২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজরাজড়াদের ভ্রান্তিবিলাস!

রাজরাজড়াদের ভ্রান্তিবিলাস! - ছবি : নয়া দিগন্ত

বিষয়টি একাধারে অদ্ভুত এবং একই সঙ্গে কাকতালীয়। কারণ, মহাকালের ইতিহাসের প্রায় সব মন্দপ্রকৃতির রাজা-বাদশাহ, সম্রাট-শাহেনশাহ এবং আমির-ওমরাহ সচরাচর একই ধরনের ভ্রান্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ক্ষমতার মসনদে বসামাত্র তারা এ আবেগ-বিবেক, সত্য-মিথ্যা, আপন-পর, শত্রু-মিত্র এবং ভুল-ভ্রান্তিকে এক করে ফেলেন। তাদের বিবেক, বোধশক্তি ও বিচারিক ক্ষমতা প্রায়ই দম্ভ, অজ্ঞতা, ক্রোধ আর হিংসা দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের কর্মশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতা প্রায়ই ভোগবিলাস, সঙ্গীত-নৃত্য এবং অশ্লীল ক্রীড়া-কৌতুকের ফাঁদে পড়ে দিনকে দিন নির্জীব হতে থাকে। লোভের জাল, মোহের ফাঁদ ও লালসার করালগ্রাস তাদেরকে ধীরে ধীরে অমানুষ বানিয়ে ফেলে। ফলে একটা সময় তারা সাধারণ মানুষের বিমূর্ত অভিশাপ ও ধিক্কারের জীবন্ত প্রতীক রূপে নিখিল বিশ্বের তাবৎ প্রাণিকুল, বৃক্ষলতা, পাহাড়-সমুদ্র-নদনদীসহ অনেককে সাক্ষী রেখে মর্মান্তিকভাবে ধ্বংস হয়ে যান।

রাজরাজড়াদের পচন এবং পরবর্তী নির্মম পতনের শুরু হয় কতগুলো সাধারণ ভ্রান্তির কারণে। ভ্রান্তির কবলে পড়ে তারা প্রথমে একের পর এক ভুল করতে থাকেন এবং পরে সেই ভুল ধামাচাপা দেয়ার জন্য অপরাধমূলক তৎপরতা চালাতে থাকেন। ক্ষমতালাভের পর তাদের প্রথম ভ্রান্তি হলো, তারা ক্ষমতাকে নিজেদের চিরস্থায়ী সম্পত্তি বলে ভাবতে থাকেন। দ্বিতীয়ত, শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছোট ও হেয় করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন।

তাদের আশপাশের যেসব ধান্ধাবাজ নানা কল্পিত দুর্নাম-বদনাম দক্ষতার সঙ্গে রচনা ও পরিবেশন করতে পারেন রাজা-বাদশাদের শত্রু এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে, ওদেরকে তারা দ্রুত কাছে টেনে নেন। ওদের নিত্যকার প্রয়োজনীয় আহার, নিদ্রা, বিশ্রাম এবং প্রাকৃতিক কর্মাদির মতো শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্নাম-বদনাম শোনা এক সময় অপরিহার্য হয়ে পড়ে এই শাসকদের জন্য। এগুলো না শুনলে তাদের যেমন পেটের ভাত হজম হয় না, তেমনি নিদ্রা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কর্মেও যেন ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।

ইতিহাসে এমন ঘটনাও দেখা গিয়েছে যে, মন্দ রাজা-বাদশাদের ক্ষমতা গ্রহণের প্রাথমিক স্তরে তাদের ছিল না কোনো শত্রু কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ভ্রান্তিবিলাসে আক্রান্ত হয়ে তারা খুব দ্রুত বেশ কিছু বন্ধু বা মিত্রকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন এবং কায়মনোবাক্যে তার প্রতি আস্থা ও আনুগত্য প্রদর্শনকারী রক্তের আত্মীয়কে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলেছিলেন। তারা এ কাজগুলো অতি দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছেন নিজেদের দু’টি ভ্রান্তির কারণে, যার একটির নাম সন্দেহ এবং অপরটির নাম নিজের প্রতি আস্থাহীনতা। রাজা-বাদশারা যখন নিজেদের যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা ও অন্তনির্হিত বুদ্ধিবিত্তিক ক্ষমতা সম্পর্কে বেখবর থাকেন, তখন তাদের মধ্যে যে ভ্রান্তি তৈরি হয় তা খুব দ্রুত তাদেরকে বহু শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী জোগাড় করে দেয়। অধিকন্তু এ শ্রেণীর ভ্রান্তির কারণে কখনো কখনো রাজরাজড়া নিজেরাই নিজেদের শত্রু অথবা প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হন।

আজকের শিরোনামটিকে পাঠকদের কাছে আরো সহজবোধ্য করার জন্য ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিতে চাই। মধ্যযুগের ভারতবর্ষে যখন সুলতানি আমল চলছিল, তখন কুতুবুদ্দিন মুবারক শাহ নামের একজন তরুণ সুলতান দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি ছিলেন ইতিহাসবিখ্যাত খিলজি বংশের সদস্য এবং সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির পুত্র। ১৩১৬ সালে তিনি যখন সিংহাসনে বসলেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৭ কিংবা ১৮ বছর। তার পিতার হত্যাকারী সেনাপতি মালিক কাফুর তার ছয় বছর বয়সী বৈমাত্রেয় ভাইকে সিংহাসনে বসিয়ে তাকে কারারুদ্ধ করেন। রাজদরবারের প্রায় সব আমির-ওমরাহ, রাজধানীর অভিজাতবর্গ, আলেম-ওলামা এবং সৈন্যবাহিনী জনগণকে নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মালিক কাফুরের পতন ঘটান এবং মুবারক শাহকে কারাগার থেকে বের করে সিংহাসনে বসালেন।

ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে কুতুবুদ্দিন মুবারক শাহের মতো জনসমর্থন নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিল্লির সিংহাসনে অন্য কোনো শাসক আসীন হননি। তার সুবিখ্যাত পিতার দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত সামরিক-বেসামরিক আমলা, অভিজাতবর্গ এবং অনুগত প্রজারা তাকে সর্বান্তকরণে সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন জোগাতে থাকেন। ফলে একটি সর্বোত্তম শাসনামল উপহার দেয়ার মতো সব সুযোগ সুবিধা তার করায়ত্ত ছিল; কিন্তু তিনি সেগুলো ব্যবহার না করে নতুন শত্রু খোঁজার পাশাপাশি নতুন মিত্র জোগাড় করে ফেললেন। তারপর কল্পিত শত্রুকে বাস্তব শত্রু বানানোর নিরন্তর চেষ্টার পাশাপাশি নতুন মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বিনোদনের নামে এমন অশ্লীলতা শুরু করেন, যা বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে অন্য কোনো শাসক করেননি। এমনকি তিনি হাসান ও হিসাম নামক দুই সহোদরের সঙ্গে সমকামীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যারা মূলত ছিল তার ক্রীতদাস। তিনি হাসানকে প্রথমে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন এবং খসরু খান উপাধিতে ভূষিত করেন।

সুলতান কুতুব উদ্দিন মুবারক শাহ এবং খসরু খানের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে অচিরেই সাম্রাজ্যের কৌশলগত এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোতে গোলযোগ দেখা দেয়। আলেম-ওলামা প্রকাশ্যে সুলতানের সমালোচনা শুরু করতে বাধ্য হন। বিশেষ করে দিল্লির মেহেরুলিতে বসবাসরত প্রবীণ আলেম হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া সুলতানকে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। সুলতানও এই বিখ্যাত আউলিয়াকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ অথবা গোপনে হত্যা করার পাঁয়তারা চালাতে থাকেন। সাম্রাজ্যের বহুমুখী গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে সুলতানের অনৈতিক মিত্র খসরু খান আরো ক্ষমতা, প্রভাব ও বিত্তের মালিক হয়ে যান এবং ১৩২০ সালের কোনো একদিন সুযোগ বুঝে সুলতানকে খুন করে নিজেই সিংহাসনে বসেন। ফলে ভারতবর্ষে খিলজি বংশের শাসনের অবসান ঘটে।

সুলতান কুতুব উদ্দিনের ভ্রান্তিবিলাস নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে বেশ কয়েকখানা বৃহদাকার তৈরি হয়ে যাবে। আজকের নিবন্ধের স্বল্পপরিসরের কারণে শিরোনাম প্রসঙ্গে বাকি কথাগুলো সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করি। বদ স্বভাবের মন্দ রাজারা সঙ্গী নির্বাচন করতে গিয়ে ভ্রান্তির জালে আটকা পড়েন। ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড অসৎ, বহুবিধ অপরাধকর্মে অভিজ্ঞ এবং প্রতারণা, ভণ্ডামি ও চরিত্রহীনতায় যাদের সফলতা সর্বজনবিদিত; সেসব লোক হঠাৎ সাধুবেশে রাজা-বাদশাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাজ-অন্তপুর থেকে শুরু করে রাজার ক্ষমতার প্রতিটি কেন্দ্রে অনায়াসে পৌঁছে যান এবং রাজার প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে নিজেকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে অক্ষম হন, যেখান থেকে তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। এই শ্রেণীর লোকজন সম্পর্কে রাজার ভ্রান্তির কারণে সাধারণত তিনটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রথমত, রাজাদের প্রতি প্রচণ্ড মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তার বেঁচে থাকা অথবা টিকে থাকার জন্য তাদেরকে অপরিহার্য মনে করেন। তাদের বিরুদ্ধে রাজার কাছে কেউ অভিযোগ করতে পারেন না। কেউ যদি সাহস করে এমনকি ‘বোকামি’ করে অভিযোগ করে বসেন, তবে অভিযোগকারীর ভাগ্যে তিরস্কার; শাস্তি অথবা ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত জুটে যায়। দ্বিতীয়ত, এই শ্রেণীর লোক যুগপৎভাবে রাজা, রাজ্য এবং জনগণের ক্ষতি করতে থাকে অবিরতভাবে এবং এ কারণে মানুষের ঘৃণা, বিরক্তি ও অভিশাপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তৃতীয়ত, তাদের কারণে জনগণ এক সময় সরাসরি রাজাকে দায়ী করে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, রাজা স্বয়ং আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে লোকটির দ্বারা বা লোকসকলের দ্বারা অপকর্ম করাচ্ছেন ব্যক্তিগত লাভ ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

রাজ-রাজাদের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ভ্রান্তি হলো- তারা চাটুকারদের দ্বারা প্রলুব্ধ, প্রভাবিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন। তাদের সামনে এসে যারা সত্যের চেয়েও সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে, অকারণ মায়াকান্নায় কুমিরাশ্রুর বন্যা বইয়ে দিতে পারে এবং রাজার ব্যক্তিগত দুর্বলতম স্থানে আবেগের পরশ লাগিয়ে তাকে বিভ্রান্ত অথবা হতবিহ্বল করতে পারে- রাজা তাদের চটজলদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ ও পদবি দ্বারা পুরস্কৃত করে থাকেন। ফলে রাজার সত্যিকার শুভার্থীরা অপমানিত বোধ করে নিজেদের গুটিয়ে নেন। রাজা তখন চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে নতুন নতুন ভ্রান্তির স্বপ্নবাসর রচনা করে ভ্রান্তির দোলনায় চেপে মরণ অবধি দোল খেতে থাকেন।

ভ্রান্তিবিলাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বৈশিষ্ট্য হলো, ভ্রান্ত রাজারা সব সময় অযোগ্য লোকদের যোগ্য ব্যক্তিদের স্থানে বসান এবং যোগ্যতমদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। তারা রাজ্যপরিচালনায় বলপ্রয়োগ নীতি অবলম্বন এবং ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করে থাকে। তাদের নিয়োগকৃত অযোগ্য লোকেরা প্রায় ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত আবেগ প্রদর্শন করে খোদ রাজার ক্ষতি সাধন করে বসে। অযোগ্য ও অদক্ষ অমাত্যরা রাজাকে খুশি করার মানসে বিবেক-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে সব সময় রাজার পছন্দ কিংবা অপছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন। ফলে অস্ত্র অনাচার, অবিচার, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা তীব্র গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এসব অমাত্য আবেগের বশে রাজার উপকার করতে গিয়ে প্রকারান্তরে ক্ষতি করে বসেন এবং রাজার ভ্রান্তিকালে হয় তারা নির্বোধের মতো গণরোষের কবলে পড়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান নতুবা কাপুরুষের মতো উল্টোপথে পালাতে চেষ্টা করেন।

ভ্রান্ত রাজাদের ভ্রান্তিবিলাসের পরিণতির কথা বলেই আজকের প্রসঙ্গ শেষ করছি। মানব জাতির ইতিহাস যতটুকু জেনেছি তাতে দেখেছি, প্রত্যেক ভ্রান্ত রাজা কেবল নিজে ধ্বংস হননি, তিনি তার পাত্র-মিত্র, বন্ধু-বান্ধব, বিনোদনের সঙ্গীদের নিয়ে ধ্বংস হয়ে যান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন ঘটনাও ঘটে যে, রাজা তার বশংবদদের নিয়ে এমনভাবে সমূলে ধ্বংস হয়ে যান যে, পরবর্তী প্রজন্ম এই ধরাধামে পতিত রাজার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পান না।


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ৩ মামলা তৃণমূল সংগঠনের মজবুতির জন্য কাজ করতে হবে : মাওলানা আব্দুল হালিম ‘দেশ ও জাতি দুঃসময় পার করছে’ ওসমানীনগরে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ২ সহ-অধিনায়ক হতে পারেন রিজওয়ান মেক্সিকোয় মেয়র প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহেও ক্লাস বন্ধ ঘোষণা দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের

সকল