২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যদি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয়!

যদি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয়! -

জাতীয় সংসদ একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় এর চলমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণের ভাবনার অন্ত নেই। বর্তমান সংসদকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ বলা যাবে না। তবে এ কথা রাজপথে-জনসমাবেশে বলা যাবে না, কেউ বললে ক্ষেত্রবিশেষে জানমালের নিরাপত্তার মুখোমুখি হতে হবে। যার প্রমাণ পত্রিকায়ই এসেছে এমনভাবে যে, সরকারের প্রতিপক্ষদের সভা-সমাবেশ হলেই ভাঙচুর, পুলিশের পারমিশন নেই এ অজুহাতে লাঠিচার্জ বা গ্রেফতার, এমনকি সরকারের ভিন্নমতের ৫-১০ জন একত্র হলেই নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার এবং সভা না করলেও এ অজুহাতে কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার।

অতঃপর রিমান্ডবাণিজ্য, জেলগেটে গ্রেফতার, বার্গেনিং ও বাণিজ্য প্রভৃতি। ‘এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়’- এ কথা শুনলে সরকারপক্ষের অনেকের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। প্রতিপক্ষের সমালোচনা সহ্য করা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। সরকারবিরোধী কথা বললে সরকার কতটুকু সহ্য করছে, তা কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকারীদের প্রতি সরকারের আচরণ থেকেই অনুমান করা যায়।
চলতি বছরের অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ঘরে-বাইরে সব সভাতেই তর দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। আর শরিক দল অর্থাৎ, দৃশ্যমান শরিকদল এরশাদ ভোটের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এখনো প্রকাশ করেনি এর যৌক্তিক কারণ তিনটি : ১. বিএনপি চেয়ারপারসন কারারুদ্ধ, ২. ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সরকারপ্রদত্ত আইনি প্রতিবন্ধকতার কারণে নির্বাচনে অংশ নেয়া তো দূরের কথা, সরকারের রোষানলে দেশেই ফিরতে পারবেন না এবং ৩. অন্য দিকে বিএনপিই প্রথম ঘোষণা দিয়েছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া শেখ হাসিনার দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।

২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি, এ নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এটা প্রমাণিত হয়েছে- দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তা ছাড়া, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যেভাবে পদলেহনে অভ্যস্ত, শুধু এই পদলেহন সংস্কৃতির কারণে এ দেশে কোনো দিনই দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আগে যে দাবিটি ছিল শুধু বিএনপি তথা ২০ দলের, এখন বিষয়টি নিয়ে দাবি তুলেছেন সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শুধু সরকারের কাছে যারা নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়েছে তারা ছাড়া। সরকারের সাথে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন, জাতীয় পার্টি ছাড়া যাদের মাঠে কোনো অস্তিত্ব দেখা যায় না। তবে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় এবং লক্ষণে এটাও মনে হয় যে, দিনে দিনে মতিয়া চৌধুরীর মতো আওয়ামী লীগের সাথে তারা বিলীন হয়ে যেতে পারে, যেমন- মিসেস চৌধুরী একসময়ে আওয়ামী লীগ তথা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতির কঠোর সমালোচক হয়েও এখন সরকারের প্রথম সারির পর্যায়ে রয়েছেন। সরকারের বাইরে যারা এখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছেন, তাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। যারা একসময়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন যখন ইনু, মেনন ও মতিয়ারা ছিল আওয়ামী লীগের চরম সমালোচক।

একতরফা নির্বাচন এবং আসন্ন নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে করার জন্য সরকার সংবিধানকে ব্যবহার করছে। মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকার সংবিধান ছাড়া এখন কিছু বুঝেন না এবং সংবিধান থেকে এক ইঞ্চি চুল পরিমাণও সরবেন না। বিনাযুদ্ধে সুচাগ্র পরিমাণ ভূমি ছেড়ে না দেয়ার মতোই সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করার দীপ্ত শপথবাক্য বারবার পাঠ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল আইয়ুব, জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল এরশাদের জাতির উদ্দেশে ভাষণ শুনেছি। এখনো শুনছি যে, জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না। অর্থাৎ, সংবিধানে যা আছে সে মোতাবেকই রাষ্ট্র পরিচালনা বা ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। কিন্তু নিরস্ত্র জনতার দাবির মুখে সশস্ত্র জেনারেলদের সংবিধান রক্ষা করার শপথ টেকেনি। জনতার দাবির মুখে যেখানে রাষ্ট্র খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়, সেখানেই নির্বাচনপদ্ধতি বিষয়ে সংবিধানের দোহাই তো একটি বাতুলতামাত্র।

সংবিধান কী? সংবিধান কি শুধু একটি ছাপানো বই? না কি এটি একটি স্বর্গীয় বাণী, যা ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না! অনেক রাষ্ট্রেই লিখিত সংবিধান নেই, তথাপিও এই সংবিধানই গণমানুষের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ। সংবিধান নাগরিকদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। একদিকে সরকার অনির্বাচিত হয়ে জনগণের মুখকে স্তব্ধ করার জন্য সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার যেমন : সভা-সমাবেশ করার অধিকার, মুক্তচিন্তার অধিকার ও রাজনৈতিক সংগঠন করার প্রভৃতি অধিকার টুঁটি চেপে ধরছে, অন্য দিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পথ সুগম ও দৃঢ় করছে।

সংবিধান ক্ষমতাসীনদের ছেলের হাতে মোয়া হতে পারে না। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনই সংবিধান। প্লেটো তার প্রণীত রিপাবলিক বইতে উল্লেখ করেছেন- রাষ্ট্র একটি শ্রেণী দিয়ে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ, দেশ শাসন বা প্রজাদের শাসন করার জন্য একটি গোষ্ঠী থাকবে, তারাই দেশ শাসন করবে। তারই ধারাবাহিকতায় হিটলার একটি নাৎসি বাহিনী গঠন করেছিলেন। যাদের হাতে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, এমনকি গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে শুধু রাষ্ট্র শাসনের অজুহাতে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ব্রিটিশ যে আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী আমলাদের দিয়ে তাদের ইচ্ছামাফিক রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। যেসব রাষ্ট্র এখনো রাজতান্ত্রিক অর্থাৎ, রাজার বিচার-আইন ও শাসন ক্ষমতার জন্য এবং রাজার উত্তরাধিকারই রাজা, যেখানে গণমানুষের মতামতের প্রয়োজন হয় না এবং যেখানে মানুষ কাজ করবে আর বেতন পাবে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে না- তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যে রাষ্ট্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, সে রাষ্ট্রে সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকারকে কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না, উচিতও নয়। কিন্তু এ স্বেচ্ছাচারিতা সম্ভব হচ্ছে তার একমাত্র কারণ, দেশে রাজনীতি নেই। রাজনীতি হয়ে পড়েছে একটি পণ্যসামগ্রীর মতো, যা অর্থের বিনিময়ে এখন ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। আগে সমাজের বিবেকসম্মত মানুষ, যারা নীতিকে বিসর্জন দেয়নি, অর্থের বিনিময়ে মাথা বিক্রি করেনি, সেসব ত্যাগী বিরোচিত মানুষ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জাতির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এখন ব্যাংক লুটেরা, সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানীদের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। ফলে এ দেশ ও জাতি রাজনীতিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো পাল্টাপাল্টি অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য ব্যাংক লুটেরাদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে। ফলে রাজনীতিতে ত্যাগী মাঠকর্মীদের স্থান বেদখল হয়ে পড়ায় রাজপথের রাজনীতি এখন চলে গেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। ফলে স্বৈরাচার জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের বুকের ওপর চেপে বসেছে। এ জন্যই আবারো একতরফা আরেকটি নির্বাচনের কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না, যদি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement