২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষার কোর্সে সংশোধন প্রয়োজন

আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষার কোর্সে সংশোধন প্রয়োজন - ছবি : সংগৃহীত

আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার কোর্সে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এটি তুলে ধরা এবং এর সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

রাজনৈতিক ইতিহাস জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। কলেজ স্তরে সামান্য কিছু আলোচনা হলেও একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে পড়ানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই ইতিহাসের নামে যা পড়ানো হয়, তাতে রয়েছে মৌলিক গলদ। কেননা, রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা সব সময়ই বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া উচিত। কেবল কোনো একটি বা দু’টি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে এই ইতিহাসের নামে শুধু পাশ্চাত্যের চিন্তাধারাই শিক্ষা দেয়া হয়। পাশ্চাত্য দেশ ছাড়া অন্য কোনো জাতি ও অন্য কোনো দেশের রাজনীতিপ্রবাহের ওপর বিন্দুমাত্র গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। মনে হয় যেন রাজনৈতিক চিন্তা এবং এর অনুশীলনে একমাত্র পশ্চিমের লোকদেরই অবদান রয়েছে, প্রাচ্যের কোনো দার্শনিকই বুঝি এ সম্পর্কে চিন্তা করেননি। এই একদেশদর্শিতার হয়তো বা কিছু কারণও দর্শানো যেতে পারে, কিন্তু কোনো যুক্তিতেই শুধু পাশ্চাত্য চিন্তাধারার পটভূমিকায় লেখা রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।

এ ক্ষেত্রে, উল্লিখিত সীমিত চিন্তাধারার আলোচনার ফলে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রথম পড়ানো হয় গ্রিক রাজনীতির কথা; বিশেষ করে সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর চিন্তাধারা। তাদের পূর্বাপর অনেক দর্শন এবং গ্রিক সমাজের সাধারণ অবস্থাও এর সাথে গুরুত্বসহকারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এ যুগের পর আসে রোমান রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশেষ করে সিসেরোর রাজনৈতিক মতবাদ।

প্রসঙ্গত, রোমান আইনের ওপরও আলোকপাত করা হয়ে থাকে। অতঃপর খ্রিষ্টীয় যুগের আরম্ভ। এপর্যায়ে এসে প্রধানত অগাস্টাইন, এমবোর্জ, গ্রেগরি প্রমুখ খ্রিষ্টান যাজকের দর্শনের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। এ যুগের শেষ সীমা খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক অবধি। পঞ্চম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয় চিন্তাজগতে কোনো প্রতিভাবান রাজনৈতিক চিন্তাবিদের আবির্ভাব লক্ষ করা যায় না। নতুন কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বেরও সন্ধান মেলে না। সর্বশেষ, দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু টমাস একুইনাহ এবং পদুয়ার মার্সিলিও থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত পশ্চিমের রাজনৈতিক চিন্তাধারা পড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ যুগের রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয়বাদ আন্দোলন বা কনসিলিয়ার মুভমেন্ট বিশেষ প্রসিদ্ধ। ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে গতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং আমরা দেখতে পাই একের পর এক মেকিয়াভেলি, মন্টেস্কু, হবস, লক, রুশো-সহ অনেক রাজনীতিবিষয়ক চিন্তাবিদকে। ওপরের আলোচনায় দেখা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কিয়দংশ ছাড়া পঞ্চম শতাব্দীর শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত এক বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতা। এই সুদীর্ঘ সময়ে সাধারণভাবে রাজনৈতিক চিন্তা সামান্যই ছিল; যা ছিল তা-ও অত্যন্ত দুর্বল স্তরের। এ কারণেই দেখতে পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর সাধু একুইনাহ, পদুয়ার মার্সিলিওর দর্শন এবং সমন্বয়বাদী আন্দোলন- সবই গির্জা ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের মতো প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে। যদিও এ সমস্যা রাজনীতির মূল অধ্যায়ে পড়ে না, তবু ইউরোপীয় চিন্তাবিদেরা এই সামান্য ব্যাপারকেই খুব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লিখেছেন। এসব কারণে মধ্যযুগকে, বিশেষ করে আদি মধ্যযুগকে ইউরোপীয় রাজনীতিবিশারদেরাই অরাজনৈতিক যুগ বা আনপলিটিক্যাল এজ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

আসলে তাদের এই মন্তব্য সত্য কি না তার যৌক্তিকতা বিচার করা দরকার। এ বিচার গোটা দুনিয়াকে সামনে রেখেই করা উচিত। আমাদের মতে, ওপরের মন্তব্য শুধু ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, সমগ্র বিশ্বের জন্য সত্য নয়।

ইউরোপের যখন ‘অরাজনৈতিক’ সময় তখন আরব বিশ্বে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা ছিল নতুন ধরনের ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটি ছিল, আইন হবে আল্লাহর এবং সরকার জনগণের পছন্দের। এ সময়ই হজরত মুহাম্মদ সা: বিদায় হজে মানবাধিকারের ঘোষণা দেন। মদিনার সনদ ছিল একটি সংবিধান। এ সংবিধানে সব নাগরিককে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার দেয়া হয়। মদিনার সনদে উম্মাহর ধারণার মাধ্যমে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ থেকে ভিন্ন আন্তর্জাতিক আদর্শিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করা হলো। এ সময় জাকাতের মতো কল্যাণকর অর্থনৈতিক নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠিত হয়, যাকে জনগণের সম্পদরূপে গণ্য করা হতো। এসব বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোর্সে অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া, মুসলিম চিন্তাবিদদের চিন্তাধারাও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

কুরআনে যে রাজনৈতিক মতবাদ ঘোষিত হলো, পরবর্তীকালে তারই বিভিন্নমুখী বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটে বিভিন্ন দার্শনিকের হাতে। আল-মাওয়ার্দি, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন ও আল-ফারাবির ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

দশম শতাব্দীর বিখ্যাত আইনবিদ আল মাওয়ার্দী অনেক বই লিখেছেন রাজনীতির ওপর। তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে আল আহকামুস সুলতানিয়া, অর্থাৎ রাষ্ট্র চালনাবিধি। এ গ্রন্থে তিনি খেলাফত এবং ওজারত সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন, যা যেকোনো আধুনিক চিন্তাবিদকে চমৎকৃত করবে। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রিসভার দুই ধরনের সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। এ দু’টি ব্যবস্থা বর্তমান যুগের প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম ও কেবিনেট সিস্টেমের অনুরূপ। সুতরাং এ দুই রকম শাসনব্যবস্থার আদিগুরু হিসেবে আল-মাওয়ার্দিকে আমরা গ্রহণ করতে পারি।

একাদশ শতাব্দীর ইমাম গাজ্জালির রাজনৈতিক পুস্তকাবলির মধ্যে কিতাব আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, কিতাব আল মুসতাজহাবি ও তিবরুল মাসবুক সুপ্রসিদ্ধ। তিনি গ্রিক চিন্তাধারার ওপর অনেক পুস্তক প্রণয়ন করেছেন।
গ্রিক চিন্তাধারা নিয়ে আরো যারা বিশেষভাবে গবেষণা করেছেন, তাদের মধ্যে আল-ফারাবি ও ইবনে রুশদের নাম উল্লেখযোগ্য। ফারাবি গ্রিক চিন্তাধারার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অনেক দিন পর্যন্ত তা ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকস্ট বুক হিসেবে পাঠ্য ছিল। ইবনে রুশদ অ্যারিস্টটলের সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যাতা বলে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তার দর্শন ইউরোপে এভাররোস্ট অ্যারিস্টটলিয়ানিজম নামে পরিচিত ছিল।

অন্য দিকে আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের সত্যিকার প্রথম বিকাশ ঘটে মুসলিম চিন্তাবিদদের হাতে। আইনশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। অধুনা যে জুরিসপ্রুডেন্স অব ল পড়ানো হয়, তার প্রথম নিয়মমাফিক বিকাশ লক্ষ করা যায় মুসলিম মনীষীদের হাতেই। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ীর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মধ্যযুগের জার্মানদের আইন পড়ানো হয়, অথচ মুসলিম আইনবিদদের চিন্তাজগতের সঙ্গে পরিচয়ের কোনো ব্যবস্থাই নেই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে।

ওপরের আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, মধ্যযুগ আনপলিটিক্যাল ছিল না। ইউরোপের জন্য তা অরাজনৈতিক যুগ হলেও আরব ও মুসলিম বিশ্বে তখন পূর্ণ রাজনৈতিক যুগ। আমাদের উচিত, রাজনৈতিক চিন্তাধারার এ শূন্যতা দূর করে বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস নতুন করে লেখা। রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তানায়কদের যথাযোগ্য স্থান দিলে এ শূন্যতা দূর হবে- রাজনীতির ইতিহাস পাবে পূর্ণাঙ্গতা, সংশোধিত হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement
মেক্সিকোয় মেয়র প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহেও ক্লাস বন্ধ ঘোষণা দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল, যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল

সকল