২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন - ছবি : সংগৃহীত

বহুলবিতর্কিত আলোচিত-সমালোচিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হলো গত ১৯ সেপ্টেম্বর। কঠোর বিধিবিধান বহাল রেখেই সম্পাদক পরিষদ ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন এবং সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের দাবি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সংসদে কণ্ঠভোটে নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে পুঁজি করে এ আইন পাস করিয়ে নিলো সরকার। এ আইনের বিধান অনুসারে, পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো লোককে তল্লাশি ও গ্রেফতার করতে পারবে। এ আইনের কিছু ধারার অপরাধকে জামিনের অযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা হয়েছে।

সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা এ নতুন আইনটি প্রসঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো সুরাহা না করেই এ আইনটি পাস করা হলো। তারা আরো বলেন, এ আইনটি সংবিধানের মূল চেতনার বিরুদ্ধে গেছে এবং এটি মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করবে। তা ছাড়া, এটি স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

নতুন এ আইনটির ৪৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে- যদি একজন পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, এই আইনের অধীনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অথবা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অপরাধটি করা হয়েছে অথবা এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে অথবা সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে- তবে পুলিশ যেকোনো স্থানে বা ব্যক্তিকে তল্লাশি করতে পারবে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, পুলিশকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাজেন্সির (যা গঠিত হবে এই আইনের আওতায়) ডিজির কাছ থেকে গ্রেফতারের অনুমোদন নিতে হবে। তা সত্ত্বেও এ আইনটি পাস হওয়ার সময় জাতীয় পার্টির এক সংসদ সদস্য এ ধারাটি থেকে ডিজির অনুমতি নেয়ার বিধান বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, এর ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হবে।

এই আইনে ডিজিটাল অপরাধের সংজ্ঞা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব করা, ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ আইনের আওতায় কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার চালায়; তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে; তাহলে ১০ বছরের জেল বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনটির ২৯ ধারায় বলা হয়েছে- মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। এ ছাড়া, ৩২ ধারায় বলা হয়েছে- সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনটিতে আরো বলা আছে- কেউ যদি বেআইনিভাবে কারো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে, তাহলে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে অথবা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। বেআইনিভাবে অন্যের সাইটে প্রবেশ করার পর যদি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। আবার কেউ যদি বেআইনিভাবে কারো ডিভাইসে প্রবেশ করে, তাহলে এক বছরের জেল বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। এ ধরনের লঘুপাপের গুরুদণ্ডসংবলিত নানা অপরাধের কথা উল্লেখ রয়েছে এ আইনে।

এ আইনটি পাসের কয়েক দিন আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের প্ল্যাটফর্ম ‘সম্পাদক পরিষদ’ এ আইনের চূড়ান্ত খসড়া সম্পর্কে বিস্ময়, হতাশা ও মর্মাহত হওয়ার কথা প্রকাশ করে বলে- প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের খসড়াটি সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সাংবাদিক সমাজ এটি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছে। সম্পাদক পরিষদ এর বিবৃতিতে উল্লেখ করে- আইনের চূড়ান্ত খসড়া দেখে আমরা বিস্মিত, হতাশ ও মর্মাহত। দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় সংসদকে এই আইন পাস না করার আহ্বান জানানো হয়। এর আগে রাজধানীতে বৈঠক করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ২০টি পত্রিকার সম্পাদক। তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়- এর আগে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা হলেও এই আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আইনের প্রস্তাবিত খসড়া মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এ আইনে ঔপনিবেশিক যুগের মতো অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের বিষয়টি যুক্ত করায় আমরা উদ্বিগ্ন। এটি স্পষ্টভাবে তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়- এ আইন নিয়ে এর আগে আইনমন্ত্রী এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিমন্ত্রীর সাথে ধারাবাহিকভাবে সম্পাদক পরিষদের নেতাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে দুই মন্ত্রীই উদ্বেগের বিষয়টি আমলে নিয়ে তা পুনর্বিচেনার জন্য আশ্বাস দিয়েছিলেন। সম্পাদক পরিষদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে- এই চূড়ান্ত খসড়া সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

আইনটি পাস হওয়ার পর সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম গণমাধ্যমে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন- ‘‘স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশ ও গণতন্ত্রের জন্য এ আইন পাসের দিনটি একটি ‘দুঃখজনক দিন’। এ আইন ডিজিটাল যুগের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ আইনের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতে ফেলবে।”

অপর দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজউদ্দিন আহমেদের এ আইন সম্পর্কে অভিমত হচ্ছে- “স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা হয়ে থাকবে এ আইন। সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিক সমাজ দীর্ঘ দিন ধরে যে আন্দোলন করছে, এটি হবে এর অন্তরায়। এ আইনের ১৪টি ধারাকে অজামিনযোগ্য করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’কে এ আইনে টেনে এনে যুক্ত করা হয়েছে। এটি খুব খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বিষয়গুলোও এ আইনের চারটি ধারায় ভাগ করে রাখা হয়েছে। এসব ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর হুমকি হবে। ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হলেও এই ধারার মামলা চলতে থাকবে, এটিও দুঃখজনক।

গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে এ আইন ভীতির সঞ্চার করবে। দুর্নীতি ও অত্যাচারের খবর যাতে সামনে না আসে, সে জন্য অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে সত্যকে ধামাচাপা দিতে। এটিকে আবার সামনে আনা হলো। এ আইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে এবং গণতন্ত্রকে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গণমাধ্যমকর্মীরা বিশেষ ক্ষমতা আইনের গণমাধ্যমবিরোধী ধারাগুলোর প্রতিবাদ করেছিলেন। এ আইনের বেলায়ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিবাদ করতে হবে।”

দৈনিক সংবাদের সম্পাদক খন্দকার মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘এ আইন গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের ওপর আঘাত সৃষ্টি করবে। এর শিকারে পরিণত করা হবে নাগরিকসাধারণ ও গণমাধ্যমকে এবং তা মানবাধিকারকে করবে সঙ্কুচিত। মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করবে এক ধরনের আতঙ্ক। সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করা হবে।’
ভোরের কাগজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শ্যামল দত্ত আইনটি সম্পর্কে বলেন, ‘এটি খুবই দুঃখজনক। আমরা মর্মাহত। সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগের সমাধান করা হয়নি। এ আইন সম্পর্কে আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই আছি। আমাদের সম্পাদক পরিষদের আগামী বৈঠকে আমাদের পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করব।’

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘এ আইনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। আগামী দিনে স্বাধীন সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়বে। আমরা ভেবেছিলাম, সরকার স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার স্বার্থে আমাদের (সম্পাদক পরিষদের) পরামর্শ গ্রহণ করবে। কিন্তু তা করা হয়নি।’

গাজী টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এ আইন সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ। সরকার সম্পাদক পরিষদ, বিএফইউজে ও টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক সমিতিকে পুরোপুরি এড়িয়ে তড়িঘড়ি করে আইনটি পাস করেছে। আমাদের আশঙ্কা, সংবিধানে নিশ্চিত করা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করা হবে।’

ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল অপরাধ ঠেকানোর প্রয়োজন রয়েছে। আমরা মনে করি, ডিজিটাল মিডিয়ার স্বাধীনতা থাকা দরকার। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার হয়। আমি আশা করি, আইনটি শুধু ব্যবহার হবে ডিজিটাল অপরাধের বিরুদ্ধে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনে নয়।

এখন যখন সাংবাদিক মহলের মতামত আমলে না নিয়েই সরকার শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করে এ আইনটি পাস করল, তখন প্রায় গোটা সাংবাদিক সমাজ রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছেন, এই বিলে স্বাক্ষর না করার জন্য। অপর দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসরকারি সেবা সংস্থা তথা এনজিওগুলো। গত ২০ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদে ‘ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) গ্রুপের প্রতিবেদন গৃহীত হওয়ার আগে এনজিওগুলো এক সুরে এই উদ্বেগ প্রকাশ করে। ১০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ১২টি দেশের ইউপিআর রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হয়। অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, সাইবার অপরাধ থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়ার প্রয়োজনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। আর অধিবেশনে অংশ নেয়া বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষার অঙ্গীকার থেকে সরকার সরে গেছে, যার পরিণতি গুরুতর হতে পারে। তারা অবিলম্বে এ আইন সংশোধনের আহ্বান জানান। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে অধিবেশনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলোপ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চূড়ান্ত খসড়া সংশোধন, সাংবাদিক-নাগরিক সমাজ এবং এনজিওগুলোর ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ, নিবর্তনমূলক গ্রেফতার, হয়রানি ও হামলা বন্ধ এবং ওই হামলাকারীদের বিচারের আহ্বান জানানো হয়।
আসলে এ আইনটি নিয়ে গণমাধ্যম যেসব সমালোচনা বেশি করে আসছে, সেগুলো মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিরোধী মত-পথের মানুষের দমনপীড়ন সংশ্লিষ্ট। কিন্তু আইনটির অনেক মৌল ত্রুটি সম্পর্কিত আলোচনা খুব কমই আসছে গণমাধ্যমে। এর বিস্তারিতে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই। তবে এ লেখার বাকি অংশে এ আইনের সুযোগ ও যথার্থতা সম্পর্কে কয়েকটি মৌল বিষয় উল্লেখ করতে চাই।

অনেক ক্ষেত্রে এ আইনে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে খুবই বৃহত্তর পরিসরে। এটি প্রকৃত অপরাধ এড়িয়ে চলার মতো, সূক্ষ্মদর্শী ও সঙ্কীর্ণধর্মী। এটি বিশেষত সমস্যাকর হয়ে ওঠে, যেখানে ক্ষমতা দেয়া হয় রেগুলেটরি বডিকে। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এবং বিশেষত আইসিসিপিআর-এর ১৯(৩) অনুচ্ছেদে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ শুধু তখনই বৈধ, যদি তা আইনে সিদ্ধ হয়। এর অর্থ শুধু এই নয় যে, একটি আইন পাস করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস কমিটি ‘জেনারেল কমেন্ট নাম্বার ৩৪’-এ এমনটিই উল্লেখ রয়েছে।
উদাহরণত, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি’ স্পষ্টত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা পুরো আইনটির নাম গঠন করে, আর সংজ্ঞায়িত হয় এভাবে: ‘ংবপঁৎরঃু ড়ভ ধহু ফরমরঃধষ ংবৎারপব ড়ৎ ফরমরঃধষ ংুংঃবস’। অপর দিকে মনে হতে পারে এটি একটি স্বাভাবিক সংজ্ঞা, কিন্তু আসলে সংজ্ঞাটি খুবই ব্যাপক। একটি কম্পিউটারকে পানির কাছে রাখা ডিজিটাল সিকিউরিটি হুমকির উপস্থাপন হতে পারে, যেহেতু এ যন্ত্রটি ভিজে যাওয়ার অর্থ সাধারণত ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়া। একটি কম্পিউটারের জন্য একটি দুর্বল পাসওয়ার্ড তৈরি করাও হতে পারে ডিজিটাল সিকিউরিটির জন্য হুমকি।

পরিচালনাগতভাবে, এটি হয়ে ওঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণত, ৮(১) নম্বর ধারাটি ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির মহাপরিচালককে দেয়া হয়েছে আইনের ৫ নম্বর ধারা বলে সৃষ্ট মুখ্য ইমপ্লিমেন্টিং বডির লেজিসলেশনের ক্ষমতা। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, এমন সব ডাটা বা ইনফরমেশন অপসারণ বা ব্লক করে দেয়ার অনুরোধ জানানোর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের ড্রাকনিয়ান ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে আরো মারাত্মক হুমকি সংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রয়োজন। একইভাবে ৯ নম্বর ধারা বলে প্রতিষ্ঠা করে একটি ‘ন্যাশনাল কম্পিউটার ইমারজেন্সি টিম’, যা এই এজেন্সির অধীনে কর্মরত একদল ডিজিটাল সিকিউরিটি ও আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি টিম। ডিজিটাল নিরাপত্তা হুমকিতে পড়লে এই টিম তথ্য অবকাঠামো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে। আবার তদারকি বা ওভারসাইট করার জন্য ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সৃষ্টি করা হবে। এই কাউন্সিল ডিজিটাল নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবে [ধারা ১৩(২)]। এসব ক্ষেত্রে হাইয়ার মিনিয়াম থ্রিশোল্ডসহ আরো যথার্থ সঙ্কুচিত সংজ্ঞা প্রয়োজন।

অন্যান্য ক্ষেত্রে অসচেতন ওভার-ইনক্লুসিভ ড্রাফটিং ডেকে আনে অযৌক্তিক পরিণতি। এভাবে ‘আনলফুল অ্যাক্সেস’ বা আইনবহির্ভূত প্রবেশে অন্তর্ভুক্ত করে অনুমোদনহীনভাবে একটি কম্পিউটারে প্রবেশকেও, যা ঠিকই আছে। কিন্তু যেখানে ইনফরমেশন সিস্টেমে কোনো শর্ত ছাড়াই ইনফরমেশন বা ডাটা পাঠানো ও গ্রহণের ক্ষেত্রে অ্যাক্সেসে বাধা দেয়া হয় কিংবা তা বাতিল করা বা বাধাদান করা হয় অথবা এর প্রসেসিংয়ে বাধা দেয়া হয়, তা ঠিক নয়। এটি এমন, যে কেউ যখনই তাদের নিজের কম্পিউটার বন্ধ করবেন, তখনই এরা মুখোমুখি হবেন অবৈধ অ্যাক্সেসের। একইভাবে ‘মেলওয়্যার’ হচ্ছে এমন কোনো প্রোগ্রাম, যা পরিবর্তন করে কম্পিউটার বা ডিভাইসে বা ফেসিলিটিজে করা কোনো কাজকে, কোনো ডিজিটাল ডিভাইসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রবেশকে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ডিজিটাল ডিভাইসের সেটিংয়ের অ্যাডজাস্টমেন্টও (যেমন- একটি প্রোগ্রাম সক্রিয় করতে ডাবল ক্লিকের স্পিড অথবা ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রোগ্রামের টপে প্রদর্শিত টুলবার পরিবর্তন করা) অথবা দু’টি ডিভাইসের ই-মেইলে অটোমেটিক শেয়ারিং আপে পরিবর্তন করা। স্পষ্টতই এসব সংজ্ঞা এত দূর যাওয়া উচিত নয়।

এই আইনে আরো কিছু দুর্ভাগ্যজনক ব্রড ল্যাঙ্গুয়েজ রয়েছে। এ আইনের আরেকটি ভয়াবহ সঙ্ঘাত সৃষ্টিকর উৎস হচ্ছে ব্যাপক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে বিধান তৈরির বিষয়টি ৬১ নম্বর ধারার মাধ্যমে রেখে দেয়া হয়েছে সরকারের হাতে। সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এসব বিধান তৈরি করবে। রুলস আর বিধান হচ্ছে এক ধরনের সাব-অর্ডিনেট লেজিসলেশন, যাকে মূল আইনের সাব-অর্ডিনেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতএব, এরা যখন ক্ষুদ্র বিষয় বিশ্লেষণ করবে, সময় সময় যেসব বিষয় নির্ধারণ করবে, যেমন প্রশাসনিক সেবার ফি, এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও রেগুলেটরি ইস্যুগুলো বিধানের মধ্যে রাখা যাবে না। সরকারকে খুবই ‘ব্রড রুল-মেকিং পাওয়ার’ দেয়ার বিষয়টি ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা এবং পার্লামেন্টে সদস্যদের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি, যা প্রয়োগ করা হয় সংসদে গ্রহণ করে নেয়ার মাধ্যমেÑ এড়িয়ে যাওয়ার শামিল।

এর বিপরীতে এ আইনের চরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রেখে দেয়া হয়েছে এই রুল বা বিধানাবলির আওতায়। এ আইনে খুব কমই বলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে। এবং এর পরিবর্তে ৫(৩) ধারা মতে, এই এজেন্সির ‘ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ড’ নির্ধারিত হবে রুলস অনুযায়ী। এটি পুরোপুরি অযথার্থ। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্সির ক্ষমতা ও দায়দায়িত্বের বিধান থাকতে হবে প্রাথমিক আইনে।

ধারা ৮-এর মাধ্যম কনটেন্ট ব্লক করা বা সরিয়ে ফেলার অপরিমেয় ক্ষমতা দেয়, যা খুবই অনাহূত একটি ক্ষমতা। কিন্তু সেটি কিভাবে কাজ করবে সে সম্পর্কে এতে কিছুই বলা হয়নি; বরং এর পরিবর্তে ধারা ৮(৪) সুযোগ করে দেয় এই ধারার লক্ষ্য পূরণের এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় রুলস দিয়ে নির্ধারণ করার। আবারো বলতে হয়, কমপক্ষে এসব ক্ষমতা প্রয়োগপদ্ধতির একটি কাঠামো প্রাথমিক আইনের মাধ্যমে নির্ধাণের তাগিদ আসে।

ন্যাশনাল কম্পিউটার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিমকে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি সাধারণ ক্ষমতা। যেমনÑ সম্ভাব্য ও আসন্ন সাইবার বা ডিজিটাল হামলা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা। আবার এই ‘ক্যাচ-অল’ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ৯(৫)(গ) ধারার মাধ্যমে। এই ধারা মতে, এই টিম রুলস-নির্দেশিত যেকোনো কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে। একইভাবে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি [ধারা ১০(৪) ও ধারা ১১(১)] এবং ন্যাশনাল ডিজিটাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সম্পর্কিত বিষয়াবলি [ধারা ১৩(২)(ঙ)] নির্ধারণ করা হবে রুলের মাধ্যমে।

এর বিপরীতে এসব ক্ষেত্রসংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের, যেগুলো একটি কর্তৃপক্ষ বা কর্তৃপক্ষ বা এজেন্সির ক্ষমতা কর্মকাণ্ড প্রয়োগকারী এজেন্সি সৃষ্টি করে, সেগুলোর পর্যালোচনা দরকার। উদাহরণত, টেকনিক্যাল বিষয়ে কাজ করা বিশেষ এজেন্সিগুলো, যেমন- ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল আইনের ৩ নম্বর ধারা বলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কর্মকাণ্ড রয়েছে, যা সুস্পষ্টভাবে প্রাথমিক আইনে উল্লিখিত রয়েছে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন- এর লক্ষ্য, কর্মকাণ্ড ও ক্ষমতা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে যথাক্রমে আইনের ২৯, ৩০ ও ৩১ নম্বর ধারায়। অতএব বলা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত এ আইনি অনুশীলন বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে- এ ব্যর্থতা যথাযথভাবে বিভিন্ন বডির ক্ষমতা ও কর্মকাণ্ড সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে। এর পরিবর্তে তা ছেড়ে দেয়া হয়েছে সরকারের হাতে।


আরো সংবাদ



premium cement