২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জামিন বিষয়ে আইনি বিধান

জামিন বিষয়ে আইনি বিধান - ছবি : নয়া দিগন্ত

চলাফেরার স্বাধীনতা একজন নাগরিকের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকার। জনস্বার্থে আইন আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশে বসবাসরত একজন নাগরিক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেলার অধিকার ভোগ করে থাকেন। একজন ব্যক্তি যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে পরবর্তী আদালতে তার জামিন নামঞ্জুর হলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। একজন ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণের জন্য যেমন বিচারিক আদেশের প্রয়োজন, অনুরূপ কারাগার হতে মুক্ত করতে হলেও বিচারিক আদেশ অপরিহার্য, যদিও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণার ক্ষেত্রে বিচারিক আদেশের আবশ্যকতা দেখা দেয় না। জামিন একটি বিশেষ অধিকার। এ অধিকার জিম্মাদার অথবা জিম্মাদার ব্যতিরেকে আদালত মঞ্জুর করতে পারেন। ক্ষেত্রবিশেষে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে ছাড়া হওয়া সাপেক্ষে জিম্মাদার অথবা জিম্মাদার ছাড়া জামিন মঞ্জুরের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যদিও পুলিশের এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ কখনো দেখা যায় না।

ফৌজদারি অপরাধগুলোর তিন ধরনের : জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য, আমলযোগ্য ও আমল অযোগ্য এবং আপসযোগ্য ও আপস অযোগ্য। জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা হয়েছে- এ বিধির দ্বিতীয় তফসিলে যেসব অপরাধ জামিনযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেগুলো জামিনযোগ্য অপরাধ অথবা আপাতত বলবৎযোগ্য অপর যেকোনো আইনে যেসব অপরাধকে জামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে, সেগুলো জামিনযোগ্য অপরাধ এবং জামিনযোগ্য নয় এমন অপর সব অপরাধ জামিন অযোগ্য অপরাধ।

আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া একজন ব্যক্তিকে আটক করতে পারে। অপর দিকে আমল অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে আটক করতে পারে না।
আপসযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয় নিজেদের মধ্যে আপসরফার মাধ্যমে বিবাদের মীমাংসা করতে পারে। এরূপ আপসের ক্ষেত্রে আপসের বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হলে আদালত পরবর্তীকালে কার্যকর ব্যবস্থা নেন। আপস-অযোগ্য অপরাধ বিবদমান পক্ষের মাধ্যমে আপসের মাধ্যমে মীমাংসার সুযোগ আইনগতভাবে না থাকলেও আদালতের বাইরে এ ধরনের আপসের ক্ষেত্রে ফরিয়াদি পক্ষ এমনভাবে সাক্ষ্য উপস্থাপন করে, যা মামলা প্রমাণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এমন কিছু অপরাধ আছে, যা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আপসযোগ্য। পক্ষদ্বয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অনুমোদন দিলে এ ধরনের আপস কার্যকর হয়।

জামিনযোগ্য অপরাধের অভিযোগে একজন ব্যক্তিকে পুলিশ আটক-পরবর্তী আদালতে উপস্থাপনের পর তিনি জামিনে মুক্ত হতে চাইলে সে ক্ষেত্রে আদালত তাকে নিজ জিম্মায় অথবা জামিনদারের জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করবেন। জামিনযোগ্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত জামিন মঞ্জুর করতে না চাইলে সে ক্ষেত্রে আদালতের পক্ষে কী কারণে জামিন মঞ্জুর করা হলো না জামিন নামঞ্জুরের আদেশে তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।
জামিন-অযোগ্য অপরাধের অভিযোগে একজন ব্যক্তিকে পুলিশ আটক-পরবর্তী আদালতে উপস্থাপনের পর অপরাধ জামিন-অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্ত হতে চাইলে আদালত সঙ্গত মনে করলে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু যদি আদালতের কাছে যুক্তিসঙ্গত কারণে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতীয়মান হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি যে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, তার সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড সে ক্ষেত্রে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেবেন না। তবে অপরাধীর বয়স ১৬ বছরের নিচে হলে অথবা অপরাধী একজন মহিলা হলে অথবা অপরাধী রোগাক্রান্ত অথবা অক্ষম ব্যক্তি হলে সে ক্ষেত্রে আদালত জামিন মঞ্জুর করতে পারেন।

মামলার এজাহার দায়ের-পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ না হলে এবং অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১০ বছর মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড না হলে একজন আমলি ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের ঊর্ধ্বে হলে দায়রা আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
জামিন বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে যে নির্দেশনা রয়েছে, তা অবলোকন আদালতের যেমন দায়িত্ব, অনুরূপ জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুরের বিষয়টি আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা, যদিও এ বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগে জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুরের ক্ষেত্রে আদালতের পক্ষ থেকে যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ থাকতে হয়।

পুলিশ একজন ব্যক্তিকে যেকোনো অপরাধ সংশ্লেষে আটক করলে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা সময় ছাড়া আটক ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি উভয় আইনে এ বিধানটির উল্লেখ রয়েছে। আবার সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, সংবিধান ও আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সুতরাং পুলিশ একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার-পরবর্তী যাত্রা সময় ব্যতিরেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে উপস্থাপন না করা হলে সংবিধান ও আইন উভয়ের লঙ্ঘন ঘটে।
একজন ব্যক্তি অপরাধ সংঘটন করলে তার বিরুদ্ধে থানায় বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মামলা দায়ের করা যায়। থানায় এজাহারের মাধ্যমে যে মামলা দায়ের করা হয়, এরূপ মামলাকে জিআর মামলা বলা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সরাসরি যে মামলা দায়ের করা হয়, সে মামলাকে সিআর মামলা বলা হয়। সিআর মামলার ক্ষেত্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে নেয়া-পরবর্তী গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন, কিন্তু জিআর মামলার ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ ছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির অবকাশ নেই। জিআর বা সিআর মামলায় অভিযুক্ত একজন ব্যক্তিকে পুলিশ আটকের আগে আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন প্রার্থনা করতে পারেন।

আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি বা বিদ্যমান অপর কোনো আইনে আগাম জামিনবিষয়ক কোনো বিধান নেই। একসময় আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৯৭৮ সালে ধারা নম্বর ৪৯৭এ সংযোজনের মাধ্যমে আগাম জামিনের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল। পরে ১৯৮২ সালে ওই বিধানটি রহিত করা হলে আগাম জামিন দেয়ার অবকাশ বারিত হয়ে যায়। আগাম জামিনের বিধান বিদ্যমান থাকাবস্থায়ও এজাহার দায়ের-পরবর্তী আগাম জামিন নেয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বিধান বহাল থাকাকালীন এবং বাতিল-পরবর্তী অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এজাহার দায়ের-পরবর্তী নিম্ন আদালতে উপস্থিত হওয়া ছাড়াই আগাম জামিন অনুমোদন করা হয়।

কোনো আদালত একজন ব্যক্তিকে কারাদণ্ড প্রদান করলে এবং দণ্ড ঘোষণাকালীন ওই ব্যক্তি জামিনে থাকলে আদালত তার জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠান। তবে দণ্ডের মেয়াদ এক বছরের ঊর্ধ্বে না হলে এবং তা আপিলযোগ্য হলে দণ্ডিত ব্যক্তি আদালতের কাছে আপিল দায়েরের ইচ্ছা ব্যক্ত করে সময় প্রার্থনা করা হলে সে ক্ষেত্রে আদালত তার যুক্তিসঙ্গত সময়ের জন্য জামিন মঞ্জুর করে আপিল আদালত থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জামিন আদেশ নিয়ে আসার নির্দেশনা দিতে পারেন। দণ্ডের মেয়াদ এক বছরের ঊর্ধ্বে হলে বিচারিক আদালতের দণ্ড ঘোষণা-পরবর্তী জামিন দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরূপ ক্ষেত্রে আপিল দায়ের-পরবর্তী একমাত্র আপিল আদালত জামিন মঞ্জুর করতে পারেন।

দায়রা আদালত বলতে যুগ্ম দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং দায়রা জজ আদালতগুলোকে বুঝায়। যুগ্ম দায়রা আদালত পাঁচ বছরের বেশি এবং অপর যেকোনো দায়রা আদালত এক মাসের বেশি দণ্ড দিলে, এ ধরনের দণ্ডের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করতে পারে। দায়রা আদালতে প্রদত্ত দণ্ডের মেয়াদ পাঁচ বছরের নিচে হলে সচরাচর দেখা যায়, হাইকোর্ট বিভাগ মামলার গুণাগুণ পরীক্ষা ছাড়া আপিল গ্রহণ-পরবর্তী প্রথম শুনানির তারিখ জামিন মঞ্জুর করে থাকেন। এ ধরনের জামিন মঞ্জুরের বিষয়টি দীর্ঘ দিন ধরে অনুসৃত হওয়ার কারণে অনেকটা প্রথায় রূপ নিয়েছে। তা ছাড়া, নিম্ন আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় দণ্ডিত ব্যক্তি জামিনে থাকলে এবং এরূপ জামিনে থাকাবস্থায় দণ্ডিত ব্যক্তি জামিনের কোনো ধরনের অপব্যবহার না করলে আপিল আদালতের জামিন মঞ্জুর অনেকটা নিয়মমাফিক কাজ।

একজন ব্যক্তি নিম্ন আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় অথবা নিম্ন আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হওয়ার পর সম্পূর্ণ বা আংশিক কারাভোগ-পরবর্তী আপিল আদালতে দণ্ড বাতিল ঘোষিত হলে তিনি ইতোমধ্যে যে কারাভোগ করেছেন, আমাদের দেশে তার প্রতিবিধান বা প্রতিকারের কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে আপিল আদালতে যদি সাব্যস্ত হয়- একজন ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারাভোগ করেছেন, সে ক্ষেত্রে তাকে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে প্রতিকারের বিধান রয়েছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, মিথ্যা, হয়রানিমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ মামলা এবং রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণার্থে মামলার কারণে আমাদের দেশে অনেকে মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় অথবা বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাভোগের পর চূড়ান্ত বিচারে আপিল আদালতে খালাস পেয়েছেন। এ ধরনের কারান্তরীণ বা কারাভোগ দুঃখজনক, অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত। 
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement