙ্কার ‘পলিটিক্যাল ক্যু’ ও বাংলাদেশের উত্তেজনা

-

শ্রীলঙ্কায় এক নাটকীয় পরিবর্তনে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে এই নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহে তিন দিনের ভারত সফর শেষ করে দেশে ফিরে আসার পরই এই পরিস্থিতিতে পড়েন।

এর আগে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছে মর্মে একটি খবর নিয়ে দেশটিতে তোলপাড় শুরু হয়। প্রতিপক্ষ সিরিসেনার প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্তের উদ্যোগকে সংবিধানপরিপন্থী এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অভ্যুত্থান হিসেবে দেখছে। দৃশ্যত এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে অস্বীকার করে বিক্রমাসিংহে দাবি করছেন, তিনি এখনো শ্রীলঙ্কার বৈধ প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ত্যাগেও তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট সংসদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন। আর নতুন প্রধানমন্ত্রী গঠন করেছেন মন্ত্রিসভা। তার পক্ষে আস্থা ভোটে জয়ের জন্য প্রতিপক্ষের এমপি ‘কেনা’র কাজ জোরালোভাবে শুরু করেছেন তিনি। বিক্রমাসিংহে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তবে তার পক্ষে কলম্বোতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। স্পীকারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ৫ নভেম্বর সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন।

এতে নতুন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিপক্ষে আস্থা ভোট হতে পারে।

শ্রীলঙ্কার পুরো ঘটনায় দেশটির অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টর যতটা জড়িত, তার চেয়ে কোনো অংশে কম জড়িত নয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টর। পরিবর্তনের পর কলম্বোতে চীনের দূত চেং শুয়ে উয়ান প্রথম বিদেশী কূটনীতিক হিসেবে রাজাপাকসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। ভারতও রাজাপাকসের ঘনিষ্ঠ হতে এক সময় আগ্রহী বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নিয়োগের ব্যাপারে চীন এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত মাসে নয়াদিল্লিতে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়া হয় রাজাপাকসেকে; কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে বিক্রমাসিংহের সাথে দিল্লির সম্পর্ক অধিকতর ঘনিষ্ঠ। আর সিরিসেনার প্রধানমন্ত্রী বদলের উদ্যোগ নয়াদিল্লিকে বিস্মিত করেছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। বিক্রমাসিংহে সদ্য ভারত সফর করে সেখান থেকে সমর্থন নিয়ে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। সেটাকে কাজে লাগানোর আগেই সিরিসেনার এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভারতকে ‘কোণঠাসা’ করার পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।

হামবানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ দেয়া নিয়ে, রাজাপাকসে ভেঙে যাওয়া কোয়ালিশন সরকারের সমালোচনা করলেও তিনি চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই পরিচিত। নিজের আমলে উদারচিত্তে বিভিন্ন প্রকল্পে চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের সঙ্গে ভারত লড়াই করলেও কলম্বো সরকার ভারত-সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু প্রকল্পের অনুমোদন আটকে রেখেছে। অন্য দিকে, চীনারা তুলনামূলকভাবে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলছে।

এ কারণে চীনা আনুকূল্য যে রাজাপাকসে পাবেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ভারত কী করে, তা নিয়ে থাকতে পারে সংশয়। তবে রাজাপাকসের সামনে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পশ্চিমা দেশগুলোকে সামলানো। বরখাস্তের আদেশের পরদিন শনিবার বিক্রমাসিংহে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও ইউকের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছেন। কূটনীতিকেরা বিবৃতি দিয়ে সরকারের প্রতি সংবিধানকে ‘সম্মান’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ঘটনাবলির ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। পশ্চিমা শক্তিগুলো এসএলএফপি’র সঙ্গে মিলে পার্লামেন্টে রাজাপাকসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের বিষয়টিও কঠিন করে তুলতে পারে। বিক্রমাসিংহে যখন এলটিটিই’র বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করার জন্য বিচারিক ও অন্যান্য ব্যবস্থা তৈরি করতে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদে চেষ্টা করছেন তখন রাজাপাকসে তার অতি-জাতীয়তাবাদী অবস্থানই পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

শুরু থেকেই সাংবিধানিকভাবে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করে যাচ্ছেন বিক্রমাসিংহে। পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে তিনিই জিতবেন বলে দাবিও করেছেন। কিন্তু দুই সপ্তাহ পর যখন পার্লামেন্ট বসবে, তখন তার এই দাবি টিকবে কি না সন্দেহ। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর ৫ নভেম্বর অধিবেশন শুরু হচ্ছে। সিরিসেনা ও রাজাপাকসে আস্থা ভোটে টিকে গেলে এখন নতুন করে বাজেট করবেন, যেন অন্তত প্রাদেশিক নির্বাচনের আগে ভোটার টানা যায়।

বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করার সময় পার্লামেন্টে সিরিসেনার ইউপিএফএ এবং রাজাপাকসের এসএলপিপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু এখন অবস্থা বদলে যেতে পারে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ২৯তম সংশোধনী (২০১৫) অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের ক্ষমতা নেই প্রেসিডেন্টের। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে অনুরোধ করতে পারেন। ইউপিএফএ এবং এসএলপিপির পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে এ দুই দলের মোট আসন ৯৫টি। প্রতিপক্ষ ইউএনপির রয়েছে ১০৬ সদস্য। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ১১৩টি আসন।রাজাপাকসেকে পার্লামেন্টে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা সিরিসেনার রয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি করে দিন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রমাসিংহের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই তিরোহিত হতে থাকবে। তিনি যতটা না আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবেন, রাজাপাকসেকে তার চেয়ে বেশি সাহায্য করবে জাতীয়তাবাদী সিনহালা বৌদ্ধদের ভোট। আন্তর্জাতিক সমর্থনের বিষয়েও একটি সুস্পষ্ট মেরুকরণ দেখা যাবে। এই মেরুকরণে চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান সিরিসেনা-রাজাপাকসেকে সমর্থন দিতে পারে। আর ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নতুন পরিবর্তনের করতে পারে বিরোধিতা।

এ ক্ষেত্রে তাদের ‘অস্ত্র’ হবে সংবিধান ঠিকভাবে অনুসরণ না করার বিষয়টি। কিন্তু আস্থা ভোটে রাজাপাকসে টিকে গেলে এই যুক্তি খুব একটা কাজ করবে না। তখন বিক্রমাসিংহের সামনে পথ খোলা থাকবে আদালতে এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা। অন্য দিকে, পশ্চিমারা শ্রীলঙ্কা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইবে তামিল বিদ্রোহ দমনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে। এ ব্যাপারে দোষী সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য চাপ যত জোরালো হবে, জাতীয়তাবাদী সমর্থন ততটাই অনুকূলে চলে যাবে রাজাপাকসের।

এ ধরনের চাপের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজাপাকসের সমর্থকেরা ব্যাপকভাবে ভালো করেছেন। সংসদ নির্বাচনেও যে তার পুনরাবৃত্তি হবে, তা অনেকটা বলে দেয়া যায়।

ডায়লামাটি হলো, মালদ্বীপে চীনের অবস্থান ছিল অজনপ্রিয় ইয়ামিন সরকারের পক্ষে আর সেখানে সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষ নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারত-পশ্চিমা বলয় বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে পেরেছে। শ্রীলঙ্কার হিসাব কিন্তু ভিন্ন। শ্রীলঙ্কায় জনমতের পক্ষে অবস্থান চীনের। আর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে ভারত-পশ্চিমা অক্ষ। ফলে সরকারি ক্ষমতার প্রয়োগ এবং জনসমর্থন উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন সিরিসেনা-রাজাপাকসে। এতে মনে হচ্ছে, এই দ্বীপদেশটির ওপর চীনা আধিপত্য আরো কিছুকাল চলবে। আর ব্যাকফুটে থাকতে হবে পাশ্চাত্য অক্ষকে।
২.
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ক্রমেই বেশখানিকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই উত্তাপ কেবল অভ্যন্তরীণ ক্ষেতে সীমিত থাকছে না। এতে জড়িয়ে পড়ছে বাইরের পক্ষগুলোও। এই জড়ানো যতটা না আনুষ্ঠানিক, তার চেয়ে বেশি অনানুষ্ঠানিক। অন্তরালেই ঘটছে অনেক কিছু।
তাত্ত্বিকভাবে পররাষ্ট্রনীতি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারণ- কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের গৃহীত সেসব নীতি, যা রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে সম্পাদন করা হয়ে থাকে। অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে তুলে ধরে। এর প্রভাব পড়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও।
সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে।

সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে : ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।’ এসব নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। বাংলাদেশ প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে। আর সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন জানাবে। ইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করতে সচেষ্ট হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্দিষ্ট কিছু উপাদান দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা এ নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দ্বারা তিন দিকে বেষ্টিত এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। অন্য দিকে, বাংলাদেশ চীন ও ভারতের মতো এশিয়ার দুই শক্তিমান দেশের বলয়ে অবস্থিত হওয়ায় দুই দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষায় এ দেশকে প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হতে হয়।

এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি। এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যা একটি নেতিবাচক প্রভাব রাখার ফলে সরকার কোনো গতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে পারে না। সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি ও ঐক্য জাতীয় স্বার্থের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে শান্তিপূর্ণ, নিশ্চিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রতিবেশী দেশের সাথে এই সম্পর্ক বিদ্যমান না থাকলেও নিদেনপক্ষে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায় না।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামো মূলত দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। এ ছাড়াও, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিবেচনার ক্ষেত্র, যাতে দেশের জনগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত ন্যূনতম অর্থনৈতিক কল্যাণ অন্তর্ভুক্ত। অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে বিবেচনার ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, রফতানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশী পণ্যের জন্য বাইরের বাজারসুবিধা বৃদ্ধি, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং আরো কিছু ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রগুলো সফল করার লক্ষ্যে বাইরের রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। এ কারণে বাংলাদেশকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতে হয়।

বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সহযোগিতা লাভ করেছে এবং ভারত তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটভুক্ত রাষ্ট্র। এ কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল নীতি গ্রহণ করতে দেখা যায়। সময়ের পরিবর্তনে জাতীয় স্বার্থের কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো দেখা যায়, অতীত সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ ভারতমুখী নীতি গ্রহণ করে থাকে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার কথা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ধারণা বিবেচনায় রেখে প্রায় তিন দশক পর ভারতের সাথে বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি সরকার রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাশিয়ার সাহায্যে দেশে পারমাণবিক প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ অর্জনের সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে এবং বিশ্বের আরো কিছু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’- এটি সত্তরের দশকের ধারণা; যা প্রায় ৪০ বছরের পুরনো। পরিবর্তিত বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পুরনো ধারার পরররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত তার অর্জনের সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সুতরাং পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য নিয়ে নতুন কৌশল-পরিকল্পনা করা উচিত, যার মাধ্যমে পরিবর্তিত বিশ্বে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে।

এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শত্রু-মিত্র নিয়ে হঠাৎ করেই মনে হয় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনে যতটা না আন্তর্জাতিকভাবে আদর্শগত অবস্থান সক্রিয়, তার চেয়ে বেশি ভূমিকা দেখা যায় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের। যেসব পশ্চিমা দেশ ২০০৭-০৮ সালে বিএনপি জোটকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে সক্রিয় ছিল, তারা এবার ‘অংশীদারিত্বমূলক অবাধ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভূমিকা পালন করছে। অন্য দিকে, ’৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে বিএনপির স্বাভাবিক বন্ধুদেশ হিসেবে পরিচিত চীনের সাথে বিএনপির আস্থার সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের নানা উত্থান-পতনেও আওয়ামী লীগ বিরতিহীন কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করেছে মস্কোর সাথে।

কিন্তু বিএনপি ভারতের আস্থা অর্জন করতে গিয়ে চীনের আস্থা হারানোর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ দিল্লির কৌশলগত স্বার্থ পূরণ করেও বাণিজ্য আর অর্থনৈতিক প্রকল্প দিয়ে বেইজিংকে স্বপক্ষে রাখতে পারছে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। কিন্তু এ ইস্যুতে সরকার মিয়ানমারের বন্ধু চীন-রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইউই’র মতো দু’টি বিপরীত পক্ষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রচর্চা প্রশ্নে পাশ্চাত্য আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করছে না, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার পাশে পাচ্ছে তাদের।

রাজনৈতিক দলের এই পররাষ্ট্র সম্পর্ক দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে চীন। দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে আলোচিত কয়েকজনের সঙ্গে অল্প সময়ের ব্যবধানে সাক্ষাৎ করেছেন চীনের প্রতিনিধিরা। চীনের রাষ্ট্রদূত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, অসুস্থ তরিকুল ইসলামকে দেখতে গিয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত।

কিন্তু সরকারের পুরো মেয়াদে চীনা অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর কৌশলের পরও বর্তমান সংবেদনশীল সময়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্র গোলাবারুদ এবং প্রকল্প সহায়তার অর্থ ছাড়করণে এগিয়ে এসেছে বেইজিং। চীনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে এ ব্যাপারে তিনটি নিরাপত্তা সহায়তা চুক্তি করে গেছেন। অপর দিকে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প দিয়ে রাশিয়াকে কাছে টেনেছে সরকার। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি দমনে রুশ বিশেষজ্ঞরা সহায়তা করেছেন।

এবারো মস্কোকে পাশে পেতে দুই বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও প্রকল্প চুক্তি করার আশ্বাসের কথা শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে সংবেদনশীল তথ্য হলো, সেন্টমার্টিনে রুশ সামরিক উপস্থিতির সুযোগ প্রদান। এ তথ্য সঠিক হলে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব কোণের রোহিঙ্গাঞ্চলের ভারসাম্যে নতুন বিন্যাস আসতে পারে।

এসব ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি জটিল সময় পার করছে এখন। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন চায়। কিন্তু এ জন্য তাদের কাছে চাপ প্রয়োগের যেসব উপকরণ রয়েছে, সেগুলো কতটা তারা প্রয়োগ করবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার সাথে আওয়ামী লীগের কৌশলগত সম্পর্কে কোনো রাখঢাক নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চীন কতটা ভূমিকা রাখবে আওয়ামী লীগের শাসন অব্যাহত রাখার জন্য? মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত মার্কিন বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এখন সেই ঝোঁক ততটা নেই। রাশিয়ার সাথে এস ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগ্রহসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে দিল্লি। বলা হচ্ছে, পুতিনের সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও ছিল আলোচনায়।

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশ এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে। এখনকার প্রতিটি দিনই পার হচ্ছে প্রকাশ্যে-অন্তরালে নানা তৎপরতার মধ্য দিয়ে। অবিশ্বাস্য নানা ঘটনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চার দিকে। বহুল আলোচিত সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে। বিরোধি পক্ষের সর্বাত্মক আন্দোলনের কথা শোনা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আরেকটি একতরফা নির্বাচন কি আসন্ন, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই হবে? নাকি ভিন্ন কিছু হবে- ২০০৭ সালের মতো? রাত এক সময় শেষ হয়ে ভোর হয়। সেই ভোর কি আসন্ন বাংলাদেশে? নাকি রজনি দীর্ঘায়িতই হতে থাকবে?

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement