২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
প্রতিষ্ঠার চার দশক

বিএনপি কি আসলেই পথ হারিয়েছে?

প্রতিষ্ঠার চার দশক - ছবি : নয়া দিগন্ত

পয়লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি চল্লিশ পেরিয়ে একচল্লিশে পা দিচ্ছে। বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলকে এবার একেবারেই ভিন্ন পরিবেশে ও প্রেক্ষাপটে দিনটি পালন করতে হচ্ছে। এক দিকে দলের চেয়ারপারসন ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির কাণ্ডারি বেগম খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে বন্দী রেখে চরম বৈরী পরিস্থিতিতে দিনটি উদযাপন করতে হচ্ছে। অন্য দিকে, মাস তিনেকের মধ্যে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যেসব চ্যালেঞ্জ দলটির সামনে রয়েছে তা মোকাবেলায় কী ধরনের কর্মকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে, তা দেখতে উদগ্রীব হয়ে আছেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ রাজনীতিসচেতন দেশবাসী।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নানাভাবে বিশ্লেষণ হচ্ছে। অনেকে বলতে চাইছেন যে, বিএনপি ‘পথ হারিয়েছে’। কারো কারো বিশ্লেষণে বিএনপির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বা অন্ধকার। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা এলোমেলো বলেও অনেকের অভিমত। বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত- এমন অনেক বিশ্লেষকও বিএনপির আদর্শচ্যুতির অভিযোগ তুলছেন। আবার কেউ কেউ প্রতিপক্ষ ঘরানার হয়েও বন্ধুবেশে নসিহত দিচ্ছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা, দল পরিচালনার কলাকৌশল, জোট রাজনীতির সুফল-কুফল এমনকি কাকে সঙ্গে রাখা উচিত আর কাকে পরিত্যাগ করা জরুরি সে ‘জ্ঞান’ও দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট মনে হয় কারণে-অকারণে বিএনপিকে একহাত না নিলে কলমে জোশ পান না।

আসলে বিএনপির ভাগ্য এমনই। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা ১৯৭৫ সালের ১৬ জুনে এক আদেশে বিলুপ্ত হওয়া শত শত সংবাদপত্রকে পুনর্জীবন দিয়েছিলেন, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও সংবাদপত্র প্রকাশনাকে করেছেন অবারিত, যে দলের চেয়ারপারসন বহু সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন ও বেসরকারি টিভির লাইসেন্স দেয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন, সে দল সব সময়ই বেশির ভাগ মিডিয়ার বিরাগভাজন। কী ক্ষমতায়, কী বিরোধী দলে- সব সময়ই সংবাদপত্রে সাধারণত নেতিবাচক শিরোনাম হয় বিএনপি।

প্রথমে আদর্শচ্যুতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে তার রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট। জাতিকে কোথায় নিতে চান, সে সম্পর্কে তার মধ্যে কোনো ধোঁয়াশা ছিল না। ‘আমার রাজনীতির লক্ষ্য’ নিবন্ধে তার দলে সদ্য যোগ দেয়া সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘এখন আরো শক্ত রাজনীতি করতে হবে। এ ধারায় যারা টিকতে পারবে না, তারা থাকতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘শুধু জাতীয়তাবাদে বিশ^াস করে বসে থাকলে চলবে না। এর সদস্য হওয়াই সব কিছু নয়। জাতীয়তাবাদের অনুশীলন করতে হবে, প্র্যাকটিস করতে হবে। তবেই আপনারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অনুসারী হতে পারবেন।’

দূরদর্শী ও বিচক্ষণ জিয়াউর রহমান তখনই বুঝেছিলেন, কেবল বিপুল সমর্থক দিয়েই কোনো রাজনীতি সফল হয় না। দলের কোটি কোটি সদস্য থাকলেই প্রতিপক্ষের কূটচাল ও অপরাজনীতি মোকাবেলা করে বিজয় অর্জন করা যায় না। রাজনৈতিক বা আদর্শিক বিশ^াস নিয়ে ঘরে বসে থাকলেই সাফল্য ধরা দেয় না; বরং সেই আদর্শের রাজনীতি করতে হবে শক্তভাবে। অনুশীলন করতে হবে দৃঢ়প্রত্যয়ে।

স্বাধীনতা-উত্তর সরকার সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম, রক্ষীবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী গঠন এবং ভিন্নমত প্রকাশের সব পথ রুদ্ধ করে দেয়ার পর এ দেশে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে- তখন তা কেউ ভাবেনি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি এবং ৩ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লবের পর বস্তুত ৭ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির সূচনা। সে দিন সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জিয়াউর রহমান সিপাহি-জনতার সমর্থনে ক্ষমতাকেন্দ্রে আবির্ভূত হলেন।

পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান, তখন অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ওই কঠিন সময়ে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি শক্তিশালী দেশপ্রেমিক প্ল্যাটফর্মের। রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে তার শাসনকে দ্রুত অসামরিকীকরণের লক্ষ্যে একের পর এক সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেন। জিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তারই পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হলো। একই বছর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়।

১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাতীয় ফ্রন্টের প্রার্থী জেনারেল ওসমানীকে হারিয়ে জিয়াউর রহমান বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

প্রেসিডেন্ট জিয়া বিএনপি গঠনের সময় যে বিষয়গুলো সামনে রেখেছিলেন- সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত ও সংহত ইস্পাত কঠিন গণঐক্য, জনগণভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত অক্লান্ত প্রয়াসের মাধ্যমে লব্ধ জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি। এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের সোনালি ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় ও সংরক্ষিত করে রাখাই হচ্ছে আমাদের সবার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। বিবর্তনশীল ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয়, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গণচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কালজয়ী রক্ষাকবচ।’

বিএনপি পথ হারিয়েছে না সঠিক পথে আছে তা মূল্যায়নের জন্য দলের প্রতিষ্ঠাতার রাজনৈতিক দর্শন কতটা অনুসৃত হচ্ছে তা পরখ করে দেখা যেতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ঐক্য ও সমন্বয়ের রাজনীতি এখনো বিএনপির রাজনীতির মূল কথা। শহীদ জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরি বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঐক্যের রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে এগোনোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিকে আরো বেগবান করতে নিরলসভাবে তিনি কাজ করেছেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া এখনো জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পুরোধা। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ঐতিহ্যের ধারক এবং এ দেশের জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ প্রদর্শক।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দেশবাসীকে এক কাতারে দাঁড় করানো খালেদা জিয়ার অবিস্মরণীয় সাফল্য। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট শুধু নয়, দেশের নিবন্ধিত বেশির ভাগ দলকে নির্বাচনটি বর্জনে এক করতে পেরেছিলেন তিনি। এ কারণে মাত্র ৫ শতাংশের মতো ভোটারের উপস্থিতিতে কলঙ্কিত নির্বাচনী মহড়া সম্পন্ন করতে হয়েছে। অর্ধশত কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এটাকে শহীদ জিয়ার ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গণচেষ্টার যে নীতি, তারই একটি সাফল্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে টিকে যাওয়া কিংবা ভোট বর্জনের ফসল ঘরে তুলতে না পারা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ ও কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনীতির আলাদা পাঠ। এটা খালেদা জিয়া বা বিএনপির একক ব্যর্থতা হিসেবে চিত্রিত করলে সুবিচার করা হবে না।

দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রমনা মানুষের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজনীতি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বেগম জিয়া নিজে প্রত্যয়ী। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রেখে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চার নীতি থেকে দলকে বিচ্যুত হতে দেননি তিনি। চল্লিশ বছরের স্মৃতিবিজড়িত নিজ বাসস্থান হারানো, নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে এক সন্তানের মৃত্যু, ভগ্ন মেরুদণ্ড নিয়ে আরেক সন্তানের নির্বাসিত জীবন, প্রতিহিংসামূলক কয়েক ডজন মামলায় বছরের পর বছর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েও তাকে নতিস্বীকার করানো যায়নি। রাস্তায় নামলেই হামলা হয়েছে। বালির ট্রাকে বাসা ও অফিসে মাসের পর মাস অবরুদ্ধ থেকেছেন তিনি। তার জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। সর্বশেষ একটি ভিত্তিহীন ও হাস্যকর মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে ছয় মাসেরও বেশি সময় পরিত্যক্ত ও বাসের অযোগ্য কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী আছেন। তবু আপসের চোরাবালিতে পা দেননি। শারীরিক অসুস্থতা ও নিঃসঙ্গতাজনিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার, পরমতসহিষ্ণুতা, সততা, আগ্রাসনবিরোধী আপসহীন সংগ্রামী মনোভাব এখনো প্রশ্নাতীত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-ভরসার কেন্দ্রে তার অবস্থান।

দল হিসেবে বিএনপির পথচলা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের বুলেটে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ও সফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের মধ্য দিয়ে শিশু বিএনপির অপমৃত্যু ঘটতে পারত, কিন্তু তা ঘটেনি। স্বৈরশাসক এরশাদের প্রধান টার্গেট ছিল বিএনপি। এ দলের আদর্শ-লক্ষ্যের আদলে এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেছেন। চাপ, প্রলোভন আর কেনাবেচার হাট বসিয়েও বিএনপির অগ্রযাত্রা রোধ করা যায়নি; বরং গৃহবধূ খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বে ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের পথ বেয়ে ১৯৯১ সালে সবচেয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে স্বমহিমায় ক্ষমতায় ফেরে বিএনপি। দেশে যতবার সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে ততবারই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মাথায় বিজয়ের মুকুট উঠেছে। ১৯৯৬ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করতে না পারলেও ১১৬ আসন নিয়ে বসেছিল দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বিরোধী দলের আসনে।

২০০১ সালের অবিস্মরণীয় ভোটবিপ্লবে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন জয়ের মধ্য দিয়ে আবারো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় বেগম জিয়ার ওপর। ওয়ান-ইলেভেনে মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকারের সময়ও প্রধান টার্গেট ছিল দলটি। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে, তারেক রহমানের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে সংস্কারের নামে বিএনপি ভাঙা এবং ‘খালেদা মাইনাস ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের মরিয়া অপচেষ্টা হয়। তখনো দোর্দণ্ড প্রতাপশালীদের প্রচণ্ড চাপের কাছে নতিস্বীকার করেননি গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। নির্বাসনে পাঠানোর প্রাণপণ চেষ্টাও বিফল হয়ে যায়। দল ভাঙার মিশন নস্যাৎ হয়ে যায়।

বিপর্যয় কাটিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল এই দল। কিন্তু আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির ক্রীড়নকদের নীলনকশায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয় দলটিকে। তার পর থেকে ১০ বছর ধরে বিএনপি ধ্বংসের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে বিরামহীনভাবে। মামলা, হামলা, খুন, গুম, নির্যাতন, নিপীড়নের সব সীমা ছাড়িয়েছে। তবুও বিএনপির জনপ্রিয়তা ও খালেদা জিয়ার দৃঢ়চেতা নেতৃত্বকে হুমকিতে ফেলা যায়নি।

সর্বশেষ নেত্রীকে জেলে নিয়ে বিএনপিকে দুর্বল ও টুকরো টুকরো করার মিশনও মুখ থুবড়ে পড়েছে। উল্লেখ করার মতো একজন নেতাকেও দলচ্যুত করা যায়নি। দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা, মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ শীর্ষ নেতাদের সমন্বিত প্রয়াস আর জেলবন্দী বেগম জিয়ার অটুট মনোবলে চরম প্রতিকূলতায়ও বিএনপি টিকে আছে ভালোভাবেই। এটা এখন স্পষ্ট, বর্তমান সরকারের অধীনে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনে নিতেই খালেদা জিয়ার ওপর চলছে নিদারুণ অবিচার। সাজার মামলাসহ ৩৩টিতে জামিনে থাকা সত্ত্বেও অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রীকে আটকে রাখা হয়েছে ঠুনকো মামলার জালে। কিন্তু তাকে যারা চেনেন তারা ভালো করেই জানেন, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করার মানুষ নন তিনি। এবার ঈদের পর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম কারাগারে দেখা করে এসে জানিয়েছেন, অসুস্থতা সত্ত্বেও বেগম জিয়ার মনোবল দৃঢ় ও অটুট। আপস নয়, সংগ্রামই তার পছন্দের পথ। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন আবারো।

সব দল ও সংগঠনেই কিছু বর্ণচোরা, সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্ধ লোক থাকে। দীর্ঘ এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কোনো কোনো নেতার মধ্যে কর্তব্যপরায়ণতা ও নিষ্ঠার কিছু ঘাটতি যে দেখা দেয়নি, তা হলফ করে বলার সুযোগ কম। শহীদ জিয়া ঘোষিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত ও সংহত ইস্পাতকঠিন ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে অক্লান্ত প্রয়াসের অভাবও দেখা গেছে সময়ে সময়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের পূর্বাপর এবং ২০১৫ সালের টানা আন্দোলনকালে কিংবা ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঘোষিত ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’র কর্মসূচির ক্ষেত্রে দু-একজন দায়িত্বশীল নেতার আপসকামী ও আত্মঘাতী ভূমিকা দলটিকে বড় ক্ষতি ও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এর কারণ হচ্ছে, শহীদ জিয়ার অপরিসীম দেশপ্রেম, দুরন্ত সাহস, নিরেট সততা ও কর্মনিষ্ঠার যে শিক্ষা তা ধারণ ও লালনের অভাব। সর্বোপরি প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধ রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে টেনে নিয়মিত তাদের পরামর্শ গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী সময়োপযোগী দৃঢ় পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও কিছুটা ঘাটতি যে ছিল না বা নেই, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

ক্ষমতাসীন দুর্বিনীত শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যখন বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আগামীতে দলটি সম্পর্কে নানা কথা বলা হয়েছে, তখন চল্লিশের তাৎপর্যপূর্ণ বয়সে উপনীত হয়েছে বিএনপি। নেত্রীকে মুক্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ের সুকঠিন লড়াই-সংগ্রামে চল্লিশতম বার্ষিকীর দিনটি কতটা উদ্দীপনা ও প্রেরণা জোগাবে তা দেখার আগ্রহ রয়েছে সব মহলে। আগামী দিনে দলটি আরো সজাগ ও সতর্ক হয়ে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করবে, এটাই দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement