১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হেলমেট বাহিনীর কথা যে বললেন না

হেলমেট বাহিনীর কথা যে বললেন না - ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নিজ কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় দারুণ হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি ও তাদের দোসরদের মূল টার্গেট আওয়ামী লীগ নয়, তাদের টার্গেট শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিতে পারলে তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আর ২০১৮ সাল এক নয়।

শেখ হাসিনার কিছু হলে সারা দেশে আগুন জ্বলবে। তিনি সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তিতে মোকাবেলায় জনগণকে সাথে নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের সাড়া না পেয়ে বিএনপি ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। দেশ অচল করার হুমকি দিয়েছে। তাহলে আমরা কি ঘরে বসে ডুগডুগি বাজাব। যুবলীগ নেতাকর্মীরা প্রস্তুত হয়ে যান। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের অচল করে দেব। আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিজয়ী করব। আর এটাই প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে আমাদের শপথ।

তার আগের দিন একই ডুগডুগি তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে অশুভ শক্তির পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এবং তার দোষররা নাশকতা আর সহিংতার ছক আঁটছে। সহিংসতার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা যেভাবে হাকডাক হুমকি ধমকি শুরু করেছে। সেভাবে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বলে আমরা মনে করি। তিনি বলেন, বিএনপির সভাটা কবে হবে এটা তো এখনো তারিখ ঠিক হয়নি। বিএনপি জোর করে ২৯ তারিখ সভা করবে কেন এই জেদাজেদি। অনুমোদন ছাড়া আপনি সভা করবেন? এত লাফালাফি কেন? কাদের বলেন, দশ বছরে দশ মিনিটও রাস্তায় নামতে পারেনি। এখন আপনি হঠাৎ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে খুশি করতে ব্যর্থতা ঢাকার জন্য লাফালাফি করছেন। এত লাফালাফির পরিণাম শুভ হবে না। হুমকি ধমকি দিয়ে আন্দোলন করবেন। আমরা ঘরে বসে ডুগডুগি বাজাব তা হবে না। অথচ এই কাদেরই কয়েক দিন আগে আমাদের জানান দিয়েছিলেন যে, সোহরাওয়ার্দীতে সভা করতে এখন থেকে আর কোনো অনুমোদন লাগবে না। তা হলে এখন অনুমোদনের প্রশ্ন তুলছেন কেন?

আবার জাতীয় ঐক্যকে টিটকারি দিয়ে তিনি বলেছেন, এটি আসলে জাতীয় ঐক্য নয়, জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক ঐক্য। জনতা নয়, নেতায় নেতায় ঐক্য। তিনি বলেন, ২০ দলের সাথে ১০ দলের ঐক্য এখনো নড়বড়ে। কারণ বিএনপি তাদের মূল পার্টনার সাম্প্রদায়িক জামায়াতকে ছাড়া এক পাও এগোতে পারবে না। সে অবস্থায় যুক্তফ্রন্ট এ প্রক্রিয়ায় শর্ত দিয়েছে যে, জামায়াত যদি বিএনপির সাথে আন্দোলনে থাকে তাহলে ঐক্য করে সরকার পতনের আন্দোলন সূচনা করতে পারবে না। এই পাঁচমিশালী জগাখিচুড়ির ঐক্যের কোনো ভবিষ্যৎ আছে বলে আমরা মনে করি না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা সরকারি দল আমাদের ভরা কলসি নড়ে না। যাদের শূন্য কলসি তারাই ফাঁকা আওয়াজ করে। আমাদের উত্তেজিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা কারো উসকানির ফাঁদে পা দেবো না। দেশের মানুষ খুশি যে দেশে নির্বাচন হবে। পরিবেশটা শান্তিপূর্ণ থাকবে এটিই আমি চাই। দেশের অর্ধেক অংশে নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এ সময় আমরা কেন সংঘাত করব? আমরা ক্ষমতায় আছি। আমরা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি করব না। আমাদের কর্মসূচি আমরা দেবো। কারো কোনো পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আমরা দেবো না। দেশের মানুষকে আতঙ্কে রেখে এ ধরনের রাজনীতি আমাদের প্রয়োজন নেই। নির্বাচন পর্যন্ত পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে হবে।

দলের কর্মসূচি বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, পয়লা অক্টোবর থেকে সপ্তাহব্যাপী রাজধানীসহ সারা দেশে গণসংযোগ করবে আওয়ামী লীগ। আমরা ভোটারদের কাছে যাবো, বাড়িতে বাড়িতে যাবো, জনসংযোগ করব। আমরা রাস্তা অবরোধ করলে মানুষের জন্য দুর্ভোগ হবে। এমন কোনো সভা সমাবেশ করব না। আর রাস্তা অবরোধ করে কাউকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। অন্য কেউ নিয়ম ভঙ্গ করে রাস্তায়, প্রেস ক্লাবের সামনে ও পল্টনের রাস্তায় সভা-সমাবেশ করবে সেটা অ্যালাও করা হবে না। জনগণের দুর্ভোগ কিছুতেই হতে দেবো না।

এ দুদিনের বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের অনেক প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। প্রথম প্রশ্ন হলো ‘সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তিকে মোকাবেলায় জনগণকে সাথে নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে প্রস্তুত হতে’ তার আহ্বান। কী করবে এরা প্রস্তুত হবে? আর সাম্প্রদায়িক শক্তি কোথায়? কখনো বলে জগাখিচুড়ির ঐক্য, কখনো বলে এ ঐক্যের কোনো ফায়দা হবে না, কখনো বলে এ ঐক্য টিকবে না। নাই যদি টিকে তাহলে এত আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে। শুরুতে তো আমরা দেখেছিলাম। এই ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। গত ৩০ মে ভারত সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী। এরপর নেপালে বিমসটেক সম্মেলন থেকে ফিরে ২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান। সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকে ঐক্য প্রক্রিয়াকে আরেকবার স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী। ওই দিন তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি প্লাটফর্ম থাকা দরকার। তিনি বিরোধীদের জন্য সভা-সমাবেশ করতে স্থায়ী মঞ্চ করে দেয়ার কথাও বলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান মান্নার যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগের নেতারা ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে খুব একটা সমালোচনামুখর ছিলেন না। সম্ভবত তারা এই প্রক্রিয়াকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি।

কিন্তু গত ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চের ঐক্য প্রক্রিয়ার ডাকে নাগরিক সমাবেশ হওয়ার পর সমালোচনা শুরু হয়। ওই সমাবেশে বিএনপিও যোগ দিয়েছিল। এর পরেই আওয়ামী লীগের সুর বদলে যায়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্য প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। নিউ ইয়র্কে নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনি, অর্থ পাচারকারী ও সুদখোরেরা আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। এরা দেশের সম্পদ লুটে খেয়েছে। এরা ক্ষমতায় গেলে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে মিলে দেশ ধ্বংস করবে। অথচ সবাই জানেন, গত দশ বছরে সরকারের কাছের লোকেরাই লুটপাট করে দেশকে ফোকলা করে দিয়েছে এবং বিদেশে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে। সমাজের ভেতরে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ভবন নির্মাণে রডের বদলে দেয়া হয়েছে বাঁশ। কোথাও বা কঞ্চি কিংবা বাঁশের খাবাচি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আগেই ভেঙে পড়েছে রডহীন ব্রিজ। তার পরও কথার তুবড়ি কমছে না। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলেছে, ডানবাম বা মধ্যপন্থীদের সম্মিলন সরকারকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলেছে। কারণ এ ঐক্য দেশের জনগণের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার সুর বদলে সরকার এই ঐক্যের কঠোর সমালোচনা শুরু করেছে।

তাই ঐক্য প্রক্রিয়া এখনো যে খুব কাছে তা বলা যায় না। ড. কামাল হোসেন কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না বা আ স ম আবদুর রব যদি বিএনপিকে ডিক্টেট করতে চান, তাহলে সেটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। কেননা ব্যক্তিত্ব বা পরিচিত হিসেবে এদের পরিচিতি থাকলেও জনসমর্থনের দিক থেকে এরা অনেক পেছনে কিংবা অস্তিত্ব নেই। ফলে বড় বড় কথা বলার আগে বিষয়টি তাদের ভেবে দেখার দরকার আছে। এখানে একটি প্রসঙ্গ আসছে তা হলো জামায়াত। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, তাদের ঐক্য হবে বিএনপির সাথে। বিএনপি কাদের সাথে বসবে চলবে ফিরবে সেটা বিএনপির ব্যাপার। তাতে ঐক্য প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে না। কর্নেল অলি আহমদ বলেছেন, বি. চৌধুরীরা জামায়াত প্রসঙ্গ তুলছেন। কিন্তু ২০ দলীয় জোটে যখন জামায়াত ছিল এবং তারা মন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন লজ্জা হয়নি। গোশতটা হালাল ঝোলগুলো হারাম, এটা কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। এ ছাড়া শাহ আজিজুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন এই বি. চৌধুরী বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন, তখন স্বাধীনতাবিরোধীদের খারাপ লাগেনি? এ কথা সর্বাংশে সত্য।

অপর দিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগ-যুবলীগকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। সে প্রস্তুত থাকার চিত্র আমরা মাঝে-মধ্যেই দেখছি। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাদের কলসি ভরা। দুর্নীতির অর্থে কি সে কলসি ভরে গেছে। আমরা কোটা আন্দোলনের সময় দেখেছি কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সময়ও দেখেছি। ছাত্রলীগ-যুবলীগ কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে। আমরা আইয়ুব খানের ছাত্র সংগঠন এনএসফের কাহিনী জানি। খোকার পাঁচপাত্তুরা কি ত্রাসের রাজত্ব পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে করেছিল? পরে তাদের মৃতদেহ রাস্তায় লুটিয়ে থাকতে দেখেছি। কোটা আন্দোলনের সময় এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা এই ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দেখেছি। পেছনে সশস্ত্র পুলিশের পাহারা। সামনে সশস্ত্র ছাত্রলীগ। তারা হামলা চালিয়েছে নিরস্ত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। পাকিস্তান আমলে এনএসএফও তাই করত। এই ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারাও সেদিন সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। আমরা দেখেছি কিভাবে এসব অপশক্তির পতন ঘটে। বিরোধী দলকে দমনের ক্ষেত্রে বা বিরোধী মত দমনের ক্ষেত্রে একই কায়দা গ্রহণ করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ।

এর মধ্যে নতুন বাহিনী এসে হাজির হয়েছে। এরা আগে ছিল না কিংবা ছিল আত্মগোপনে- ছাত্রলীগের সাথে মিশে। এখন তারা আলাদা বাহিনী। হেলমেট বাহিনী এবং পুলিশ ছাত্রলীগের মাঝখানে সশস্ত্র অবস্থানকারী। হাতে অস্ত্র, মাথায় হেলমেট। সরকার নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগ-যুবলীগ বা নবগঠিত হেলমেট বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ এই সরকার ঘাতকদের প্রশ্রয়দানকারী এবং দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ আশ্রয়। এই বাহিনী এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাটের ওপরও হামলা করতে দ্বিধা করেনি। সরকার বলেছিল তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তবে আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় যখন ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটেছিল তখন ছাত্রলীগসহ এসব বাহিনী আশ্রয়ের জন্য দিগি¦দিক ছুটে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে আশ্রয় নিয়েছিল- রাজপথে কেউ ছিল না। আওয়ামী লীগের কোনো বিপদের দিনেই এ ধরনের কোনো বাহিনী প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement