২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাংবাদিক মহল যথার্থ কারণেই উদ্বিগ্ন

সাংবাদিক মহল যথার্থ কারণেই উদ্বিগ্ন - ছবি : সংগৃহীত

পেছন ফিরে তাকালে আওয়ামী লীগ নামের দলটির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যখনই দলটি ক্ষমতায় এসেছে তখনই জনমত উপেক্ষা করে এমন কিছু আইন পাস করেছে, কিংবা আইনের সংশোধন করেছে, এমনকি সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করেছে, যার লক্ষ্য শুধু বিরোধী জনমত অবদমনের পথ প্রশস্ত করে নিজেদের ক্ষমতাকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করানো। এসব আইন পাসের প্রতি জনগণের বা সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর সায় আছে কিনা, সে ব্যাপারে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করে না এই দল। এই প্রবণতাসূত্রে দলটি বিভিন্ন সময়ে সরকারে থাকাকালে নানা জনবিরোধী আইন পাস করেছে, আইনের সংশোধন কিংবা সংবিধান সংশোধন করার অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে বিকল্প থাকা সত্ত্বেও জনমত উপেক্ষা করে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেয়া ছিল তেমনি একটি উদাহরণ। আর এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে সুশীলসমাজ, মানবাধিকারকর্মী, বিবেকবান মানুষ, সাংবাদিকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের মতামত উপেক্ষা করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

এই আইনটি পাসের কয়েক দিন আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের প্ল্যাটফরম ‘সম্পাদক পরিষদ’ এই আইনের চূড়ান্ত খসড়া সম্পর্কে বিস্ময়, হতাশা ও মর্মাহত হওয়ার কথা প্রকাশ করে বলেছিল- প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের খসড়াটি সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সাংবাদিক সমাজ এটি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছে। সম্পাদক পরিষদ তখন এর বিবৃতিতে উল্লেখ করে- আইনের চূড়ান্ত খসড়া দেখে আমরা বিস্মত, হতাশ ও মর্মাহত। তখন দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় সংসদকে এই আইন পাস না করার আহবান জানানো হয়। এর আগে রাজধানীতে বৈঠক করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ২০টি পত্রিকার সম্পাদক।

তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়- এর আগে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা হলেও এই আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আইনের প্রস্তাবিত খসড়া মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এই আইনে ঔপনিবেশিক যুগের মতো অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের বিষয়টি যুক্ত করায় আমরা উদ্বিগ্ন। এটি স্পষ্টভাবে তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়- এ আইন নিয়ে এর আগে আইনমন্ত্রী ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রীর সাথে ধারাবাহিকভাবে সম্পাদক পরিষদের নেতাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে দুই মন্ত্রীই উদ্বেগের বিষয়টি আমলে নিয়ে তা পুনর্বিবেচনার জন্য আশ্বাস দিয়েছিলেন। সম্পাদক পরিষদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে- এই চূড়ান্ত খসড়া সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

আইনটি পাস হওয়ার পর সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম গণমাধ্যমে দেয়া তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন : স্বাধীন সাংবাদিকতা, মত প্রকাশ ও গণতন্ত্রের জন্য এই আইন পাসের দিনটি একটি ‘দুঃখজনক দিন’। এই আইন ডিজিটাল যুগের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই আইনের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলবে।’

এদিকে আইন পাসের পর সম্পাদক পরিষদ গত ২৯ সেপ্টেম্বর এর প্রতিবাদে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ডাক দেয়। এ প্রেক্ষাপটে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্পাদক পরিষদের ডাকা এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনামের কাছে গত ২৬ সেপ্টেম্বর একটি চিঠি দিয়েছেন। একই সাথে জরুরি বৈঠকে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ ও বিবৃতি তথ্য মন্ত্রণালয় গভীর মনোযোগের সাথে গ্রহণ করেছে। চিঠিতে বলা হয়, সংবাদপত্রসহ সব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্য অধিকারের প্রতি সরকারের আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধা সমুন্নত রেখে বিষয়টির দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের লক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদের সাথে বৈঠক একান্ত প্রয়োজন। চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর রোববার দুপুর ১২টায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অথবা সম্পাদক পরিষদের সুবিধাজনক তারিখ, সময় ও স্থানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আইসিটিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও তথ্যমন্ত্রী নিজে এই বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহী।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে আইনমন্ত্রী, আইসিটিমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর সাথে সম্পাদক পরিষদের ওঠাবসা আইনটি পাসের আগে কম হয়নি। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সাথেও সম্পাদক পরিষদের বৈঠক হয়েছে। তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা ও সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সম্পাদক পরিষদকে বারবার তাদের দাবি-দাওয়া ও উদ্বেগের বিষয়টি সুরাহার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এরপরও তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো সুরাহা না করে কেন তড়িঘড়ি করে এই আইনটি এভাবে সংসদে পাস করিয়ে নেয়া হলো। আর কেনোইবা আইনটি পাস করে নেয়ার পর এখন তথ্যমন্ত্রী চিঠি দিয়ে সম্পাদক পরিষদের সাথে বৈঠক করার অনুরোধ জানালেন। তা ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সম্পাদক পরিষদের চেয়ে বেশি সংক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও। নাগরিক সাধারণের রয়েছে এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ। এই উদ্বেগের কথা উচ্চারিত হয় সুশীলসমাজের পক্ষ থেকেও। অতএব সম্পাদক পরিষদের সাথে বৈঠক করে শুধু সাংবাদিক মহলের উদ্বেগের বিষয়গুলো সুরাহা করলেই এই আইন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার অবসান হয়ে যাবে, তেমনটি ভাবা ঠিক হবে না। আইনটি নিয়ে সামগ্রিক জটিলতার অবসান দরকার।

সে যা-ই হোক তথ্যমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ২৯ সেপ্টেম্বরের মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করে সম্পাদক পরিষদের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সে বৈঠকও হয়েছে। এ বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, সম্পাদকদের আপত্তির বিষয়টি তিনি মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করবেন। সম্পাদক পরিষদ বলছে, তারা পুরো আইনটি বাতিল চান না, এর কিছু ধারার সংশোধন চান। সম্পাদকদের এই সংগঠনটি এই বৈঠকের আগে এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করে বলেÑ আলোচনার মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধকারী ধারাগুলো অপসারণ করা হবে। আর সেটি না হলে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের সব অংশীজনই মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক আঘাত। আইনটি পাসের আগেও এই উদ্বেগের কথা সরকারকে জানানো হয়েছিল। এমনকি সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও অন্যান্য অংশীজনের সাথে সম্পাদক পরিষদ আইনের কয়েকটি ধারা সম্পর্কে তাদের সুনির্দিষ্ট আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরাও আইনটি এভাবে পাস না করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সব বিরোধিতা ও আপত্তি উপেক্ষা করে সরকার কণ্ঠভোটে যেভাবে আইনটি পাস করে, তা সংবাদমাধ্যমের জন্য দুঃখজনক ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এ অবস্থায় রাজপথে প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই সম্পাদক পরিষদ ২৯ সেপ্টেম্বরের মানববন্ধন কর্মসূচি দেয়।’

এদিকে কেন সম্পাদক পরিষদ এই ডিজিটাল অনিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই পরিষদের পক্ষ থেকে দেশের বেশির ভাগ জাতীয় দৈনিকে গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর তুলে ধরেছে। অনেকেই তাদের এই ব্যাখ্যা সংবাদপত্র মারফত জানতে পেরেছেন। তাদের দেয়া এই ব্যাখ্যা যে যথার্থ যৌক্তিক তা সহজেই অনুমেয়। স্থানাভাবে তাদের এই বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই লেখায় তুলে ধরার কোনো সুযোগ নেই। তবে তাদের বক্তব্যের চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।

সম্পাদক পরিষদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ মতে- ‘ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার ও কম্পিউটারর নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফরম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করেছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করবে।’

সম্পাদক পরিষদ আরো বলেছে- ‘২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি আইন) প্রণীত হওয়ার সময় সরকার বলেছিল- সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, আইসিটি আইন করা হয়েছে সাইবার অপরাধ ঠেকানো ও সাইবার অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে। বাস্তবতা হলো, সাংবাদিকসহ অন্য যারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে গেছেন, তারা আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় কারাভোগ করেছেন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এখনো একইভাবে বলা হচ্ছে, সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি। কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, এই আইনেও সাংবাদিকেরা আবার একই ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হবেন। আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এ আইনের উদ্দেশ্য, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সঙ্ঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন ও বিচার করা।’ তাই এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর সংজ্ঞায়িত পরিধি অনেকদূর ছাড়িয়ে গিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার পরিধির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রকৃতির পরিপন্থী এবং তা অনুশীলনের প্রতিকূল, কারণ সাংবাদিকেরা জনগণের জানার অধিকার সুরক্ষা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি জনসমক্ষে উন্মোচন করে। এই আইনের অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কিত প্রায় ২০টি ধারার ১৪টিই জামিনের অযোগ্য, পাঁচটি জামিনের যোগ্য ও একটি সমঝোতা সাপেক্ষ।’
সাংবাদিক পরিষদ এই আইনের বেশ কয়েকটি ধারাকে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে করে। পরিষদ কেন এই ধারাগুলোকে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে করে, তার ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। এসব ধারাগুলো হচ্ছে, ধারা ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ৩২, ৪৩ এবং ধারা ৫৩। এই ধারাগুলোর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাসহ এগুলোর ব্যাপারে তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্যও তুলে ধরেছেন। আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে তা গতকালের দৈনিক নয়া দিগন্তে দেখে নিতে পারেন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, এর বাইরেও বিভিন্ন মহলের রয়েছে এই আইন নিয়ে গভীর উদ্বেগ। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র হচ্ছে তথ্য পাওয়ার অধিকার। গত শুক্রবার ছিল তথ্য অধিকার দিবস। আলোচ্য আইনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আবার সামনে আনায় তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ অনুযায়ী তথ্য পাওয়া এবং এর প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টটি যুক্ত করায় এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন মহলে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী নেতারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করে তথ্য পাওয়ার যে অধিকার দেয়া হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তা কার্যত হরণ করা হলো। তথ্য পাওয়ার অধিকার, তথ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও তথ্যের গোপনীয়তা- এই তিনটি বিষয় সাংবাদিকদের একটি বৃত্তে আটকে ফেলেছে। হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এমনকি মত প্রকাশের স্বাধীনতাও বাধার মুখে পড়বে। আর প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা আরো সীমিত হয়ে পড়বে। এই আইনের কিছু ধারা গণমাধ্যম, মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতাকে গিলে ফেলতে পারে।

রাইট টু ইনফরমেশন ফোরাম (আরটিএফ) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ এই আইনের কিছু বিধানকে ‘রাইট টু ইনফরমেন (আরটিআই) অ্যাক্ট ২০০৯’-এর বিধানের ওপর অযৌক্তিক অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এই ফোরাম মনে করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর বর্তমান আকারে থাকলে তা ব্যাপকভাবে আরটিআই আইনে জনগণকে দেয়া তথ্যে প্রবেশাধিকার ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। আরটিআই আইনে দেয়া তথ্যাধিকার সরকারের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার যে সুযোগ রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সে সুযোগ বিনষ্ট করে দেবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ সংসদে পাস হওয়ার পর আরটিআই ফোরাম এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে- এই ফোরামের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- ১৯২১ সালের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের কিছু বিধান সরাসরি তথ্য অধিকার আইনের পরিপন্থী। তথ্য অধিকার আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা আছে- তথ্যপ্রদানে বাধা সৃষ্টিকারী অথবা তথ্য অধিকার আইনের কোনো বিধানের সাথে অন্য কোনো আইনের বিধানের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেকোনো আইনের ঊর্ধ্বে বলে বিবেচিত হবে তথ্য অধিকার আইন । ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আরটিআই আইনের অংশবিশেষের সাথে সাংঘর্ষিক।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ এই আইন মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। আমাদের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘৩৯ : (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে- (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।’

যেখানে এই আইনটি সংবিধান স্বীকৃত মানুষের চিন্তাও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যায়, তাই বললে ভুল হবে না, এই আইনটি স্বাধীনতার চেতনারও বিরোধী। অতএব এর সংবিধানবিরোধী ধারাগুলো অবশ্যই সংশোধন করা দরকার।

 


আরো সংবাদ



premium cement