২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জনগণ ভোট না দেয়ার দায়

জনগণ ভোট না দেয়ার দায় - ছবি : নয়া দিগন্ত

আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণভবনে এক বিশেষ বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়। এতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে তিনি চ্যালেঞ্জিং বলে অভিহিত করেন। বক্তব্যের মধ্যে যে বিষয়টি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হচ্ছে- ‘জনগণ ভোট না দিলে দায় আপনাদেরই’। সরকারের উন্নয়ন কাজ প্রচার করার আহ্বান জানিয়ে দলের নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে উন্নয়ন করেছি তাতে মানুষ নৌকায় ভোট দেবে না এটা হতে পারে না। যদি ভোট না দেয় সেজন্য আপনারাই দায়ী থাকবেন। কারণ, আপনারা সঠিকভাবে মানুষের কাছে যেতে পারেননি, তাদের কাছে সরকারের উন্নয়নের কথা বলতে পারেননি ও তাদের বুঝাতে পারেননি। তার প্রশ্ন, আমরা যে কাজ করেছি তা অন্য দল করেনি। তাহলে কেন তারা ভোট পাবে’? সভায় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, সামনে নির্বাচন এই কথাটা সবসময় মনে রাখতে হবে। নির্বাচন মানেই চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা কিন্তু আমাদের একটানা তৃতীয়বার। এই তৃতীয় নির্বাচনে আমাদের এক হয়ে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে, যেন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে আবার সরকার গঠন করতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনে জনগণ ভোট দেবে। ভোট চুরি ও ভোট ডাকাতি করে কেউ জিততে পারবে না। আওয়ামী লীগ এ বদনাম নেবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বেশ কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত, জনগণের ভোটাধিকার নির্ণয়ে উন্নয়নের অনিবার্যতা। তিনি ধরেই নিয়েছেন যে, মানুষের কাছে ভোট পাওয়ার একমাত্র কারণ উন্নয়ন। এ ছাড়া অন্যকোনো মাত্রা বিবেচিত হতে পারে না। অন্য সময় অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে গণতন্ত্রের স্বাদ পৌঁছে দেয়া অথবা গণতেন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তি অর্জনের কথা বলেছেন। এবারে তা বলেননি। প্রকারান্তরে জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রী কি এই মেসেজই দিতে চেয়েছেন, যে সুনীতি, দুর্নীতি, চোটপাট, লুটপাট, দলবাজি, চাঁদাবাজি, হত্যা, গুম, হামলা, মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন, বন্দুকযুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কোনো বিষয়ই নয়। সব দেশে সব সময়ে ভোটের রাজনীতি নানা কারণে এমনকি সামান্য সেন্টিমেন্টের কারণে উলোটপালট হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি আজকের আলোচ্য নয়।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হলো। দ্বিতীয়ত, রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যেটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো, ভোটের দায়দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী ভোট পাওয়া না পাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের দায় নিতে বলেছেন। আসলে সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দায়টি কার সেটা নিরূপিত হওয়া প্রয়োজন। কেতাবি ভাষায় এই দায়দায়িত্বকে বলা হয়, ‘পলিটিক্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি’ বা রাজনৈতিক জবাবদিহিতা। এটি শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বিষয়। গণতন্ত্রের সূচনাকাল থেকে এই ‘জনজবাবদিহিতা’র বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে। শাসকব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী যাতে বেপরোয়া হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য গণতন্ত্রের বিধানাবলি তার লাগাম টেনে ধরতে চায়। আর সেক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় বাদে তাদেরকে জনগণের কাছে তাদের শাসনের অধিকার ‘রিনিউ’ করতে হয়। এটাই নির্বাচন। অপর পক্ষে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এমন সব নিয়ম কানুন, রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি বা প্রক্রিয়া রয়েছে যার দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় বড় কোনো অন্যায়, দুর্নীতি ও অসদাচারণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যায়। এটাকে বলা হয়Ñ ‘ইম্পিচমেন্ট বা অভিসংশন’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির যেকোনো কার্যব্যবস্থা রিভিউ বা পর্যালোচনার ক্ষমতা রাখে। অপর দিকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় এই জবাবদিহিতার ব্যবস্থা আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। সবচেয়ে বড় ও কার্যকর ব্যবস্থাকে বলা হয় অনাস্থা প্রস্তাব।

যেহেতু জাতীয় সংসদ বা পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সরকার গঠিত হয় সেহেতু তাদের আস্থা-বিশ^াস বিনষ্ট হলে সরকারের পতন ঘটতে পারে। আর এসব কিছুই সংসদ নেতা তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। সংসদীয় কার্যব্যবস্থায় কমিটি সিস্টেম, তদন্ত কমিটি, প্রশ্নোত্তর পর্ব, বিরোধী দলের বক্তব্য ও অন্যভাবে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের চেষ্টা করা হয়। দেশে দেশে এসব ব্যবস্থায় নানা ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের সংবিধানে জাতীয় সংসদকে সব কার্যক্রমের উৎস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সেই কার্যক্রমের উৎসমূল। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রীও সময়ে সময়ে যেইরূপ স্থির করিবেন সেইরূপ অন্য মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করিবেন।’ একই অনুচ্ছেদের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।’ সুতরাং নীতিগতভাবে সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রিত্বে বর্তায়। অবশ্য বাস্তবে জাতীয় সংসদ যে কী তা সবারই জানার কথা। সংসদীয় রাজনীতি অনুযায়ী একটি দল বা জোট সরকার পরিচালনা করে। দলীয় প্রধান নীতিনির্ধারক। সব সরকারি কার্যক্রম তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে মাঝে মধ্যে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের ধারক বলে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশে^র পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র মানেই নিছক ব্যক্তিগত শাসন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে দলীয় নেতাকর্মী বা জনগণ সরকার বা দলের গৃহীত কার্যব্যবস্থার জন্য দায়ী নয়; বরং প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মালিক-মোক্তার হওয়ায় তিনিই দায়ী। এই দায়ের পরিধিকে আরো অনেক ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রাস স্টোন এবং অন্যরা। এরা দায়ের মাত্রাকে ৮ ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ ১. নৈতিক ২. প্রশাসনিক ৩. রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ৪. বাজার ৫. আইন ৬. বিচার ৭. নির্বাচনী এলাকা এবং ৮. পেশাদারিত্ব। এসব নিরিখে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বা অন্য যেকোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের জবাবদিহিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে অবশ্যই আমাদের হতাশ হতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ফিরে আসি আবার। প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়দায়িত্ব বিশ্লেষণ করে আমরা দেখলাম, তিনি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করেছেন। নিজের দায়দায়িত্ব নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়েছেন। তার মানে কি এই দাঁড়ায় না যে, জনগণ যদি ভোট না দেয় সে ভোট নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব নেতাকর্মীদের। সে মহান দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি শক্ত তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি নিজ দলের নেতা বা এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ শুনতে চান না। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে বিএনপির সন্ত্রাস, লুটপাট, দুর্নীতি বা জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা সম্পর্কে কিছু বলে না। তাদের বক্তব্য আওয়ামী লীগ এমপির বিরুদ্ধে, সংগঠনের বিরুদ্ধে’। তিনি তাদের সাবধান করে বলেন, ‘কেউ যদি আমার দলের উন্নয়নের কথা না বলে কোথায় কার কী দোষ আছে সেগুলো খুঁজে বের করে জনগণের কাছে গিয়ে বলেন, তারা আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবে না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, যদি কেউ ৫-১০ বছর সরকারে থাকার পর দলের বদনাম করে তাহলে জনগণতো তাকেও ভোট দেবে না। আজকাল সব কথাই রেকর্ড হয় এবং চাইলে মোবাইলে সেগুলো তিনি শুনতেও পারেন। বস্তুত, বিগত প্রায় ১০ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অন্তত নির্বাচন বিষয়ে তাকে হতাশ করেনি। ২০০৮ সালে একটি প্যাকেজ ডিলের মাধ্যমে, ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদন মোতাবেক প্রতিবেশীর শলাপরামর্শ এবং বস্তাবস্তা টাকার বিনিময়ে ক্ষমতায় আসার পর এমন একটি নির্বাচনও তারা বাকি রাখেননি যেখানে সন্ত্রাস, জালিয়াতি ও কারচুপি হয়নি। তারা যেমন ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় অবস্থান পৌঁছে দিয়েছেন, ঠিক তদ্রুপভাবে নির্বাচন প্রকৌশলও পৌঁছে দিয়েছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচন এতটাই স্বচ্ছ ছিল, যে লোকেরা বলে- ‘চেয়ারম্যান ওপেনে, মেম্বর গোপনে’। সাম্প্রতিক দুটো নির্বাচন, খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনে তারা যে প্রকৌশল প্রারঙ্গমতা দেখিয়েছেন তার তুলনা হয় না! খুলনার নির্বাচনে তারা বিএনপির নেতাকর্মীদের অত্যাচার, অনাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন করে ঘরছাড়া করেছেন। নির্বাচন কমিশন সেখানে ‘হুজুরের কথায়’ চমৎকার নির্বাচন করেছেন। সেখানে কবরের শান্তি নিশ্চিত ছিল। এবার তারা গাজীপুরে আরো চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করেছেন। দুপুরের আগেই বেশির ভাগ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার নিঃশেষ হওয়ার মানে কি এই নয় যে আগের রাত্রেই আওয়ামী নেতাকর্মীরা নেতার নির্দেশ মোতাবেক ভোটদান পর্ব সমাধান করে ফেলেছেন! তা ছাড়া খুলনা স্টাইলে ভীতি প্রদর্শন ও গণগ্রেফতার কম হয়নি। তাদের নেতাকর্মীরা বলে বেড়াচ্ছিলেন ভোট যেখানেই দাও মেয়র তাদেরই নির্বাচিত হবে। গাজীপুরের বিগত নির্বাচিত মেয়রকে বারবার জেলে ঢুকিয়েছেন। উন্নয়ন বরাদ্দ দেননি। সেটাও বিএনপির দোষ। তারা উন্নয়ন করতে পারে না। কী যুক্তি! বাহ্বা-বাহ্বা-বাহ্বা বেশ।

প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তৃতীয়বার নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের আগাম প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিগত ১০ বছরে যে নির্বাচনী প্রকৌশল তারা দেখিয়েছেন তা যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনেও প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে তাদের বিজয় কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তবে বিরোধীরা বলতে পারে, ‘দিল্লি হনুজ দুরস্ত’ -দিল্লি অনেক দূর। যাহোক তিনি বলেছেন, ‘ভোট চুরি-ডাকাতি করে কেউ জিততে পারবে না। আওয়ামী লীগ এ বদনাম নেবে না’। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ। আজকাল একটি প্রচলিত প্রবাদ এ রকম যে ‘ডিজঅর্ডার ইজ দ্য অর্ডার অব দ্য ডে’। তা যদি সত্য হয় তাহলে তাদের আগাম মন্তব্য সত্য হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে দলীয় সাধারণ সম্পাদক আরো শক্তভাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কখনো কোনো নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি হয়নি। এর চেয়ে নির্মম সত্যকথা আর হতে পারে না! তার মন্তব্য শুনে আদি ঢাকাইয়ারা হয়তো বলবে, ‘ছাব, আস্তে কন, ঘোড়ায় ভি হাসব’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement