২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ঐতিহাসিক একটি দিন

দেশের গতিপথ পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষা প্রয়োজন

দেশের গতিপথ পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষা প্রয়োজন - ছবি : নয়া দিগন্ত

সম্মানিত পাঠককুলের কাছে আমার জীবনের একটি ঐতিহাসিক তারিখে আমি দোয়াপ্রার্থী। এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি। পাঠক এই কলামটি পড়ছেন বুধবার ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ ছিল শনিবার। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের কাছে কাকুল নামক স্থানে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ২৪তম ওয়ার কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজ বা কমিশনিং প্যারেড বা পাসিং আউট প্যারেড বা প্রেসিডেন্টস প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম কোর কমান্ডার, ঢাকার নবাববাড়ীর সন্তান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দীন (মরহুম)। ওই দিন কুচকাওয়াজে আমি আমাদের কোর্সের (সাধারণ পরিভাষায় ব্যাচের বা ক্লাসের) মধ্যে সর্বোত্তম ক্যাডেট বা প্রথম স্থান অধিকারী হিসেবে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলাম। পুরস্কারটির নাম ছিল : ‘কমান্ডার ইন চিফস কেইন’।

সোর্ড অব অনারের সমতুল্য এই পুরস্কারটিকে, সংক্ষেপে বলা হয় সিইনসি’স কেইন। উল্লেখ্য যে, দীর্ঘমেয়াদি কোর্স বা লং কোর্সের সর্বোত্তম ক্যাডেটরা পান ‘সোর্ড অব অনার’। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেওয়াজ অনুযায়ী প্যারেডের পরের দিন তথা ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ হলো আমাদের কমিশনপ্রাপ্তির দিন বা ‘ডেইট অব কমিশন’। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেওয়াজ অনুযায়ী সর্বোত্তম ক্যাডেট হওয়ার সুবাদে নিজের পছন্দের স্থানে চাকরি শুরু করার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্থানটি ছিল বর্তমান গাজীপুর জেলার সদর ও তৎকালীন ঢাকা জেলার জয়দেবপুর থানার সদর। যেখানে সেই স্থানটি, সেখানে আছে ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজাদের আবাসস্থল ভাওয়াল রাজবাড়ি। সেই রাজবাড়িতে ছিল, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় সেকেন্ড বেঙ্গল এবং আদর করে বলা হয় জুনিয়র টাইগার্স। একা নয়; এই ব্যাটালিয়নের সর্বকনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে, সবার সাথেই, এই স্থান থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলাম। আজ এ কলাম লিখতে গিয়ে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলের বন্ধুদের, বিশেষত যেসব বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তাদের কথা বারবার মনে পড়ছে। আগামীকাল ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়, ঢাকা মহানগরে একটি রেস্টুরেন্টে আমরা জীবিত বন্ধুরা সস্ত্রীক মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে; মহান আল্লাহর দয়াসাপেক্ষে।

পর্যালোচনা : ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯০০ সাল
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমসাময়িককালের যুগান্তকারী ঘটনা। এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করছি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য। বর্তমানে যেটা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগে সেটাই ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’। পূর্ব পাকিস্তান মানে, পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশের মধ্যে একটি। অপর প্রদেশটির নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। বর্তমানে যেটা পাকিস্তান নামক দেশ, সেটাই ছিল এককালে পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, এর দু’টি প্রদেশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল এক হাজার থেকে দেড় হাজার মাইল এবং মধ্যখানে ছিল আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ যার নাম ভারত। ভারত এখনো আছে; ভারতের পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী হচ্ছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র এবং ভারতের পূর্ব দিকের অন্যতম প্রতিবেশী হচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। ভারতের পূর্ব দিকে আরো প্রতিবেশী আছে চীন ও মিয়ানমার।

যেটা বর্তমান বাংলাদেশ (অর্থাৎ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান), ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের আগে সেটাই ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল নামক প্রদেশের অংশ। তখনকার বেঙ্গল নামক প্রদেশটি একটি পুরাতন প্রদেশ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান ও তার কয়েকজন সঙ্গীর বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশরা জয়ী হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই সিরাজউদ্দৌলার শাসনাধীন পুরো এলাকা ব্রিটিশদের কব্জা হয়ে যায়। এখান থেকেই তারা পুরো ভারতকে তাদের শাসনে বা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। বেঙ্গল বা বঙ্গ নামক প্রদেশে প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করত। ব্রিটিশদের শাসনামলে ১৭৫৭ থেকে নিয়ে ১৯০০ সালের মধ্যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলমানেরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়েছিল।

নতুন প্রদেশ সৃষ্টি ও বাতিল
১৯০০ সালের আগে-পরের বছরগুলোতে তৎকালীন বেঙ্গল প্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তারা চিন্তা করেছিলেন, যদি এ প্রদেশকে দুই ভাগ করা হয় তথা আলাদা দু’টি প্রদেশ করা হয়, তাহলে মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের উন্নতির জন্য একটি বিরাট সুযোগ পাবে। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অনেক দেন-দরবার করে, অনেক চেষ্টা-তদবির করে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে এই সিদ্ধান্ত আদায় করেছিলেন যে, বেঙ্গল নামক প্রদেশের পূর্ব অংশকে একটি আলাদা প্রদেশ করে দেয়া হোক। যেই কথা সেই কাজ। নতুন প্রদেশের নাম হলো ইস্ট বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম এবং রাজধানী হলো ঢাকা। শুনতে খুব খারাপ লাগে, কিন্তু বাস্তবতা হলো- তৎকালীন বেঙ্গল নামক প্রদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা এবং তৎকালীন বেঙ্গল নামক প্রদেশের রাজধানী কলকাতা মহানগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই নতুন প্রদেশ সৃষ্টির ঘটনাটিকে মেনে নিতে পারেননি। যারা পূর্ববঙ্গকে স্বাগতম জানাননি, তাদের প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে নতুন প্রদেশের বিলুপ্তি ঘটায়। ১৯০৫ সালের ঘটনাটিকে ইতিহাসের সাধারণ পরিভাষায় বলা হয় ‘বঙ্গভঙ্গ’ এবং ১৯১১ সালের ঘটনাটিকে বলা হয় ‘বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণ’।

পর্যালোচনা : পাকিস্তান সৃষ্টির পথে
১৯১১ থেকে নিয়ে ১৯৩৭ বা ১৯৪০ বা ১৯৪৬ সাল দীর্ঘ সময়। কালক্রমে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সময়কালে বেঙ্গল প্রদেশের হিন্দু নেতারা ইস্ট বেঙ্গল নামক নতুন প্রদেশকে মেনে নিতে না পারলেও, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টিকালে, বেঙ্গল নামক প্রদেশটির দুই ভাগ হওয়ার ঘটনা তারা মেনে নিয়েছিলেন। কেউ বলেন মেনে নিয়েছিলেন, কেউ বলেন, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন; আবার কেউ বলেন, তারাই এই দ্বিখণ্ডিতকরণের উদ্যোক্তা ছিলেন। এই কলামে ওই আলোচনায় যাচ্ছি না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও প্রারম্ভ
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে জনসংখ্যার দিক থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল বড় বা বেশি এবং কৃষিক্ষেত্রে এর অবদান ছিল বেশি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান ছিল ভৌগোলিক আয়তনে বড়, লেখাপড়ায় বা সিভিল সার্ভিসে, সামরিক সার্ভিসে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অধিকতর অগ্রসর। বিভিন্ন কারণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানের দু’টি প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য দূরত্ব ও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানিদের-কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাঙালির মাতৃভাষা, বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবহেলা করা এবং জাতিগতভাবে বাঙালিদের অবমূল্যায়ন করা। মুখে ইসলামের নাম নিলেও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন।

এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়াকে হেয় ও অবহেলা করেন। তখন সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বিশেষত ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান যিনি ১৯৬৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু নামেও পরিচিত। তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি প্রস্তুত হচ্ছিল; এই প্রস্তুতি পর্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল ল্যান্ডমার্ক বা নক্ষত্র-চিহ্ন হচ্ছে ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখের ঐতিহাসিক ভাষণ। বাঙালির বা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে সশস্ত্র আগ্রাসী ভূমিকায় লিপ্ত হলো।

এই পর্যায়েই এ জাতি অনুভব করে যে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ব্যতীত পাকিস্তানের অত্যাচার ও অন্যায়-বঞ্চনা থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। তাই তাদের অধিকার আদায়ের জন্য, তথা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দেয়। এর অব্যবহিত পরে, মার্চ মাসের ২৭ তারিখ, তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর থেকে অল্প দূরে অবস্থিত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের নামে, কয়েক ঘণ্টা পরেই দ্বিতীয়বার সংশোধিত ভাষ্যে, বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান, যাকে আমরা বর্তমানে স্মরণ করি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম হিসেবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবীর বহু দেশ সহযোগিতা করেছে, কিছু দেশ বিরোধিতা করেছে। এতে ভারতের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথা প্রায় অনিবার্য ছিল।

ভারত ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ
যে ভারতের মানুষ, বিশেষ করে তৎকালীন বেঙ্গল নামক প্রদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ, ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালের সময়ে পূর্ববঙ্গ নামক একটি প্রদেশের আলাদা অস্তিত্বকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না, সেই ভারতের মানুষই ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তিত করতে ওতপ্রোতভাবে বা সর্বাঙ্গীণভাবে সাহায্য করেছিলেন। নিশ্চয়ই ভারতের কোনো স্বার্থ জড়িত ছিল এ ক্ষেত্রে; একটা রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত থাকতেই পারে। অর্থাৎ পাকিস্তানকে ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে নিশ্চয়ই ভারতের জন্য কোনো-না-কোনো উপকার হবে- এই কথাটা, ১৯৭০-৭১ সালের ভারতীয় নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ এক দিকে আমরা বাঙালিরা পাকিস্তানিদের অত্যাচার-বঞ্চনা-শোষণ থেকে বাঁচার জন্য স্বাধীন হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত; অপর দিকে ১৯৭০-৭১ সালের ভারতীয় নেতারাও একটি মোক্ষম সুযোগ পেলেন পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে আমাদের এই বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র হিসেবে বিদ্যমান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময় হচ্ছে চার বছর; ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ১০ বছর; ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময় হচ্ছে ১৯ বছর; ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত হচ্ছে ৩৪ বছর; ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হচ্ছে ৪৭ বছর (আর মাত্র চার মাস গত হলেই বাংলাদেশের বয়স ৪৭ বছর হয়ে যাবে)।

কেন পর্যালোচনা করলাম?
ওপরের পাঁচটি অনুচ্ছেদের মূল বিষয় ‘পর্যালোচনা’। এই পাঁচটি অনুচ্ছেদের বক্তব্যের সারমর্ম হলো- একটি পরিবারের ইতিহাসে যেমন ভালো-মন্দ সময় থাকে, সংগ্রামের সময় ও উপভোগের সময় থাকে, তেমনি একটি জাতিরও ভালো-মন্দ সময় থাকে এবং সংগ্রামের সময় ও উপভোগের সময় থাকে। অল্প শব্দ সংখ্যা ব্যবহার করে, বাংলাদেশের বর্তমানে অবস্থানে আসা পর্যন্ত একটা রেখাচিত্র ওপরের পাঁচটি অনুচ্ছেদে তুলে ধরেছি। যে জন্য পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাম বা যে মূল্যবোধগুলোর জন্য পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলাম, আমরা সেই লক্ষ্যবস্তু কি অর্জন করতে পেরেছি? না পেরে থাকলে ব্যর্থতা কোথায় এবং কেন, এটা নিশ্চয়ই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু সেই অবস্থানটি কতটুকু নিষ্কণ্টক বা কতটুকু অদৃশ্য সুতার টানে আবদ্ধ, সেটা সব নাগরিক না বুঝলেও, সচেতন নাগরিকেরা অবশ্যই বোঝেন।

ভূগোল বদলানো যায় না; ইতিহাসের ঘটনা বদলানো যায় না। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। ১৯৭১ সালের পরে পৃথিবীর সব নদী দিয়ে পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে, হিমালয় পর্বতের অথবা উত্তর মেরু অঞ্চলের অনেক বরফ গলে পানি হয়ে গেছে, অর্থাৎ দেশে দেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে গিয়েছে। ২০১৮ সালে এসে আমাদের বাংলাদেশকেও সাম্প্রতিকতম বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নিজেদের চলার পথ নিরূপণ করতে হবে।

সচেতন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান
যেকোনো পথিককে দীর্ঘ পথ চলতে গেলে থেমে থেমে মাঝে মাঝে গন্তব্যের দিক ঠিক আছে কি না সেটা নিশ্চিত হতে হয় বা পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষা করে নিতে হয়। অতএব, বাংলাদেশ নামক দেশটি সঠিক পথে আছে কি না সেটা নিরীক্ষণ করা একান্তই জরুরি। ক্লাস নাইন বা ক্লাস টেনের ছাত্রকে বা এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্রকে যেমন বাবা-মা মিনিটে মিনিটে তদারকি করেন না; দুই-তিন দিন পরপর বা সপ্তাহ-দু’সপ্তাহ পরপরই তদারকি করেন বা খোঁজখবর নেন, তেমনি একটি রাষ্ট্র বা দেশ সঠিক পথে আছে কিনা সেটা পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষা করার জন্য নাগরিকেরা প্রত্যেক সপ্তাহেই সুযোগ পাবেন না, প্রত্যেক মাসেই সুযোগ পাবেন না; এমনও বলা যায় যে, প্রত্যেক সপ্তাহে বা মাসে এই কাজ করা সম্ভব নয়।

একটি দেশের অগ্রগতি বা গতিপথ সঠিক আছে কি না, গন্তব্যস্থলের দিকে সঠিক পথ অনুসরণ করা হচ্ছে কি না সেটা পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষার জন্য নাগরিকদের সামনে যে সুযোগটা নিয়মিত বিরতিতে এসে উপস্থিত হয়, এর নাম হলো জাতীয় নির্বাচন বা পার্লামেন্ট নির্বাচন। বাংলাদেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন কখন কখন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠানের সময় নাগরিকদের সামনে কোন ইস্যুগুলো বা বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য উপস্থিত ছিল, এর তালিকা দিতে গেলে অনেক জায়গা লাগবে কলামের। আমি তরুণ সম্প্রদায়কে অনুরোধ করব, যেন তারা অন্তত ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে সূচক বা অধ্যায় মনে করেন, নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা খরচ করে মূল্যায়ন করেন।

এ জন্য আমার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত বিষয়গুলোর মাত্র দু’টি উল্লেখ করছি; যথা, নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কী কী ওয়াদা ছিল। প্রত্যেক নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলের ওয়াদাগুলো পাওয়া যাবে যদি তাদের ইশতেহার পর্যালোচনা করা হয়। তবে মনে রাখতে হবে, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে এবং ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে, কোনো বিরোধী দল ছিল না। যদি নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা বুঝতে পারব সাধারণ ভোটারদের চাওয়া-পাওয়া এবং দলগুলোর চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে কী তফাৎ বা কী দূরত্ব থাকে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন এখন খুব কাছে। অতএব এরূপ একটি মূল্যায়ন করা খুব জরুরি এবং প্রাসঙ্গিক। কোটি কোটি মানুষ বা কোটি কোটি ভোটার একই নিয়মে বা পদ্ধতিতে এই মূল্যায়ন করতে পারবেন না। তাহলে এই মূল্যায়ন করবেন, যারা নাগরিকদের মধ্যে অধিকতর সচেতন, তারা। এই সচেতন ব্যক্তিদের মূল্যায়নটি সাধারণ ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পদ্ধতি বের করতে হবে।

তাৎক্ষণিক স্মৃতিপুনরুদ্ধার
আজকের কলামটি সামনে রেখে আমরা দু’চারটি প্রসঙ্গ পুনরায় নিজেদের মানসপটে আনতে পারি, তথা ইংরেজি পরিভাষায় বললে, রি-ক্যাপিচুলেট করতে পারি। প্রসঙ্গ-১ : নবাব সিরাজউদ্দৌলা কেন পলাশীতে পরাজিত হয়েছিলেন? ২ : ১৯০৫ সালে কেন ব্রিটিশ-ভারতের বেঙ্গল নামক প্রদেশটিকে ভাগ করা হয়েছিল? ৩ : ১৯১১ সালে কেন নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ বিলুপ্ত করে পুনরায় বেঙ্গল নামক প্রদেশ বহাল করা হয়েছিল? ৪ : ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারতের বেঙ্গল নামক প্রদেশ ভাগ করার কাজটি কেন অপরিহার্য ছিল? ৫ : ১৯৪৭-এর পরে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা এমন কী করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নামক প্রদেশের জনগণ তথা বাঙালিরা হতাশা, বঞ্চনা ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদ করতে বাধ্য হলেন? ৬ : ১৯৭১ সালে অপরিহার্য বাধ্যবাধকতা কী কী ছিল, যে কারণে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের সাহায্য নিতে বাধ্য হন এবং ভারতীয় সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে?

৭ : বাংলাদেশের বর্তমানে আয়ুষ্কাল বা জীবনকাল ৪৭ বছর চলছে; এটিকে বিভিন্ন ধাপে বা পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়; সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা ২০১৮ সালে এসে কতটুকু টিকবে বা টিকবে না? ৮ (শেষ প্রসঙ্গ) : বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো পার্লামেন্টারি নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর আগে-পরে মানুষের চাওয়া-পাওয়া কী ছিল এবং সেটা কতটুকু মেটানো সম্ভব হয়েছে, যা মূল্যায়নের দাবি রাখে। অষ্টম প্রসঙ্গ আমরা আগামী কলামে আলোচনার চেষ্টা করব। আজকের লেখা শেষ করার আগে কলামের শেষ অনুচ্ছেদে মহররম সম্পর্কে কিছু কথা উপস্থাপন করছি।

মহররমের প্রসঙ্গ অনুধাবনের আহ্বান
প্রচলিত হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আজ হিজরি পঞ্জিকার শেষ মাস তথা জিলহজ মাসের ২৪ তারিখ। ১৪৩৯ হিজরি সাল শেষ হওয়ার পথে। ১৪৪০ হিজরি সাল শুরু হবে পাঁচ অথবা ছয় দিন পর। প্রসঙ্গটি গত সপ্তাহের কলামেও এনেছিলাম। সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বহু দেশে ১৪৪০ হিজরি যে দিন শুরু হবে, বাংলাদেশে সে দিন শুরু না হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ। কেন একই দিনে শুরু হচ্ছে না বা একই দিনে শুরু হলে ভালো হবে না মন্দ হবে, ওই আলোচনায় যাচ্ছি না। সংক্ষেপে আমার আবেদন, আমরা যেন মহররম মাসের গুরুত্ব অনুধাবন করি। আমার আবেদন, আমরা যেন একষট্টি হিজরি সালের ১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে, কারবালার ময়দানে অনুষ্ঠিত অসম যুদ্ধের কথা স্মরণ ও মূল্যায়ন করি। আমার আবেদন, কারবালার ময়দানে, প্রিয় নবীজীর সা: প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রা:-এর শাহাদতবরণের প্রেক্ষাপট স্মরণ করি এবং সেখান থেকে শিক্ষা আহরণের চেষ্টা করি। আরো আবেদন, মুসলিম উম্মাহর একজন হিসেবে আমরা যেন আত্মবিস্মৃত না হই; বরং সচেতন হই। সর্বশেষ আবেদন, আসুন, আমরা পারস্পরিকভাবে নিজেদের অনুভূতি বিনিময় করি আর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো প্রসঙ্গে আলোচনা করি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd


আরো সংবাদ



premium cement