২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সমকালীন প্রসঙ্গ

১৫ আগস্টের বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট এবং পরিণতি

১৫ আগস্টের বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট এবং পরিণতি - সংগৃহীত

১৫ আগস্টের খলনায়কদের একাংশ মিথ্যাকে বিশ্বাসযোগ্য করে বলেছেন, তারা কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কাজটি করেননি। হত্যাকাণ্ডের পর দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে হত্যাকারীরা বারবার অত্যন্ত স্পষ্ট ও খোলামেলাভাবে বলেছেন, তারা দীর্ঘ দিন ধরে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে অপকর্মটি করেছেন।

এ কাজের জন্য তাদেরকে কোনোকালে যেমন অনুতপ্ত বলে মনে হয়নি, তেমনি তাদের মুখমণ্ডলে কোনো হতাশা-বেদনা-ক্ষোভ কিংবা আনন্দের বলিরেখা ফুটে ওঠেনি। তারা নিজেদের ‘নফস’ অর্থাৎ রাগ-ক্ষোভ, বেদনা, কামনা-বাসনা ইত্যাদির দ্বারা তাড়িত হয়ে ১৫ আগস্টের নির্মমতা যেমন ঘটাননি, তেমনি কর্মটির জন্য কোনো ভৌতিক, অলৌকিক কিংবা শয়তানি শক্তির প্ররোচনাকেও দায়ী করেননি। তারা বলতে গেলে অনেকটা পাপেটের অদৃশ্য সুতোর টানে বিদেশী প্রভুদের কথায় নেচেছেন এবং তাদের দেয়া মাস্টারপ্ল্যান ও ব্লুপ্রিন্ট মতো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মানবজাতির ইতিহাসের প্রধানতম নির্মম একটি রক্তাক্ত ফলক বাঙালি জাতির ললাটে লাগিয়ে দিয়েছেন।

১৫ আগস্ট নিয়ে এ যাবৎকালে যেসব প্রামাণ্য দলিল তৈরি হয়েছে তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর দুটো বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির সরাসরি মদদে এই জঘন্য কুকর্মটি সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে এসে খুনিরা হত্যার প্লট রচনা করে ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য এজেন্ট নিয়োগ করেন। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও সুশীলসমাজের যেসব লোক বঙ্গবন্ধু সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে যেরূপ এজেন্ট নিয়োগ করা হয়, তদ্রুপ চরম সরকারবিরোধী ও বিক্ষুব্ধ লোকদের মধ্য থেকেও খুব সতর্কতার সাথে এজেন্ট মনোনীত হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট বিদেশী রাষ্ট্রশক্তির বাঘা বাঘা সব গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঘন ঘন ঢাকা আসতে আরম্ভ করেন এবং দূতাবাসের বাইরে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা স্টেশন গড়ে তোলেন। তারা এতটা সতর্কতা ও দ্রুততার সাথে কাজ করেন যে, ঘটনা ঘটার পর তাদের এজেন্টরা পর্যন্ত ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল।

পর্দার আড়ালে বড় বড় রুই-কাতলা ধরনের এজেন্টকে অ্যাবস্ট্রাকট (Abstract) পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র সত্তায় পরিণত করে তারা ১৯৭৫ সালের মে-জুন মাসের মধ্যে পুরো বাংলাদেশে পরস্পরবিরোধী দুটো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলেন। পঁচাত্তরের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু সরকারের ঘনিষ্ঠজনেরা মনে করতে থাকেন, তাদের সব প্রতিদ্বন্দ্বী সমূলে বিনাশ হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে তারা দৃশ্যত কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাচ্ছিলেন না অথবা খুঁজেও পাচ্ছিলেন না।

অতি সতর্কতার সাথে এবং সুকৌশলে রাজনীতির মাঠের সরকারবিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয় ক্ষমতাসীনদের মনে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস জন্ম দেয়ার জন্য। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যেসব রাষ্ট্র দুই বছর ধরে সরকারের বিরুদ্ধে সরব ছিল, তারাও জুন-জুলাই মাসে এসে রাতারাতি সুর পরিবর্তন করে ফেলে। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাতে আরম্ভ করে। ফলে সরকার সংশ্লিষ্টরা এক ধরনের আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে আরম্ভ করে দেন।

১৫ আগস্টের অনুঘটক হিসেবে আমরা প্রায় সবাই খন্দকার মোশতাক, কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর ডালিম প্রমুখকে মুখ্য খলনায়ক বিবেচনা করি এবং সেভাবেই প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে থাকি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিদেশী রাষ্ট্রশক্তিগুলো তাদের মূল পরিকল্পনা অনুসারে চুনোপুঁটি, পাপেট আর বলির পাঁঠা প্রকৃতির রাগচণ্ডাল এবং বাচাল এজেন্টদের সামনে তুলে ধরেছে এবং ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী রাঘব বোয়ালদের পর্দার আড়ালে রেখেছে।

তারা নিজেদের পরিকল্পনা যেমন নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা করেনি, তেমনি এজেন্টদের কাউকে জানায়নি, আসলে সেদিন কী ঘটতে যাচ্ছে। ফলে খলনায়কেরা তাদের ওপর অর্পিত নির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে পুরো চক্রান্তের মাস্টার প্রিন্টের ব্যাপারে বেখবর ছিল। মূল চক্রান্তকারীরা তাদের পাপেট এজেন্টদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিল এবং সর্বজনীন গোয়েন্দা সূত্র মতে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ অসম্ভব করে তুলেছিল।

১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, হত্যা মিশনে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন দল ও উপদলে ছিল বিভক্ত।

একটি দল যেমন অপর দল সম্পর্কে বেখবর ছিল, তেমনি ঘটনা ঘটানোর অল্প কিছুক্ষণ আগেই কেবল তাদের জানানো হয়েছিল করণীয় সম্পর্কে। মূল হত্যাকারী যিনি সরাসরি গুলি চালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ওপর, সেই সুবেদার মুসলেহ উদ্দিনের সাথে অন্য চক্রান্তকারীদের আগে বৈঠক হয়েছিল, এমন কথা শোনা যায়নি। একইভাবে মেজর নুর যিনি মুসলেহ উদ্দিনের মতো সরাসরি গুলি চালিয়েছিলেন, তার সাথে মুসলেহ উদ্দিনের ঘটনা-পূর্ববর্তী পরামর্শ ও বৈঠক হয়েছে, এমন দলিলও পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে আসা মেজর মহীউদ্দিন আসলে জানতেন না যে- বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হবে এবং ইতোমধ্যে শেখ মনিসহ আরো অনেককে খুন করা হয়েছে।

চক্রান্তকারীদের মাস্টার প্রিন্ট অনুযায়ী, ঘটনাস্থলে গিয়ে এজেন্টরা এক দিকে যেমন পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তেমনি বিপরীতমুখী কমান্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য ভয়াবহ, বেসামালযোগ্য ও রহস্যময় করে তোলে।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ, বঙ্গভবনে কর্নেল ফারুক-রশিদদের দাপট, জেলহত্যা এবং ৭ নভেম্বরের ঘটনাগুলো বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, চক্রান্তকারীরা কেবল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করার পরিকল্পনাই করেছিল। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রক্ষমতা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়ে তারা কোনো ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেনি। ফলে সারা দেশে শুরু হয়েছিল ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়। এতে করে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়াই ছিল মূল চক্রান্তকারীদের অভিলাষ। কারণ, তারা যদি কেবল ক্ষমতার পটপরিবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর বিনাশ চাইতেন, তবে ১৫ আগস্টের পরবর্তী ঘটনাগুলো ভিন্ন হতো। চক্রান্তকারীদের মোটিভ ছিল দীর্ঘমেয়াদে সুফল লাভ করা।

খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ এবং তার মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের হুড়োহুড়ি প্রমাণ করে, তারা অনেকেই বিষয়টি বিচ্ছিন্নভাবে জানতেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুবিধাভোগী হিসেবে নিজেদের আগে থেকেই প্রস্তুত রেখেছিলেন। অন্য দিকে, যারা বিষয়টি জানা তো দূরের কথা, সামান্য আন্দাজও করতে পারেননি তারা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং পরে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করেন। তারা সংখ্যায় ছিলেন অতি নগণ্য এবং দীর্ঘ দিন ধরে দলীয় রাজনীতিতে নানাভাবে উপেক্ষিত। ফলে তাদের প্রতিবাদ তাদের কারো কারো জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

অনেকে দেশত্যাগে বাধ্য হন- কেউ কেউ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন, আবার কেউ কেউ জেল-জুলুমের কবলে পড়েন। সুবিধাবাদীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। কারণ প্রথমত, তারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের নৈতিক মান ছিল অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে। তা ছাড়া তাদের নেতৃত্বগুণও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পর্যায়ে ছিল না। ফলে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন অথবা হত্যায় মদদ ও রসদ জুগিয়েছিলেন, সেই উৎসাহে অচিরেই ভাটা পড়ে এবং নিয়তির নির্মম পরিহাসে তাদের বেশির ভাগই সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে প্রাণ নিয়ে পালানোর জন্য উপায় খুঁজতে থাকেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। তৎকালীন দুনিয়ার রূঢ় বাস্তবতা ছিল, কোনো দেশ যদি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে পা বাড়াত, তবে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক বিশ্ব সমুদয় নীতি ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগত। বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা শক্তিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেভাবে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ে আশ্রয় নেয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এজেন্ট হিসেবে ভারত প্রথম থেকেই সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল।

জওয়াহেরলাল নেহরুর আমলে সমগ্র ভারতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি এতটাই নির্মতা দেখাতে শুরু করে, যা কিনা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের জুলুম-অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে যায়। হাজার হাজার কমিউনিস্ট নেতাকে গুম-হত্যার মাধ্যমে শেষ করার পাশাপাশি জেল-জুলুম-হুলিয়া চলতে থাকে অবিরতভাবে। আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলনসহ সব সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামকে পায়ে পিষে মারার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত যখন ভারত কঠোর হাতে বাস্তবায়ন করছিল, তখন সীমান্তের অপর পারে বাকশালের আত্মপ্রকাশ তারা কিভাবে গ্রহণ করবে, তা বোঝার জন্য খুব বেশি পাণ্ডিত্যের দরকার পড়ে না।

গণতন্ত্রের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ গ্রহণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ইসলামপ্রীতি এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বহু আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে ফেলে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর আকস্মিক সফরের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনেক আন্তর্জাতিক শক্তিবর্গের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার নব্য শত্রুদের কতটা পাত্তা দিতেন কিংবা তাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা সম্পর্কে কতটা সচেতন ছিলেন তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে আপনজন ও শুভানুধ্যায়ীরা তাকে বিভিন্ন সময়ে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকার যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা তিনি কখনোই গা করেননি; বরং হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।

তিনি সব সময় মনে করতেন, বাঙালি তাকে মারবে না অথবা মারতে পারবে না। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি সম্পর্কে যেরূপ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, তদ্ররুপ কিন্তু ১৯৭৩ সালেও ছিলেন না। এমনকি পাকিস্তান জমানার দুর্বিষহ দিনগুলোয় তিনি রাজনীতি সম্পর্কে কতটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখা যায়।

১৫ আগস্টের চক্রান্তকারীদের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল, তারা বঙ্গবন্ধু এবং তার আশপাশের প্রভাবশালী লোকজনদের মধ্যে এক ধরনের নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর আত্মতৃপ্তির অভ্যাস ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তারা সাধারণ জনগণের মধ্যে সরকার সম্পর্কে সীমাহীন ভয়, ঘৃণা ও বিরক্তিকে একত্রে মিক্সচার বানিয়ে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পেরেছিলেন।

তৃতীয়ত, তাদের এজেন্টদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যা কিছুই করা হোক না কেন, তা জনগণ মেনে নেবে- কেউ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসবে না এবং তারা সফল হতে পারবেন।

চতুর্থত, তারা সরকারবিরোধী সব পক্ষকে অত্যন্ত সফলতার সাথে সরকারের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করিয়ে তাদের মনে সরকার সম্পর্কে ঘৃণাবোধ জাগ্রত করতে পেরেছিলেন।
চক্রান্তকারীরা কেবল একটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর জন্যই চক্রান্ত করেননি, বরং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রভুত্ব কায়েমের জন্য এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেছিলেন। আর এ কারণে পর্দার আড়ালে থাকা ১৫ আগস্টের রাঘব বোয়াল প্রকৃতির চক্রান্তকারী খলনায়কদের যাবতীয় কুকর্ম গোপন রাখা হয়েছে, যাতে অনাগত দিনে তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো রাজনীতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে মূল নেতৃত্ব নিজেদের হাতে রাখতে পারেন। খন্দকার মোশতাক যেভাবে বঙ্গবন্ধুর অন্দরমহল থেকে শুরু করে ক্ষমতার সব কেন্দ্রবিন্দুতে অবাধে বিচরণ করতেন এবং দাপট দেখাতেন- তদ্রুপ পঁচাত্তরের পর্দার আড়ালের খলনায়কেরা পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোয় সমদাপটে ক্ষমতা দেখিয়ে এসেছেন। মোশতাকের সাথে তাদের পার্থক্য হলো, মোশতাককে সবাই চেনেন; কিন্তু তাদের সেভাবে চেনেন না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তার অবর্ণনীয় ট্র্যাজেডি কেবল বঙ্গবন্ধুর পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং আওয়ামী লীগকে আঘাত করেনি; বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের কিছু ব্যর্থতা, কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এবং কিছু দৈবদুর্ঘটনাকে পুঁজি করে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার অধিকারী একজন কিংবদন্তির রাজনৈতিক মহানায়ককে অজনপ্রিয়তার মাইলফলকে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে চক্রান্তকারীরা যে দক্ষতা দেখিয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

চক্রান্তকারীরা ১৫ আগস্টের ঘটনাকে একটি ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে যুগে যুগে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য যে অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে, তা কবে নাগাদ বন্ধ হবে, বলার সময় এখনো আসেনি। প্রতি বছর আগস্ট মাস এলেই একটি অজানা ভয় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে যেমন তাড়া করে, তেমনি পঁচাত্তরের ঘাতকগোষ্ঠীকে দেখা যায় নানাভাবে উল্লাস নৃত্যে নতুন কোনো পঁচাত্তর ঘটানোর নবতর প্রেক্ষাপট সৃষ্টির অপচেষ্টার মহরত দিতে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement