২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে প্রশ্ন

একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে প্রশ্ন - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙে না দিয়ে থাকলে সংসদের সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যায়। দশম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী এ সংসদের অধিবেশনের প্রথম বৈঠক ২৯ জানুয়ারি, ২০১৪ অনুষ্ঠিত হয়। এ সংসদটি ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তির কারণে ভেঙে যাবে। সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে। সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখসহ পূর্ণাঙ্গ তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। নির্বাচনের তফসিলের মধ্যে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত তা হলো মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও দাখিলের নির্ধারিত সময়, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়, মনোনয়নপত্র বাছাই, মনোনয়নপত্র বাতিলবিষয়ক আপিল শুনানি, প্রতীক বরাদ্দ এবং ভোট গ্রহণের তারিখ।

নির্বাচন কমিশনের সাথে যেসব রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত, শুধু সেসব দল এবং শর্তসাপেক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারেন। একটি দল এককভাবে অথবা জোটগতভাবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারে। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনটি আসন থেকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারে এবং তিনি তিনটি আসনে বিজয়ী হলে তাকে একটি আসন রেখে অপর দু’টি ছেড়ে দিতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে অপর দু’টি আসনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে যেসব বিষয় নিশ্চিত করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বি সব দলের জন্য সমসুযোগসংবলিত মাঠ। সমসুযোগ সংবলিত মাঠ নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনের জন্য যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক তা হলো- নির্বাচনী জনসভা ও প্রচারণার ক্ষেত্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সুযোগের সমতা, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো দল বা প্রার্থী যেন কোনো ধরনের বাধা বা প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়, তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা; ভোটাররা যেন নির্বিঘেœ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে তা নিশ্চিত করা; ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ যেন না হয় তার নিশ্চয়তা বিধান, কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট দেয়া রোধ, নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন-পরবর্তী ভোটাররা যেন কোনো পক্ষের হয়রানি বা নাজেহালে শিকার না হয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এর নিশ্চয়তা বিধান; নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে শক্তিশালী পক্ষের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার বিষয়ে হুমকি প্রদান রোধ, প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টদের ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ভোটকক্ষে উপস্থিত হতে না দেয়া এবং উপস্থিত হওয়া পরবর্তী বলপূর্বক বের করে দেয়ার অপচেষ্টা নিরোধ।

বাংলাদেশের জনমানুষের দলীয় ও দলীয় সরকার বহির্ভূত উভয় ধরনের সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। উভয় ধরনের সরকারের অধীন নির্বাচনে দলীয় সরকারের ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে নির্বাচনী সভার আয়োজন। যেকোনো দলীয় সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের মাধ্যমে এরূপ নির্বাচনী জনসভার আয়োজন করলে তা যে সমসুযোগ সংবলিত মাঠ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় এ বিষয়টি দেশের সাধারণ জনমানুষের কাছে বোধগম্য হলেও নির্বাচন কমিশনকে দেখা গেছে অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে চলা। দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বেকার প্রতিটি নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকার নিয়োগ দিয়েছে। দলীয় সরকার নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে সবসময় দলীয় মর্তাদর্শীদেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকে এবং এরূপ দলীয় মতাদর্শীদের অতীতে কখনো দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষার বিপরীতে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। দলীয় সরকারের সময়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে নির্বাচনী জনসভা আয়োজন বিষয়ে দলীয় সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তাদের পক্ষ থেকে সব সময় একই ধরনের উত্তর যে, তফসিল ঘোষণার আগে তাদের পক্ষে নির্বাচনে অনিয়মবিষয়ক কোনো কিছু দেখার সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এরূপ বক্তব্য যে অজ্ঞতাপ্রসূত, তা নির্বাচন কমিশনের সংবিধান সঠিকভাবে অনুধাবন না করার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে বর্তমানে বড় দল বলতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দু’টি দলকে বোঝায়। উভয় দলের পক্ষে দলীয় সরকার বহির্ভূত সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশে কখনো দলীয় সরকারের পরাজয় ঘটেনি। এর পেছনে মূল যে কারণ তা হলো- দলীয় সরকার কখনো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান বিষয়ে সচেষ্ট ছিল না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এ দাবিতে আমাদের বিভিন্ন দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় তাদের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় অবস্থান নিয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকা এবং আমাদের দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকার মধ্যে যে পার্থক্য তা হলো অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে দলীয় সরকার কখনো এমন কিছু করে না, যা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। অপর দিকে আমাদের দেশে দলীয় সরকার এমনভাবে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করে যাতে নির্বাচনী ফলাফল কোনোভাবেই তাদের বিপক্ষে না যায়।

দশম সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়নি এ প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ নেই। এ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। এ নির্বাচন ছিল একতরফা এবং অনিয়ম ও কলুষতায় পরিপূর্ণ। এ নির্বাচনটির সাথে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনটি তুল্য। কিন্তু সে নির্বাচনটির সাথে এর পার্থক্য হলো, সেটি অনুষ্ঠান-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তন করে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। আর বর্তমানটির ক্ষেত্রে যে উপায় ও প্রক্রিয়া অবলম্বনে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছিল সমপন্থা ও প্রক্রিয়া অবলম্বনে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ বেছে নেয়ার প্রয়াস।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময়ের সময় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে, যদিও ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান এর বিপক্ষে। আমাদের দেশে অতীতে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনের পূর্বক্ষণে সেনা মোতায়েন হতে দেখা গেছে, কিন্তু দলীয় সরকার বহির্ভূত সরকারের অধীন নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যুক্তিসঙ্গত সময়পূর্বে সেনা মোতায়েন হতে দেখা গেছে। এরূপ নিয়োগে নির্ধারিত দায়িত্বের মধ্যে যে দু’টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল তা হলো- অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার। দলীয় অথবা নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনকে অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু করতে হলে নির্বাচনের যুক্তিসঙ্গত সময়পূর্বে নির্ধারিত দায়িত্ব দিয়ে সেনা মোতায়েনের কোনো বিকল্প নেই।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের নির্ধারিত যে সময় তা ২৮ অক্টোবর ২০১৮ থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত ৯০ দিনের মধ্যে আবদ্ধ। এ সময়ক্ষণে উপনীত হওয়ার এক বছর আগে থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে জনসভার আয়োজন করছে যাতে দলীয় নেতাকর্মীরা দলের নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন এবং দলীয় প্রধানের পক্ষ থেকেও উপস্থিত জনগণকে হাত তুলে দলের পক্ষে ভোট প্রদানের সথর্থন ব্যক্ত করতে বলা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের এমন অবস্থানের বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রকৃত অর্থেই কোণঠাসা। এ দলটির প্রধান কারান্তরীণ এবং জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ন্যায়পরতা হতে বঞ্চিত। দলের নেতাকর্মীরা সভা, সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন এমনকি ঘরোয়া বৈঠক করার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নাজেহাল হচ্ছেন। প্রধান বিরোধীদের প্রতি অব্যাহতভাবে এরূপ আচরণ করা হলে দলটির পক্ষে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আশা করা সুদূর পরাহত।

ক্ষমতাসীনদের কার্যকলাপ বিশেষত, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, কালিমা ও কলুষতা দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়- প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকুক, এটিই যেন তাদের চাওয়া। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে বা দলটির অংশ নেয়ার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে যে নির্বাচন হবে, তাকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দেয়ার সুযোগ আছে কি? তা ছাড়া দ্বিতীয়বারের মতো এরূপ নির্বাচন দেশী ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এ বাস্তবতায় একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভবের অনুঘটক হতে পারে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement
শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১ দাগনভুঞায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির ঘটনায় আ’লীগ নেতাকে শোকজ দখলে থাকা ৪ গ্রাম আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দেবে আর্মেনিয়া

সকল