১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

উদ্বেগজনক বৈষম্যের দেশ বাংলাদেশ

উদ্বেগজনক বৈষম্যের দেশ বাংলাদেশ - ছবি : সংগ্রহ

বৈষম্য বলতে আমরা সাধারণত সম্পদের বৈষম্য তথা অর্থনৈতিক বৈষম্যকেই বুঝি। ইংরেজি ভাষায় এই পদবাচ্যটি পরিচিত ইনইকুয়ালিটি বা ইকোনমিক ইনইকুয়ালিটি নামে। অতএব, এই বৈষম্য বা ইনইকুয়ালিটি হচ্ছে একটি ইকোনমিক ফেনোমেনন তথা অর্থনীতিসংক্রান্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় বা প্রপঞ্চ। সম্পদের সমবণ্টন হচ্ছে এর সমাধান। আমরা বরাবর এই বৈষম্য অবসানের কথা বলে আসছি। শুধু বলে আসছি না, তা অবসানে সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতিও ঘোষণা করে আসছি। কিন্তু এর পরও অর্থনীতিতে এই বৈষম্যের অস্তিত্ব গোটা মানবজাতির ইতিহাসজুড়ে অবিচ্ছেদ্য বিষয় হয়েই রয়েছে। তবে এই বৈষম্য শুধু সম্পদের মধ্যেই সীমিত নয়, এটি ছড়িয়ে পড়েছে সুযোগ ও অধিকারের ক্ষেত্রেও। এই বৈষম্যবিরোধী যুক্তির পাশাপাশি আছে বৈষম্যকে যৌক্তিক করে তোলার নানা ধরনের যুক্তির অস্তিত্বও, যা আমরা লক্ষ করেছি নানা সময়ে নানাভাবে।

এ ক্ষেত্রে কেউ সামনে নিয়ে এসেছেন মেরিটোক্র্যাসিকে কার্যকর রাখার জন্য অভিজাতদের ঐশ্বরিক অধিকার বা ডিভাইন রাইটকে। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, মানবজাতি সম্পদের পরিপূর্ণ সমবণ্টনের পদক্ষেপ নিয়েছে, ইতিহাসে তেমনটি পরিলক্ষিত হয়নি- এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। আজকের দিনের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে আমরা শুনি সমাজে সার্বজনীন সমসুযোগ সৃষ্টির নানা উদ্যোগের কথা।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনা সমাজের জন্য কল্যাণকর। বিপরীতক্রমে কেউ কেউ আগ্রহী নন সম্পদের পুনর্বণ্টন নীতির প্রতি। এই নীতিও অর্থনীতিতে এটি বিতর্ক হয়েই রয়েছে। জানি না, এ কারণেই কি না, বিশ্বসমাজ থেকে বৈষম্য বিদায় নিচ্ছে না। বরং বৈষম্য যেন আরো জেঁকে বসছে। সেই সাথে কোথাও কোথাও এই বৈষম্য ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ দেশে সার্বিক বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, এমন খবর চার দিক থেকেই আসছে। যেহেতু এই বৈষম্য ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে, সেহেতু শুধু দেশবিশেষ নয়, বিশ্বব্যাপী বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আসছে, তা থেকে সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশে বৈষম্য উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে। সম্প্রতি অক্সফাম প্রণীত ‘কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটি ইনডেক্স’-এ দেখা গেছে- বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে হলেও ধনী-গরিবের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। ‘কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিট ইনডেক্স (আরটিআই ইনডেক্স) বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র ভুটানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে আছে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও ভারতের তুলনায়। এই সূচকের সার্বিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম, মালদ্বীপ ৬৮তম, শ্রীলঙ্কা ১০২তম, আফগানিস্তান ১২৭তম, পাকিস্তান ১৩৭তম, নেপাল ১৩৯তম, ভারত বাংলাদেশর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে ১৪৭তম এবং ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে চার ধাপ পিছিয়ে ১৫২তম। সূচকের অবস্থান তালিকায় সবচেয়ে নিচে যে ১০টি দেশ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- ১৫৭ দেশের মধ্যে ১৪৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ, ১৪৯তম সিঙ্গাপুর, ১৫০তম লাও পিডিআর, ১৫১তম মাদাগাস্কার, ১৫২তম ভুটান, ১৫৩তম সিয়েরা লিওন, ১৫৪তম চাদ, ১৫৫তম হাইতি, ১৫৬তম উজবেকিস্তান এবং ১৫৭তম নাইজেরিয়া।

এ সূচকটি তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি ইন্ডিকেটর বা নির্দেশকের নতুন ডাটাবেজের ওপর ভিত্তি করে। এতে পরিমাপ করা হয়েছে সামাজিক ব্যয়, কর ও শ্রম অধিকার এবং মজুরির ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপের বিষয়াবলি। সম্পদে বৈষম্য কামানোর ক্ষেত্রে এ তিনটি ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার খাতে বাংলাদেশের ব্যয়নির্দেশক বিবেচনায় আমাদের অবস্থান ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম স্থানে। করনীতির অগ্রগতির নির্দেশক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩তম স্থানে। আর শ্রম-অধিকার ও মজুরির নির্দেশকে বাংলাদেশ ১৪৮তম, অর্থাৎ এর সার্বিক সূচকের সম-অবস্থানে। এ তিনটি নির্দেশক যৌথভাবে প্রণয়ন করেছে অক্সফাম ও ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল (ডিএফআই)।

অক্সফামের এই সূচক তৈরির ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে দ্বিতীয় সংস্করণ। এই সূচকে দেখা গেছে- দক্ষিণ কোরিয়া, নামিবিয়া ও উরুগুয়ের মতো দেশ সম্পদের বৈষম্য অবসানে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে ভারত ও নাইজেরিয়া সার্বিকভাবে এ ক্ষেত্রে খুবই খারাপ করেছে। একইভাবে ধনী দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, দেশটিতে বৈষম্য কমানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতির ঘাটতি রয়েছে।

এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী তিন দশকে বিশ্বের অনেক দেশে সবচয়ে ধনী ও সমাজের অন্যদের মধ্যে বৈষম্যের মাত্রা দ্রুত বাড়বে। ক্রমবর্ধমান এই সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থতার কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গতি কমবে গরিবতা অবসানের লড়াইয়ে। অক্সফামের গবেষণায় দেখা গেছে- নতুন শতাব্দী শুরুর পর থেকে বিশ্বে যে সম্পদ বেড়েছে, তার মাত্র ১ শতাংশ পেয়েছে সবচেয়ে গরিব অর্ধাংশ জনগোষ্ঠী। আর সবচেয়ে বেশি ধনী ১ শতাংশ গোষ্ঠী পেয়েছে বর্ধিত সম্পদের ৫০ শতাংশ। প্রতিবেদন মতে, বৈষম্য-সঙ্কট অপরিহার্য নয়, সরকারগুলো এর বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীন নয়। বৈষম্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণের বিষয় এবং এ বছর অক্সফামের গবেষণায় স্পষ্টত এ বিষয়টি দেখা গেছে। গোটা বিশ্বে সরকারগুলো জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামে।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, করের সাযুজ্যকরণও এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আরো কিছু দেশে দেখা গেছে করদাতার সংখ্যা খুবই কম। করের ভিত্তি সম্প্রসারণের পরিবর্তে কোম্পানি ও ব্যক্তির ওপর করের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। দেশগুলোর প্রবণতা হচ্ছে, ভ্যাটে ও অন্যান্য অপ্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল হওয়া। অনেক দেশ জেন্ডার-সেন্সেটিভ ট্যাক্সেশনের সমস্যাটি দূর করা হয়নি। ফলে অনেক নারীর ওপর অন্যায্যভাবে কর আরোপ করা হয়। তাদের জন্য শুধু ন্যায্যতাভিত্তিক করারোপ নয়, পাশাপাশি এদের জন্য প্রয়োজন আরো সরকারি তহবিল সেবার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি ভালো পদক্ষেপ হচ্ছে, আয়বৈষম্যের কথা বিবেচনা করে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী নারীদের জন্য আয়কর অব্যাহতি। দেশটিতে রয়েছে সর্বনি¤œ মজুরির ক্ষেত্রে ব্যাপক বিভিন্নতা।

সুইজারল্যান্ড ও মিসরের মতো কম স্কোরের কিছু দেশ পরিচিত তাদের দুর্বল শ্রম আইন ও শ্রম-অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে। অপর দিকে বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ ‘পুওর লেভার প্র্যাকটিসে’র কারণে বৈষম্য বাড়ছে। উদাহরণত, বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের নি¤œতম মাসিক মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। এই মজুরির মাত্রা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে এরা বসবাস করে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে। কিন্তু বাংলাদেশে অন্যান্য খাতের শ্রমিকরা মাসে আরো কম টাকা পাওয়ার অধিকারী।

অক্সফাম প্রতিবেদনে সুপারিশ রাখা হয়েছে- সব দেশকে তাদের বৈষম্য অবসানে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে প্রতিটি দেশ বৈষম্য অবসানে ১০টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। এই পরিকল্পনায় থাকতে হবে, সরকারি খরচে বিনামূল্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এবং সার্বজনীন সুরক্ষা ফ্লোর।

বাংলাদেশে যে সম্পদের বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, তা আঁচ করা যায় সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে। রিপোর্ট মতে, একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর ফলে এই বৈষম্য আরো বাড়ছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে অতি ধনীর উত্থানে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। অর্থাৎ, অতি ধনী বা ধনকুবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭০টি বড় অর্থনীতির দেশের হারের চেয়ে বেশি। ‘ওয়েলথ-এক্স’ নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, এটি অবাক করা বিষয় যে- ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে চীন বিশ্বের ১ নম্বর নয়। ১ নম্বর অবস্থান বাংলাদেশের। ‘ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা-ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ নামের এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত ৫ সেপ্টেম্বর। এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের অতি ধনীদের সংখ্যা বেড়ে চলার চিত্র তুলে ধরা হয়। ওয়েলথ-এক্সের দাবি, তাদের তথ্যভাণ্ডারে এক লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ধনকুবেরের তথ্য রয়েছে। তিন কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ থাকলে তাদের আল্ট্রা-ওয়েলদি বা অতি ধনী বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশে বৈষম্য বেড়ে চলেছে এবং তা বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে- উল্লিখিত রিপোর্র্ট দু’টি এ বিষয়টি নিশ্চিত করে। সমাজবাদীদের অভিযোগ, এই বৈষম্যের পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। অনেকেই বাংলাদেশের এই বৈষম্যের জন্য দায়ী করেন বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে। তারা হয়তো সমাজবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থনে এ ধরনের অভিযোগ করে থাকেন। তাদের এই দাবি নিয়ে বিতর্ক থাকার অবকাশ থাকতে পারে। তবে এ কথা আংশিক সত্য, আমাদের বতর্মান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বৈষম্য অবসানের সহায়ক নয়। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব রয়েছে। যার ফলে এই ব্যবস্থায় দেশে একটি লুটেরাগোষ্ঠী সৃষ্টি হয় সহজে। সে দিক বিবেচনায় সমাজবাদীদের এ দাবি আমলে না নেয়ার কোনো অবকাশ নেই।

এ দিকে সর্বশেষ ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’র মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানতে পেরেছে, বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয়ের পরিমাণ মোট আয়ের মাত্র ০.২৩ শতাংশ। ২০১০ সালে এই হার ছিল ০.৭৮ শতাংশ। অপর দিকে, আমাদের জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি ধনী ৫ শতাংশের আয়ের পরিমাণ এই সময়ের মধ্যে আমাদের মোট আয়ের ২৪.৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭.৮৯ শতাংশে। এই পরিসংখ্যান মূলত নির্দেশ করে, সবচেয়ে গরিব জনগোষ্ঠীর আয় ক্রমাগত কমেছে। অপর দিকে সবচেয়ে বেশি ধনীদের আয় ক্রমাগত বাড়ছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রধানত আলোকপাত করেছে আয়বৈষম্যের ওপর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সম্পদের বৈষম্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) দেয়া তথ্য মতে, গিনি কোএফিশিয়েন্ট বিবেচনায় সম্পদ-বৈষম্যের উদ্বেগজনক পরিমাণ ০.৭৪, যেখানে আয়ের বৈষম্যের বেলায় এই গিনি কোএফিশিয়েন্ট হচ্ছে ০.৪৮। উল্লেখ্য, গিনি কোএফিশিয়েন্ট হচ্ছে ০ থেকে ১ পর্যন্ত আয়বৈষম্য ও সম্পদ-বৈষম্য পরিমাপের একটি অর্থনৈতিক পদবাচ্য, যেখানে ১ নির্দেশ করে পরিপূর্ণ বৈষম্য এবং ০ নির্দেশ করে পরিপূর্ণ সমতা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ ক্ষেত্রে কোএফিশিয়েন্টের বিদ্যমান ডাটা উদ্বেগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। প্রকৃত বৈষম্য আরো খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ, আমাদের সমাজের সবচেয়ে বেশি ধনীরা তাদের প্রকৃত আয় ও সম্পদের পরিমাণ প্রকাশ করতে নারাজ।

ঢাকায় বিগত মেয়র নির্বাচনে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর দু’জনই বিজনেস টাইকুন হিসেবে পরিচিত। এরা তাদের ব্যবহারের দামি গাড়িকে তাদের সম্পদের বিবরণে অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেন। তাদের অভিমত, এসব গাড়ির মালিক তাদের কোম্পানি। তা সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে এসব গাড়ির মালিক এরা ছাড়া আর কেউ নন। তারা বোঝাতে চান, তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ এবং কোম্পানির সম্পদ আলাদা। যদিও এটি খুবই স্পষ্ট, উভয় সম্পদই কমবেশি একই মালিকানাধীন সম্পদ। এসব কারণে অনেক সম্পদশালী ব্যবসায়ীকেও সেরা করদাতাদের তালিকায় পাওয়া যায় না। গত বছর যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি কর দিয়েছেন, তিনি একটি তামাক কোম্পানির মালিক। এখানে কৌশলী বিষয়টি হচ্ছে, অনেক অতি ধনী তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির জন্য ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেন। যখন আপনি দেখাবেন, আপনার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল এসেছে ঋণের টাকা থেকে, তখন আপনি করদাতাদের তালিকায় না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া, ধনীদের ওপর কর আরোপ না করার একটি প্রবণতা কাজ করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে। সময়ের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান হারে চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে; তখন এই প্রবণতা আরো বাড়বে বলেই ধরে নেয়া যায়।

পাশ্চাত্যে দেখা যায়, নি¤œতম মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি একটি জনপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি বা বিরোধী কোনো বড় রাজনৈতিক দলকেই তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নি¤œতম বেতন বাড়ানোর পক্ষে পাওয়া যায় না। আসলে কোনো দলই চায় না তাদের রাজনৈতিক দাতাদের বিরক্ত করতে। অপর দিকে অতি ধনীদের ওপর করারোপ করার পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার প্রণোদনা দেয়ার নামে কার্যত ধনীদের করের পরিমাণ কমানোর অপ্রত্যক্ষ দাবি পূরণেই আগ্রহী। যখন শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নামেন তখন সরকার শিল্পমালিকদের সমর্থনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামিয়ে শ্রমিকদের কণ্ঠ রোধ করে।

আমাদের অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্য হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির ৪৫-৬৫ শতাংশ সম্পদ করের আওতার বাইরে। কারণ, অতি ধনীদের কর দেয়া এড়ানোর জন্য রয়েছে নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুযোগ। সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগই আসে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে, যেমন ভ্যাট থেকে। এই অপ্রত্যক্ষ কর আরোপ করা হয় সব মানুষের ওপর, তার আয় কত তা বিবেচনা না করেই। যারা গরিব তারা তাদের বৃহত্তর অংশ ব্যয় করে এ ধরনের অপ্রত্যক্ষ করের পেছনে। অপর দিকে ধনীরা তাদের আয়ের একটি ক্ষুদ্রাংশ এ খাতে ব্যয় করে।

অতএব আমরা বলতে পারি, আমাদের যে করনীতি তা আসলে কাজ করছে দেশে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তোলার পেছনে। অথচ অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, করনীতির মুখ্য দর্শন হচ্ছে সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনা। আমাদের ভুল করনীতির কারণে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি ধনীদের করের আওতায় আনতে। আর এই নেতিবাচক প্রভাবে সমাজে বাড়ছে বৈষম্য। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের এই বৈষম্য আজ উদ্বেগজনক পর্যায়ে। এর পরও থামছে না এই প্রবণতা। এই প্রবণতা সূত্রেই আমরা দেখছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের চোখের সামনে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন বাবদ নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। দুর্নীতি বৈষম্য বাড়ানোর অন্যতম উপসর্গ হলেও ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দেশে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। একে একে লুট হচ্ছে আমাদের ব্যাংকগুলো। এগুলো সবই দেশ ও সমাজে বৈষম্য বাড়ানোর সহায়ক উপাদান। অতএব, দেশের বৈষম্য-পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না; যদি না আমরা বৈষম্য বাড়িয়ে তোলার দুষ্ট প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই আন্তরিক কোনো পদক্ষেপ নিয়ে।


আরো সংবাদ



premium cement
নাভালনির মৃত্যু : ৩০ রুশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ইইউর সালাম মুর্শেদীকে গুলশানের বাড়ি ছাড়তে হাইকোর্টের নির্দেশ গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্যে মিসর ও সৌদি আরব যাচ্ছেন ব্লিঙ্কেন আমাকে অ্যাপ্রোচ করেছিল, আমি গ্রহণ করিনি : মেজর অব. হাফিজ জাতিসঙ্ঘ সংস্থার প্রধানকে গাজায় প্রবেশে বাধা ইসরাইলের মিয়ানমারে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার খবরে ‘শঙ্কিত’ জাতিসঙ্ঘ প্রধান ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ২৩ হলমার্ক কেলেঙ্কারি : তানভীর-জেসমিনসহ ৯ জনের যাবজ্জীবন লক্ষ্মীপুরে উপড়ে ফেলা হয়েছে যুবলীগ নেতার চোখ ঝড়-বৃষ্টির আভাস, কমবে তাপমাত্রা ফ্রান্সে কমিউনিটি মসজিদের ইফতার মাহফিল

সকল