২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানুষের নিষ্ঠুরতা

মানুষের নিষ্ঠুরতা : গোলাম মাওলা রনি -

জানোয়ার নিয়ে নিবন্ধ লিখতে হবে এমন কথা কস্মিনকালেও ভাবিনি। জন্মের পর থেকে কত যে জানোয়ার দেখেছি এবং গালি হিসেবে ‘জানোয়ার’ শব্দটি পথে-ঘাটে-মাঠে বহুজনের জবানে উচ্চারিত হতে শুনেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এরপরও জানোয়ার নিয়ে কোনো চিন্তা মন-মানসে স্থান পায়নি। মানুষের সাথে জানোয়ারের প্রাকৃতিক নির্ভরতা ও সংযোগের কারণে আমরা নিজ নিজ ধর্মানুযায়ী হালাল জানোয়ারের গোশত খাই, দুধ পান করি এবং ওগুলোর হাড্ডি-গুড্ডি, চামড়া-পশম ইত্যাদি ব্যবহার করি। অন্যদিকে, হারাম বলে চিহ্নিত জানোয়ার দেখলে আমাদের গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। বন্য জানোয়ারের হিংস্রতাকে আমরা ভয় পাই- আবার যেগুলো পোষ মানে, সেগুলোকে পরম আদরে গৃহপালিত বানিয়ে নেই। আদিকালে আমাদের জীবন, অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল পশু বা জানোয়ারনির্ভর। বর্তমান সভ্যতার যুগে অতীতের সেই নির্ভরতা কিছুটা কমলেও আমাদের জীবনে জানোয়ারের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ কারণে আমার মনে ইদানীং জানোয়ারের চালচিত্র এবং চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

যারা এই নিবন্ধটি পড়ছেন, তারা হয়তো আলোচনার এ পর্যায়ে একটু হোঁচট খেয়ে প্রশ্ন করতে পারেন- জানোয়ারের আবার চরিত্র হয় নাকি? জানোয়ার তো জানোয়ারই। এর চরিত্র থাকলেইবা কী, না থাকলেই কী। অথবা চরিত্রহীন জানোয়ারের বৈশিষ্ট্য কী? সবার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, জানোয়ার প্রাকৃতিক নিয়মে কতগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। মানুষের কোনো প্রলোভন, প্রভাব, তাপ বা চাপে জানোয়ারেরা কোনো দিন চরিত্রহীন হয়ে পড়েনি। ধরুন, সুন্দরবনের বাঘ কিংবা আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের ভয়ঙ্কর সিংহ যদি মানুষের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে বনাঞ্চলে দস্যুদের অবাধে বিচরণ করতে দিত, তাহলে আপনি তাদের চরিত্রহীন জানোয়ার বলতে পারতেন। অথবা আপনার পোষা বিড়ালটির কথাই ধরুন না। এর চরিত্র হলো মাছের কাঁটা খাওয়া; সুযোগ পেলে দুধ, মাছের তরকারি বা অন্য কোনো খাবারে মুখ দেয়া এবং এসব করে কোনো অনুশোচনা ছাড়াই আবার নির্ভয়ে বিছানায় গিয়ে আপনার পাশে শুয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে ঘুমিয়ে পড়া। বিড়াল আপনার লাথি, গুঁতো, কিল-থাপ্পড় এবং ঝাড়–পেটার কথা মনে রাখে না। একটি বিড়ালকে যদি ভাজা মাছের কাঁটা এক শ’ বার সামনে রেখে সেগুলো খাওয়ানোর লোভ দেখান এবং বিড়াল কাঁটাতে মুখ দেয়া মাত্র সেটির পশ্চাদ্দেশে আঘাত করেন, তবে সে পালিয়ে যাবে এবং একটু দূরে গিয়ে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে ধীর লয়ে ‘মিউ মিউ’ করতে থাকবে।

আপনি কাঁটা খাওয়া বিড়ালকে এক শ’ বার নয়, বরং হাজার বার লোভ দেখিয়ে কাছ ডেকে এনে প্রতিবারই তার পশ্চাদ্দেশে ইচ্ছেমতো কশাঘাত করতে পারেন- সে কোনো দিন অভিমান করবে না কিংবা আপনার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। আপনার দেয়া কাঁটা-ঝুটার ব্যাপারে তার লোভ পরিত্যাগ করে সে সাধু সন্ন্যাসীর মতো নিরামিষভোজী হবে না। তার কোনো অপমানবোধ যেমন নেই, তেমনি সে কোনো মান-মর্যাদা, পদ-পদবি ইত্যাদির জন্যও লালায়িত নয়। সে এমনিতেই আপনার তাঁবেদারি করবে। বিড়ালের এই চরিত্র সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই ওয়াকিবহাল। আমরা একটি বিড়ালকে তখনই চরিত্রহীন আখ্যা দিতে পারি, যখন বিড়ালটি হঠাৎ বাঘের মতো ভাবসাব শুরু করে দেয়। সে যখন কাঁটা-ঝুটা বাদ দিয়ে পোলাও-কোর্মা, কালিয়া-কোপ্তা ইত্যাদি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং হঠাৎ তার মান-অপমানবোধ যদি গগনচুম্বী হয়ে পড়ে, তখন আপনি সেটিকে চরিত্রহীন বিড়াল আখ্যা দিয়ে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে পারেন।


জানোয়ারের চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে ইচ্ছে করলে আরো কিছু তথ্য, উপাত্ত, প্রশ্ন ইত্যাদি পর্যালোচনা করে নিতে পারেন। আপনি জানতে চাইতে পারেন- শিয়ালেরা কেন লুকিয়ে থাকে এবং সময় ও সুযোগ পেলে একসাথে ‘হুক্কাহুয়া-হুক্কাহুয়া’ রবে ডেকে ওঠে অথবা ভেড়ার পাল কেন এবং কিভাবে নেতাবিহীন অবস্থায় একত্রে থাকে। বন্য মহিষ, শূকর, কুকুর ইত্যাদি পশুর চলাফেরা, হাঁকডাক ও খানাখাদ্য নিয়েও আপনি কিছু ভাবতে পারেন যাতে হয়তো জানোয়ারের চরিত্র সম্পর্কে আরো বেশি ওয়াকিবহাল হতে পারেন। জানোয়ারের চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- তাদের মধ্যে সাধারণত ক্ষুধা, যৌনতাড়না এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণ ছাড়া অস্থিরতা, উত্তেজনা ও ভয় কাজ করে না। তাদের হৃদয়-মন বা চিত্ত মানুষের মতো নয়। হিংসাদ্বেষ, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা ইত্যাদি বদনামি দ্বারা জানোয়ারের চরিত্র কলুষিত হয় না। তারা কখনো সীমা অতিক্রম করে না এবং অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় না। জানোয়ারদের পোশাকের কোনো বালাই নেই এবং খানাখাদ্যের ব্যাপারে লবণ, মসলাপাতি বা সেদ্ধ করার কোনো দাবিনামা তারা কোনোকালে পেশ করে না।

জানোয়ারের চরিত্রের প্রণিধানযোগ্য লক্ষণীয় দিক হলো- তারা যে জানোয়ার, তা খুব সহজেই বোঝা যায়। মোনাফেকি, ভণ্ডামি, দালালি, চাটুকারিতা ইত্যাদি দিয়ে কোনো জানোয়ার আলাদা ফয়দা লোটার চেষ্টা করে না। বনের রাজা-বাদশাহ বলে পরিচিত জানোয়ারদের কোনো বডিগার্ড, আলাদা প্রাসাদ কিংবা সেনাবাহিনী নেই। নেই কোনো পুলিশ, চৌকিদার কিংবা অন্য কোনো পেশাধারী কর্মকর্তা-কর্মচারী। সাধারণ জানোয়ারেরা কৃতজ্ঞচিত্তে এবং সম্মানসহকারে তাদের রাজার কর্তৃত্ব মেনে নেয়। রাজার বিরুদ্ধে দুর্বলেরা যেমন অত্যাচারের অভিযোগ তোলে না- তেমনি রাজামশাইও কস্মিনকালে প্রজাদের ওপর জুলুম অত্যাচার চালায় না। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি ইত্যাদি অপরাধ জানোয়ার রাজ্যে কল্পনা করা যায় না। তেমনি মিথ্যাচার, দাম্ভিকতা, কূটকৌশল, ক্ষমতা লাভ বা ক্ষমতা হারানোর জটিল রসায়ন জানোয়ারদের রাজ্যে নেই। জানোয়ারদের এত্তসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বাইরে যদি আমরা কোনো ব্যতিক্রমী কিছু দেখি, তখন ধরে নেই যে, সেটির চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে।

আমরা এতক্ষণ জানোয়ারের যে চরিত্র নিয়ে আলোচনা করলাম, তা মোটামুটি বন্য জানোয়ার যারা সাধারণত স্বাধীন অবস্থায় বিচরণ করে, তাদের বেলায় প্রযোজ্য। প্রকৃতির অভয়ারণ্যে জানোয়ারের চরিত্রে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু তারা যখন মানুষের হাতে বন্দী হয়ে পড়ে অথবা পোষ মেনে যায়, তখন তারা চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। তাদের চরিত্রহীনতার বহুরূপ আছে। কিছু মানুষ ভয়ঙ্কর বাঘ-সিংহ, হায়েনা, গরিলা প্রভৃতি প্রাণীকে বশ করে ওগুলো দিয়ে সার্কাসের খেলাধুলা দেখাতে আরম্ভ করে দেয়। জানোয়ারগুলো মানুষের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে আপন চরিত্র বিসর্জন দিতে বাধ্য হয় এবং মানুষকে নিজেদের ভাগ্যবিধাতা বলে ভাবতে আরম্ভ করে। তারা মানুষের চাবুকের ভয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং পরে কথিত ভাগ্যবিধাতাদের মর্জি অনুসারে নেচে-গেয়ে, হেলে-দুলে, সেই সাথে ছলাকলা করে সার্কাসের দর্শকদের আনন্দ দিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়।

জানোয়ারেরা সবচেয়ে বেশি চরিত্রহীনতার শিকার হয় যখন তাদের পরিচয় ‘গৃহপালিত পশু’তে রূপান্তরিত হয়। গৃহকর্তার নির্দেশমতো কিংবা ইচ্ছেমতো জন্তু-জানোয়ারেরা সব কাজকর্ম করতে আরম্ভ করে। কিছু গৃহকর্তা তার পোষা বানর, ঘোড়া, গাধা ইত্যাদিকে মদ পান করিয়ে মাতাল বানিয়ে পশুগুলোর মধ্যকার পাশবিকতাকে বের করে আনে। তখন পশুদের নির্বুদ্ধিতা এবং পাগলামো একত্র হয়ে যে ভয়ঙ্কর রঙ্গলীলা শুরু হয়, তা দেখে গৃহকর্তা এক ধরনের পৈশাচিক তৃপ্তি লাভ করে। মানুষের মধ্যকার বিকৃত রুচি, পশুত্ব ও বন্যতাকে সে সরাসরি নিজে অভিনয় করে দেখাতে পারে না। ফলে নিজেদের প্রশিক্ষিত জন্তু-জানোয়ার দ্বারা তারা সেগুলো করিয়ে সমাজ-সংসার, হাট-বাজার, অলি-গলি ও রাজপথকে একধরনের নরক বানিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় সাধারণ জনগণ কোনো চিন্তাভাবনা না করেই জানোয়ারগুলোকে অভিসম্পাত করতে থাকে; অথচ একটিবারের জন্যও জানোয়ারের চরিত্রহীনতার নেপথ্যের কারণটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে না।

আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম, আদিকালে মানুষের জীবন ও জীবিকা জানোয়ারনির্ভর ছিল। তখনকার দিনগুলো জানোয়ার এবং মানুষ উভয় শ্রেণীর জন্যই নিরাপদ ছিল। মানুষ পশুকে ভালোবাসত এবং পশুর কর্মক্ষমতাকে সাধ্যমতো ব্যবহার করত ইতিবাচকভাবে। পশুর প্রজনন, লালন-পালন ও পরিচর্যার মধ্যে মানুষের আন্তরিকতা এত বেশি থাকত যে, অনেক পশু তার মনিবের জন্য নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে দিত। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া এবং হাতির অবদান মানবসভ্যতাকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রেখে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে। গরু, ছাগল, উট, ভেড়া প্রভৃতি প্রাণীর অবদানও কম নয়। পশুদের প্রভুভক্তি এবং বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড নিয়ে বহু গল্প-উপন্যাস লেখা এবং নাটক-সিনেমা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রভুভক্ত ঘোড়া ও কুকুরের বিশ্বস্ততা এবং মনিবের জন্য প্রাণ বিসর্জনের শত শত ঘটনা একসময় পৃথিবীর মাটিতে ঘটেছে। তখনকার দিনে মানুষ কখনো তার গৃহপালিত জন্তু-জানোয়ারের চরিত্রহানি ঘটাত না। ফলে পশুত্ব বা জানোয়ার চরিত্র মানুষ্য সমাজে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা ও মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

বর্তমানকালে আমাদের জানোয়ারনির্ভরতা বহুলাংশে কমে গেছে। আমাদের পরিবহন, যাতায়াত, কৃষিকাজ, যুদ্ধবিগ্রহ এবং নিরাপত্তার জন্য আমরা পশুদের পরিবর্তে যন্ত্রকে বেছে নিয়েছি। ফলে পশুরা কেবল ইদানীংকালে ভোগের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ভোগবাদী মানুষ পশুর তেল, চর্বি, মল-মূত্র, হাড়-মাংস, চামড়া, শিংয়ের ইত্যাদি এত বেশিমাত্রায় বাণিজ্যিক রূপ দিয়ে ফেলেছে, যা ক্ষেত্র বিশেষে লোক হাসানোর পাশাপাশি মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষ জন্তু-জানোয়ারের কৃত্রিম প্রজনন, মাংস ও দুগ্ধ উৎপাদন, পশম ও চামড়ার ব্যবহারে এমন সব অভিনব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে- যার ফলে আগামীতে হয়তো অনেক জন্তু-জানোয়ারের চরিত্র তো দূরের কথা, অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না। জানোয়ারদের নিয়ে মানুষের সবচেয়ে ভয়াবহ কথিত কর্মকাণ্ডটি হচ্ছে জানোয়ারকেন্দ্রিক রাজনীতি, সমাজসেবা এবং ধর্মকর্মের তাণ্ডব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কিছু জানোয়ারকে ‘মা’ বানিয়ে এমন ভক্তিশ্রদ্ধা আরম্ভ করেছে, যা দেখে তাদের গর্ভধারিণী জননীরা লোকালয় ছেড়ে অরণ্যে চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে একটি দল হরিণকে, কেউবা আবার মহিষকে বা বাঘ-সিংহকে দেবতা বানিয়ে বিরাট কর্মী সমর্থক দল সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আধুনিক সমাজের স্বার্থপর ও ধুরন্ধর প্রকৃতির কিছু লোক নিজেদের মধ্যে পাশবিকতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য হররোজ কুস্তি-কসরত চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বনের হিংস্র জানোয়ারের নির্মমতা নিয়ে অন্যের ধন-সম্পদ, মান-সম্মান এবং বিশ্বাস-ভালোবাসার পবিত্র স্থানগুলোতে হামলা চালায়। তারা নিরীহ লোকদের ওপর অত্যাচার করে। অসহায়দের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় এবং জ্ঞানী-গুণী ও সম্মানিত লোকদের বেইজ্জতি করে লোকালয় ত্যাগ করার জন্য ভয়ঙ্কর সব হাঁকডাক আরম্ভ করে দেয়। তারা মানুষের অধিকার হরণ করে এবং নির্বিচারে সবার মনে নিজেদের পাশবিকতার ও ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহ তাণ্ডবের ভয় ঢুকিয়ে দেয়। তারা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যন্ত্রের মধ্যে নিজেদের জানোয়ারসুলভ চরিত্রহীনতার বাস্তব রূপ ঘটাচ্ছে। কিছু মানুষরূপী প্রাণী চরিত্রহীন জানোয়ারের ভাবাদর্শের সফটওয়্যার বানিয়ে তা রোবট আকারে, অস্ত্র, গুলি-বোমা অথবা ক্ষেপণাস্ত্রের আকারে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়ে পুরো পৃথিবীকে শ্বাপদসংকুল অরণ্য বানিয়ে ফেলেছে।

আমরা সবাই জানি, জানোয়ারের কোনো সুনির্দিষ্ট ভাষা নেই। তারা নিজ নিজ স্বভাব ও চরিত্র অনুযায়ী ডাকাডাকি করে, যা দেখে আমরা বুঝতে পারি, কখন জানোয়ারটি ব্যথা পাচ্ছে কিংবা কান্না করছে অথবা রাগ ও ক্ষোভে গর্জন করছে। মানুষের সংস্পর্শে এসে অনেক জানোয়ার তার স্বভাবটিও নষ্ট করে ফেলে। তারা তাদের প্রভুর শেখানো বুলি আওড়ায় এবং স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে প্রভুর ইচ্ছায় হুমকি-ধমকি ও হাঁকডাক শুরু করে দেয়। আধুনিক সভ্যতার বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য পশুত্বকে যন্ত্রের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য নিজেদের গোত্রের মধ্য থেকে সুদক্ষ এজেন্ট, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক বানিয়ে নেয়। মানুষের মন-মানসিকতার এই পাশবিক বিবর্তনে আমাদের এই সুন্দর ধরণী দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিককালের যুদ্ধবিগ্রহ, হত্যাকাণ্ড, লুটপাট এবং হুমকি-ধমকির যে অপসংস্কৃতি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত চালু হয়েছে, তা মানবজাতির ইতিহাসে এতে নিমর্মতা নিয়ে কোনো কালে ছিল না। মানুষের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, পাষণ্ডতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা এবং গোঁয়ার-গোবিন্দের রণমূর্তির সাথে তুলনা করা যাবে, এমন কোনো জন্তু-জানোয়ার পৃথিবীর কোনো জঙ্গলে নেই। মানুষের তৈরি খোঁয়াড় কিংবা কারাগারে আটক হিংস্র জানোয়ারের চরিত্রহানি ঘটিয়েও সাম্প্রতিককালের দুনিয়ায় ঘটমান নিষ্ঠুরতা কোনো পশু দিয়ে ঘটানো সম্ভব নয়। মানুষের শয়ুতানি চিন্তা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং মানবমনের মধ্যে লুক্কায়িত চরিত্রহীন পশুত্বের বিকৃত রুচির নিষ্ঠুরতার অভিলাষ যখন ককটেল আকারে অন্য একটি মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তখন তা যেকোনো হিংস্র জানোয়ারের হিংস্রতা ও কুৎসিৎ জানোয়ারের কদর্যতার মাত্রা অতিক্রম করে পৃথিবীময় কৃত্রিম জানোয়ারের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলে জ্যামিতিক হারে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement