১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন

কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন - ফাইল ছবি

স্যালুট জানাই কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের, যারা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গণপরিবহন ড্রাইভারদের ঔদ্ধত্য প্রতিরোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘুষের রাজত্বের কারণে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা রোধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে; যা নিতে পারেনি সরকার বা দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী সমাজ। সরকারের পক্ষে যে মন্ত্রীর সড়ক সচল রাখার কথা, তার সব সময় ব্যয় হয় বিএনপি-বিরোধী বিষোদগারে। বিভিন্ন কারণে তো বটেই, তা ছাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা সব সময়ই সরকারি দল। ফলে যাত্রী ও জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালাতে তারা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। সরকারের মন্ত্রী শাজাহান খান ও প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের নেতৃত্বে রয়েছেন। বিএনপি আমলে অগ্রভাগে রাখা হয়েছিল গোলাম মোহাম্মদ সিরাজকে (বগুড়া), যাকে এখন বিএনপিতে দেখা যায় না, বরং সংস্কারবাদী হয়ে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

পরিবহন মালিকেরা যাত্রীদের শোষণ করেন, শোষণ করেন শ্রমিকদের। কৌশলে মালিক নেতারাই শ্রমিকদের নেতা থেকে যান। ফলে এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে কোনো স্থায়ী বেতনকাঠামো প্রণয়ন তো দূরের কথা, মোটিভেশন সম্পর্কেও তাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। অবসর নেয়ার পর তাদের আর্থিক সুবিধার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। যাত্রীদের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করতে হবে, যাত্রীদের জীবন রক্ষার্থে একজন ড্রাইভারের কতটুকু দায়িত্বজ্ঞান থাকা দরকার, সে সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করা হয়নি; বরং কিভাবে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, একে অপরকে ওভারটেক করে, কিভাবে রাস্তা থেকে বেশি যাত্রী তোলা যায়- সেদিকেই পরিবহন মালিকদের নজর বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে ৮ ঘণ্টার বেশি একাধারে কাজ করার বিধান নেই। কিন্তু দূরপাল্লার পরিবহন শ্রমিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টিয়ারিংয়ে (চালকের সিটে) বসে থাকতে হয়। যেদিন বাস নিয়ে দূরপাল্লার যাত্রা করে, পরদিন একই ড্রাইভারকে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসতে হয়। এতে ড্রাইভারের শারীরিক স্টেমিনার বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয় না।

দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি। প্রতি বছর এ যান্ত্রিক ত্রুটি পরীক্ষা করার আইনগত দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের, যা বিআরটিএ নামে পরিচিত। প্রতি জেলায় তাদের অফিসসহ জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে, যাদের দায়িত্ব যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি পরীক্ষা করে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া। কিন্তু বিআরটিএ’র দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষের বিনিময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করেন। বাংলাদেশে অনেক খাতই অস্থির অবস্থায় রয়েছে; কিন্তু পরিবহন খাত বিশৃঙ্খলার কারণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ বিশৃঙ্খলার জন্য মূলত দায়ী পুলিশ বিভাগ। তারা এ খাত থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা পায় বলে গণ-অভিযোগ আছে। স্বনামে-বেনামে অনেক পরিবহনের মালিক পুলিশ। ফলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা যে ভূমিকা রাখছে, এ জন্য তাদের স্যালুট জানাই। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলেই পরিবহন খাতকে সচেতন হবে, বেঁচে যাবে নিরীহ যাত্রী ও পথচারীদের জীবন। মৃত্যুর পথে যাত্রীদের লাইন দীর্ঘ না হয়ে পরিসমাপ্তির দিকে এগোবে।

দীর্ঘ দিন পর হলেও স্বস্তি পাচ্ছি যে, কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা এখনো লোভলালসায় পড়েনি, এখনো তাদের বিবেক কারো কাছে বিক্রি হয়নি এবং ব্যক্তিস্বার্থ এখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন বয়স বিবেচনা না করেই সর্বস্তরের সব বয়সের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, অনুরূপ স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ঘুণে ধরা পচা-বাসি আবর্জনাপূর্ণ বস্তাবন্দী এ প্রশাসনের দায়িত্বহীনতামূলক পাপকে প্রকাশ করেছে। এ ছাত্রছাত্রীরা যে ভূমিকা রেখেছে সে ভূমিকা রাখতে পারেনি দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও জনগণের অর্থে লালিত পুলিশ প্রশাসন, অর্থাৎ আমলা নামক শ্বেতহস্তি। ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় না নামলে জাতি জানতেই পারত না যে, মন্ত্রী উল্টোপথে চলেন। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, বিচারপতি প্রভৃতি রথি-মহারথির চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই বা গাড়ির কাগজপত্র ত্রুটিপূর্ণ।

জনগণের অর্থে (কোটি কোটি টাকা) লালিত পুলিশ প্রশাসন যেখানে রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে ম্যাজিকের মতো এটা কিভাবে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, ছাত্রছাত্রীরা ছিল আন্তরিক এবং ঘুষ তাদের স্পর্শ করেনি। অন্য দিকে দালালিতে তারা পা বাড়ায়নি। ইতঃপূর্বে যেসব আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে, সে আন্দোলনকে ধামাচাপা দিয়েছে সরকার বিভিন্ন আশ্বাসের মাধ্যমে। কিন্তু সে আশ্বাসের বাস্তবায়ন তো হয়নি, বরং প্রধানমন্ত্রীর সোনার ছেলেদের দিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে নতুবা বাড়ি ফিরে গেছে। এমনকি বুড়িগঙ্গায়ও কোটা আন্দোলনকারীর লাশ পাওয়া গেছে। ফলে এবার আন্দোলনে ছাত্ররা বলেই দিয়েছে, ‘আশ্বাসের বিশ্বাস নেই’। ফলে এটাও সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।

সবারই দাবি- রুল অব ল, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে ল (আইন) আছে, কিন্তু রুল অর্থাৎ শাসন প্রয়োগ হয় দু’ভাবে, যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের জন্য আইন একভাবে ও সরকারবিরোধীদের জন্য ভিন্নভাবে। এ জন্য প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ সমভাবে দায়ী। প্রেক্ষাপটে এটাই দৃশ্যমান যে, রাষ্ট্রীয় অর্থে পালিত শ্বেতহস্তিগুলোর একমাত্র দায়িত্ব শাসক ও শাসকদলকে খুশি রাখা এবং এতেই তাদের আত্মতৃপ্তি। আইনের বাস্তবায়নের প্রধান শর্ত হলো, একটি কর্তৃপক্ষ থাকবে- যার দায়িত্ব আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। মানুষ যখন মনে করে কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তখনই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। যেমনটি হয়েছে কোমলমতি ছাত্রদের বেলায়।

স্বভাবসুলভ প্রধানমন্ত্রী ও তার সভাসদ যত কথাই বলুক না কেন, এ আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিএনপি বা অন্য কোনো শক্তি উসকানিতে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামেনি। রাস্তা শাসন কিভাবে করতে হয়, কিভাবে যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে হয় এবং কিভাবে পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে হয় তা ঘুষখোরদের শিক্ষা দেয়ার জন্য আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সম্মানী দিয়ে প্রশিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। কারণ, ছাত্ররাই চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়েছে, আইন প্রণয়নকারী, আইন রক্ষাকারী ও প্রয়োগকারীই আইনকে লঙ্ঘন করে। দেশের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’।

অর্থনৈতিক খাত থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন খাতে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। ব্যাংক জালিয়াতি, ঋণের মাধ্যমে গচ্ছিত আমানত লোপাট, এরশাদের ভাষায় বাড়িতে থাকলে খুন, বাইরে থাকলে গুম, বিচার বিভাগ করায়ত্ত, বিনা ভোটে নির্বাচনের সংস্কৃতি প্রভৃতি থেকে মানুষ নিস্তার চায়, যার জন্য মানুষ মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের একটি সরকার চায়, চায় একটি আশু পরিবর্তন, যেখানে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।

শহীদ সালাম, বরকতের রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একসাগর রক্তের বিনিময়ে যেমন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, রমিজ উদ্দিন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রক্তের বিনিময়ে সড়কদস্যুদের হাত থেকে যদি সড়ক নিরাপদ হয়, তবেই আসবে আন্দোলনের সার্থকতা।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, বিআরটিসি
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement