১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাথায় যখন ধরেছে পচন

রাজনীতি
মাথায় যখন ধরেছে পচন - নয়া দিগন্ত

দীর্ঘ দিন মননশীল উন্নয়ন, মানবাধিকার, সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন, মিথ্যার বিরুদ্ধাচরণের বিপরীতে সত্যের জয়লাভ প্রভৃতি সংবাদ থেকে দেশের মানুষ শুনতে পায় কি না জানি না, তবে ইট-বালু-সিমেন্টের সমন্বয়ের অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, সেতু প্রভৃতির উন্নয়নমূলক ফিরিস্তির সংবাদ তো সরকারি প্রচার মাধ্যমে প্রচার করতে ন্যূনতম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে না, কিন্তু গণমানুষের বাঁচার অধিকার, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা, ব্যক্তির পরিবর্তে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের সংবাদ কোথায়? পত্রিকা খুললেই আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ব্রিজের নিচে বা ধানক্ষেতে পড়ে থাকা লাশ আর লাশ, ঘটনা ঘটেনি এমন ঘটনা সাজিয়ে গায়েবি মামলা, নিজ সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা, পরকীয়ার কারণে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী বা স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুনের ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের হওয়া সংবাদই পত্রিকায় স্থান সঙ্কুলন হয় না, পাশে তো রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ রয়েছেই।

রাষ্ট্রীয়ভাবে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলেও সংবিধানের পাতায় ছাপার অক্ষরে যেভাবে ছিল সেভাবেই রয়ে গেছে, সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যতটুকু বেঁচে আছে তা শুধু সরকার ও সরকারি ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মুখে মুখে। আমেরিকা মানবাধিকারকে ধ্বংস করে যেমন মানবাধিকারের জয়গান গায়, ঠিক তেমনি সরকার ও সরকারি ঘরানার মুখে মুখে রয়েছে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের কথা, অথচ ক্ষমতাসীনদের মুখে তো দূরের কথা বকধর্মী বুদ্ধিজীবীদের মুখে ভুলেও রাষ্ট্রীয় বৈরিতার কোনো কথা উল্লেখিত হয় না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Dicey আইনের শাসনের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

Dicey বলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনটি উপাদানের প্রয়োজন। 1. That there should be no sanction without breach, meaning that nobody should be punished by the state unless they had broken a law, 2. That one law should govern everyone, including both ordinary citizens and state officials and 3. That the rights of the individual were not secured by a written constitution, but by the decisions of judges in ordinary law. (সূত্র : Catherine Elliut & Frances Quinn প্রণীত English Legal System পৃষ্ঠা-৪)

অর্থাৎ ১. আইন ভঙ্গ না করা পর্যন্ত রাষ্ট্র কাউকে সাজা দিতে পারবে না, ২. একই পদ্ধতিতে সাধারণ জনগণ এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার প্রতি সমভাবে আইন প্রয়োগ হবে ও ৩. ব্যক্তি অর্থাৎ নাগরিকের অধিকার যেখানে সংবিধান দিয়ে নিশ্চিত হয়নি, সেখানে আদালতের রায়ে সে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু ওই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা মতে, বাংলাদেশে ‘আইনের শাসন’ আজ কোথায়? রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসক যেখানে সন্ত্রাসের উৎঘটক সেখানে ভারসাম্য রক্ষার জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তাও উবে গেছে দুর্বল মেরুদণ্ডের কারণে।

অনেক প্রতিকূল ও দুঃসংবাদের পর একটি ছবি ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে অবচেতন মনেই উচ্চারিত হতে থাকে- ‘এমন যদি হতো দিন উল্টো দিকে যেত তবে আসত ফিরে কি সেই হারানো লগ্ন?’ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দ্বিতীয় সপ্তাহে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাইস চ্যাঞ্চেলর আহূত সভায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সভাপতির কোলাকুলির মন মাতানো দৃশ্য। সত্যিই একটি ব্যতিক্রম দৃশ্য। যেখানে প্রতিপক্ষ সংগঠনের ছাত্রদের খুন করা ছাড়াও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ভোগদখল দারিত্ব ছাড় না দেয়ার প্রত্যয়ে নিজেরা দল, উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে, সেখানে রাজনৈতিক মূল প্রতিপক্ষের সাথে কোলাকুলি দৃশ্যত মনে অবশ্যই আশার সঞ্চার করে রাজনৈতিক অঙ্গনে দলের অভিভাবকদের চলমান কিছু বিষাক্ত ঘটনার কারণে। হতে পারে এ কোলাকুলি আন্তরিক বা লোক দেখানো, তবুও ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, ছাত্ররা প্রতিপক্ষ হয়েও নিজেরা একত্রে বসে সমস্যার সমাধানে ক্ষণিকের জন্য হলেও আলোচনা করতে পেরেছে।

এর ফলাফল কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই, তবে সময়ই প্রকাশ করবে এর প্রকৃত রূপ। তরুণ ছাত্রদের এ ঘটনার আগে কিশোর স্কুল ছাত্রছাত্রীদের সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যে চমকপ্রদ ঘটনা ঘটাল তাতেও জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো মেঘের ছায়ার পরিবর্তে সূর্যের আলো বা সিলভার লাইন দেখতে পাই। কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ ঐক্যবদ্ধতা নিয়ে হতাশ হয়ে যাই যখন দেখতে পাই যে, শুধু ক্ষমতাকে অবৈধভাবে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য প্রতিহিংসামূলক বক্তব্য দিয়ে, গায়েবি মামলা দিয়ে, পক্ষান্তরে মিথ্যার ঝুলি কাঁধে নিয়ে দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় খরচে ঘুরে ঘুরে মিথ্যা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বেড়ায়। এ মিথ্যার শেষ কোথায় জানি না। এ মিথ্যা প্রতিরোধ করা দূরের কথা, বরং জাতির কথিত বিবেক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা দ্বিগুণ, তিন গুণ, বহু গুণ উৎসাহে মিথ্যার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায় এবং পুরস্কারস্বরূপ কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের পরিবর্তে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে বেড়ায়।

কসাই ও চিকিৎসকের ছুরি চালানোর পদ্ধতি এক হতে পারে না। যাত্রামঞ্চের রাজা-মন্ত্রীর বক্তব্য ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, তাদের বক্তব্য ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এক হতে পারে না। এখন যা বক্তব্য চলছে, তা প্রতিশোধপরায়ণ ও উসকানিমূলক। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রধান বিরোধী দল জনসভা আহ্বান করেছে। সরকারি দলের কর্তারা ওইদিন মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারি দল অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ তাদের সাথে রয়েছে পুলিশ, র‌্যাব, ম্যাজিস্ট্রেট, মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য কলকাতা মনস্ক বুদ্ধিজীবী আরো কত কী? আর বিরোধী দলের কাছে রয়েছে মামলার পাহাড় যাদের প্রতিদিনের সময় কাটে আদালতের বারান্দায়। সুবিধাভোগী ও সুবিধাসন্ধানী বুদ্ধিজীবীদের ভাষায়- এটাই হলো লেভেল প্লেইং ফিল্ড অর্থাৎ খেলার সমতল ভূমি (!) নির্বাচন কমিশন আমলা দিয়ে গঠিত। ক্ষমতাসীনদের প্রতি কিভাবে নতজানু হয়ে থাকতে হবে তা ব্রিটিশ যা শিক্ষা দিয়েছে স্বাধীন দেশে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে পদ্ধতিতেই চলছে, নতজানু থাকা অর্থাৎ ‘জি হুজুর, জাঁহাপনা’ বলতে তারা অজ্ঞান এবং এটাই তারা বেদবাক্য মনে করে। এতে জাতির আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটুক বা না ঘটুক তাতে আমলাদের কিছু আসে যায় না, শুধু প্রমোশন ও বিশাল বিত্তের মালিক হওয়ার জন্য সুবিধাজনক পদে একটি পোস্টিং হলেই তাদের চলে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব একটি নীতি থাকা বাঞ্ছনীয়, নতুবা সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভাগ্য চলে যায় বাজার দানদক্ষিণার ওপর, নিজস্ব প্রতিভা বা মেধার কোনো মূল্যায়ন থাকে না। রাজধর্মের বিচ্যুত ঘটায় অনেক রাজত্বের অবসান ঘটেছে, যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তানের বেলায়, ৯৩ হাজার সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল মাত্র ৯ মাস যুদ্ধের সময় অতিক্রমকালে। কেউ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ক্ষমতাকে ছলে-বলে-কৌশলে অর্থাৎ রাজধর্মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হলেও নিজ সিংহাসনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু গোটা সমাজ যখন সুবিধা ভোগের অন্বেষণে থাকে, নিজেকে শুধু নিরাপদ অবস্থানে রাখতে চায়, অন্যের বা প্রতিবেশীর কষ্টকে নিজের কষ্ট বা দুর্ভোগ মনে করে না; তখনই মনে হয় জাতির বিবেকে জং ধরছে এবং সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে সব মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে নেয়। তখনই মনে হয়, জাতির মাথায় ধরছে পচন।

মানুষের বিবেকে যখন পচন ধরে তখন চক্ষুলজ্জাও উঠে যায়। যার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নির্লজ্জ কথাবার্তা। যারা অংশগ্রহণমূলক কথা বলছেন তারাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, যাতে বিরোধী জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। তফসিল ঘোষণার আগেই সরকার নির্বাচনী প্রচারণায় পুরোদমে নেমেছে সরকারি গাড়ি, বাড়ি ও অর্থ ব্যবহার করে। পুলিশ প্রশাসনকেও ব্যবহার করা হচ্ছে অনৈতিকভাবে, অথচ এ বিষয়ে নির্বাক রয়েছে নির্বাচন কমিশন।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (আপিল বিভাগ)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল