২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লুটপাট চলছে অবিরাম

লুটপাট চলছে অবিরাম - ছবি : নয়া দিগন্ত

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, কিন্তু শোষণ ও নির্যাতনের পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন ঘটেছে শুধু পদ্ধতির। লুটেরারা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব পন্থায়, যার গতি আগের চেয়ে বেশি। ব্রিটিশরা এ দেশকে লুট করার জন্য এসেছিল। এতে সফল হয়েছে, লুটকে গতিশীল করতে দেশী যে দালালদের সহযোগিতা নিয়েছিল তাদেরও ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে, কিন্তু দরিদ্র হয়ে রয়েছে এ দেশের সাধারণ জনগণ যারা দিন দিন গরিব হচ্ছে এবং নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় অভাবে নেই, এ দেশের কয়টি পরিবার এমন? লুটেরা ও তাদের তাঁবেদারদের ভাগ্য খুলেছে। একটু গোড়ার দিকে তাকালে লুটের এ নির্মম চিত্র সহজেই অনুমান করা যায়। তদানীন্তন বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল এ দেশীয় দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়া গোষ্ঠী।Macaulay : Essays on Lord Clive (পৃষ্ঠা-৬৩) বইতে লর্ড মেকলে লিখেছেন যে, ‘কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য, প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। দেশী লোকদের তারা খুব কম দামে উৎপন্ন দ্রব্য বেচতে এবং খুবই চড়া দামে বিলাতি পণ্য কিনতে বাধ্য করত। কোম্পানি তাদের অধীনে একদল দেশী কর্মচারী নিয়োগ করত। এই কর্মচারীরা যে এলাকায় যেত, সে এলাকা ছারখার করে দিত; সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার উচ্চপদস্থ (ইংরেজ) মনিবের শক্তিতে বলীয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। (তাদের ব্যাপক লুণ্ঠন ও শোষণের ফলে) শিগগিরই কলকাতায় বিপুল ধন-সম্পদ স্তূপীকৃত হলো। সেই সাথে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়াল। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্ত- এ কথা ঠিক, কিন্তু এ ধরনের (ভয়ঙ্কর) শোষণ ও উৎপীড়ন তারাও কোনো দিন দেখেনি। (সূত্র : সুপ্রকাশ রায় প্রণীত ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ পৃ: ১০)

ঘুষের প্রচলন যে ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল, তা ১৭৭৩ সালে Fourth Parliamentary Report (পৃষ্ঠা ৫৩৫) এ উল্লিখিত মন্তব্য থেকে প্রমাণিত। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উৎকোচ নামক দুর্নীতি এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানি করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ষাট লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল।’
‘ব্যবসায়ের নামে ইংরেজ বণিক কোম্পানির এই দস্যুতার মুখে বহু শিল্প কারিগর উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য, নিজেদের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলে অসহনীয় উৎপীড়ন থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ১৭৫৮ থেকে ১৭৬৩- এই ছয় বছরে কৃষকদের সাথে কারিগরদের একটি অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। ইংরেজ লেখক রেজিনাল্ড রেনল্ডস উল্লেখ করেছেন, ওই সময়ের মধ্যে ঢাকার বিশ্বখ্যাত মসলিনের এক-তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-পীড়নে অস্থির হয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল। (সূত্র : রেজিনাল্ড রেনল্ডস প্রণীত ‘সাহিবস ইন ইন্ডিয়া,’ পৃ : ৫৪)

দেশীয় দালাল সৃষ্টির মাধ্যমে ব্রিটিশরা পাক-ভারত উপমহাদেশসহ পাশের রাষ্ট্রগুলো শাসন শোষণের মাধ্যমে লুণ্ঠন করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে। পদলেহী হিসেবে ব্যবহারের জন্য ওরা বিভিন্ন উপাধি যেমন- স্যার, খানবাহাদুর, রায়বাহাদুর প্রভৃতি অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে বিতরণ করত, যাতে তাদের পোষ মানিয়ে নিরীহ জনগণকে শাসন শোষণ করা যায়। যাদের আমরা একনামে সম্মান করি তাদের অনেকের ইতিহাসও খুবই বিতর্কিত যা জানতে পারলে তাদের প্রতি সম্মানবোধটুকু থাকে না। বিপারপতিদের মধ্যেও ব্রিটিশরা তাদের দালাল বা তাঁবেদার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।

ওই বিষয়ে গোলাম আহমাদ মোর্তজা প্রণীত ‘বজ্রকলম’ বইতে (পৃষ্ঠা ১৩৫) স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “ভারতের হিন্দু-মুসলমান যখন ব্রিটিশের মার খাচ্ছে, গুলি খাচ্ছে ও ফাঁসিতে যাচ্ছে, তখন ব্রিটিশ-বিরোধী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভূমিকাই ছিল না তার। যখন বিচারপতিদের কাঁধে বন্দুক রেখে বিচারের প্রহসনে ব্রিটিশ সর্বনাশ করত ভারতীয়দের; সেই সময় আশুতোষকেও করা হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। সুতরাং তার যোগ্যতা ও বিশ্বাসভাজনতার প্রতি ব্রিটিশের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরও হয়েছিলেন চারবার। ‘রাঁয়চাদ প্রেমচাঁদ’ পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। লর্ড লিটন তাকে দিয়েছিলেন ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ উপাধি। তার ধারাবাহিক কর্ম, যোগ্যতা ও বিচারকার্যে খুশি হয়ে সরকার তাকেও দিয়েছিল ‘স্যার’ উপাধি।”

ওই বইতে ভারতে ধনিক শ্রেণী কর্তৃক ব্রিটিশদের মনোরঞ্জনের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। ওই লেখক আরো লিখেছেন, ‘ওই সব রাজা মহারাজা বাবু ও জমিদার ধনীরা প্রকাশ্যে বেশ্যাখানায় যেতে দ্বিধাবোধ তো করতই না, বরং প্রতিযোগিতা করে বাহাদুরি দেখাত তারা। সেই সময় নাচে গানে পটু বেশ্যাদের একটা সম্মানীয় নাম ছিল ‘বাঈজী’। ওই সুন্দরী বেশ্যা-বাঈজীর মধ্যে যারা ছিল খুব খ্যাতনামা তাদের নাম নিকি, সুপন, বকনাপিয়ারী, হিঙ্গুল প্রভৃতি। ওই বাবু ও জমিদারেরা এদের ভাড়া করে আনতেন। নাচ, গান, বাজনা আর খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে বাজি পোড়ানো এবং আরো কুৎসিত আমোদ-প্রমোদের উৎসব চলত ঢালাওভাবে। বাড়ির এই উৎসবে ইংরেজ (ব্রিটিশ) মনিবদের নেমন্তন্ন করা হতো। (সূত্র : বজ্রকলম, পৃষ্ঠা-১৬৫)

ব্রিটিশদের ‘সাহেব’ বানিয়েছে এ দেশের দালালেরা যারা ছিল ধনিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীপর্যায়ে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান এবং পরে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখানে দালাল শ্রেণী সরকারি-আধা সরকারি সব সেক্টর লুটে খাচ্ছে। ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাতায় এরা কোন শ্রেণীভুক্ত হবে, তা জানি না, তবে এখন দালাল না বলে নিজেদের সরকারি দলীয় লোক হিসেবে পরিচয় দিতে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশ মধ্য আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখনো দেখা যাচ্ছে, জাকাতের টাকা আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যু, বেকারত্বের কারণে নৌকায় বিদেশে পাড়ি দেয়ার সময় সাগরে বাংলাদেশীর মৃত্যু, কাঙালি ভোজে অংশগ্রহণ করতে গিয়েও গরিব মানুষের মৃত্যু প্রভৃতি।

সরকার এক দিকে বলছে, ‘ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না, পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না।’ অথচ ভূমিদস্যুদের কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, জমি হারাচ্ছে কৃষক সমাজ। ব্রিটিশের মতোই এলাকায় এলাকায় দালাল শ্রেণী করে নদীতে ড্রেজার লাগিয়ে জোরপূর্বক বালু দিয়ে ফসলি জমি ভরাট করা হচ্ছে আবাসন প্রকল্পের নামে। অথচ আবাসন প্রকল্প করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয় না। ভূমিদস্যুরা কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেনে না, এক অথবা দেড় বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে আবাসন প্রকল্পের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে বালু ভরাট শুরু করে দেয়। অথচ এ দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করার দায়িত্ব যাদের, (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন প্রভৃতি) তারা ভূমিদস্যুদের আর্থিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ, ফসলি জমি, কৃষক, জমির মালিক প্রমুখ।

গত ২৭ জুন একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে রূপগঞ্জে কৃষিজমি কমেছে দুই হাজার ১৬০ হেক্টর (আড়াই একরে এক হেক্টর)। ২০০৮ সালেও এলাকায় কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৬১০ হেক্টর। এখন ১১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কৃষিজমি ও জলাশয় কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বর্গাচাষি ও জেলেরা। তারা বেকার হয়ে পড়ছেন। অন্যের সহায়তা এবং দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন অনেকে। রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: তাজুল ইসলামের বক্তব্যমতে, ১০ বছর আগে রূপগঞ্জে কৃষক পরিবার ছিল ৪৪ হাজার ৬৪২টি। এখন ২২ হাজার ১১৬টি। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজউক পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের জন্য রূপগঞ্জে দেড় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে।

এরপর এখানে জমি বেচাকেনা বেড়ে যায়। ফলে প্রতি বছরই কৃষিজমি কমছে। রূপগঞ্জে মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণও অস্বাভাবিক পরিমাণে কমছে। ভরাট হচ্ছে খালবিল, গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্প। ২০০৮ সালে পুকুর ও দীঘি ছিল এক হাজার ৪২৪টি। এখন রয়েছে ৯০০টি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর চন্দ্র বসাকের বক্তব্য মতে, ‘মুক্ত জলাশয় কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মাছের উৎপাদন কমে গেছে। গত ১০ বছরে বেকার হয়েছে ৫৫৪ জেলে।’ অসহায়ত্ব প্রকাশ করে রূপগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান বলেছেন যে, ‘কৃষি ও জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে আবাসন কোম্পানিগুলোর কারণে। তারা মাসলম্যান পোষে। একটি জমির পাঁচজন অংশীদারের একজনকে কিছু টাকা দিয়ে পুরো জমি দখল করে নিচ্ছে অনেক কোম্পানি। তাদের শক্তি ও টাকার কাছে জনপ্রতিনিধিরাও অসহায়’ (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা ২৭-০৬-২০১৮) এই মাসলম্যানরাই এখন দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লুটেরা ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আর ক্ষমতাসীন দলের লোক ছাড়া এ দেশে মাসলম্যান হওয়া যায় না। পুলিশ যাকে সালাম দেয় সেই মাসলম্যান এবং এ জন্য সরকারি দলের লোক হওয়া চাই।

বর্তমানে আমাদের দেশে লুট হচ্ছে ব্যাংক, লুট হচ্ছে খাল-বিল, নদী-নালা ও ফসলি জমি, লুট হচ্ছে মানুষের অধিকার। এ অসহায়ত্বের হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ হোক; বিকশিত হোক স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা।হ
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)


আরো সংবাদ



premium cement