১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ট্রাম্প-কিম বৈঠক

ট্রাম্প-কিম বৈঠক - ছবি : এএফপি

সিঙ্গাপুরে দুনিয়ার জন্য নির্ধারক এক বিশেষ ঘটনার দিকে এখন সবার দৃষ্টি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের মধ্যে সিঙ্গাপুরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইকোনমিস্ট পত্রিকার ভাষায়, কোনো ক্ষমতাধর পরাশক্তি যখন কোনো তুলনামূলক ছোট রাষ্ট্রের সাথে বৈঠক থেকে ‘উইন-উইন’ ফল আসবে বলে জানায়, মানে তাতে ‘উভয় পক্ষের জন্য জিত’ হবে বলে ঢোল পেটায়; তখন এটা নিয়ে কূটনীতিকেরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেন। কারণ, তাদের কাছে এসব ক্ষেত্রে ওই উইন-উইন কথার অর্থ এখানে বিষয়টি দু’জনেরই লাভালাভ নয়, বরং কেবল একজন, পরাশক্তি অংশটির একারই দুইবার বিজয়। এটাই উইন-উইন কথার আসল অর্থ। কিন্তু ইকোনমিস্ট সাবধান করে বলছে, এবারের ঘটনাটা হবে ব্যতিক্রম। কেন?

প্রথম কথা হলো, ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে কী পাওয়ার আশা করে? অথবা আরো গোড়ার প্রশ্ন, ট্রাম্প এমন বৈঠকে বসতে রাজি হলেন কেন? তার তাগিদ কি অনেক? কী সেই তাগিদ বা দুর্বলতা?
ঘটনার পটভূমি এখানে খুবই পুরনো, সেই ১৯৫০-এর দশকের। আসলে সময়টা হলো যখন থেকে কমিউনিস্টরা আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে ডাকা বা গালি দেয়া শুরু করেছিল। কারণ, এর আগে আমেরিকার হাতে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না। ছিল ইউরোপের ব্রিটিশ বা ফ্রান্সের মতো কলোনি মাস্টারদের হাতে। অথবা এই বিচারে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চে যখন দুনিয়ার নেতৃত্ব ও ক্ষমতার প্রথম এক পালাবদল মঞ্চস্থ হচ্ছিল ইউরোপের কলোনি মাস্টারদের থেকে আমেরিকার হাতে। এরই অপর পিঠ হলো মিলিত কোরিয়া জাপানের কলোনি হয়ে ছিল আর যুদ্ধে পরাজিত জাপানের হাত থেকে কোরিয়া মুক্ত হয়েও স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, নাকি আবার ইউরোপের কারো অধীনে নতুন করে চলে যাবে; তার ফয়সালা আসতে দেরি হচ্ছিল।

আমেরিকার রুজভেল্টের স্বপ্ন বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না কাউকে নিজের কলোনি করে রাখায় অথবা কাউকে কলোনি করতে দিতে। ফলে ১৯৪৫ সালে তার হঠাৎ মৃত্যুতে পরের প্রেসিডেন্ট ও রুজভেল্টের ভাবশিষ্য হ্যারি ট্রুম্যানের নীতিও তা নয়। কিন্তু ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনে বিজয়ী নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ নেন বিশ্বযুদ্ধের সেনাপতি আইসেনহাওয়ার। আর এতেই ঝুলে থাকা ট্রুম্যানের আমেরিকান নীতির দ্বিধা বা লড়াই যে কলোনি-উত্তর পরিস্থিতিতে কোরিয়া কি আমেরিকার কলোনি হবে নাকি কমিউনিস্ট কোরিয়া হবেÑ এবার সেটি এক নির্ধারক পথে যাত্রা শুরু করে।
আমেরিকা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ‘কোরিয়া যুদ্ধ’ শুরু করে। তবে এই যুদ্ধ লম্বা সময়ব্যাপী অমীমাংসিত হয়ে থাকায় শেষে এ থেকে বের হতে কমিউনিস্ট কোরিয়া আর আমেরিকা প্রভাবিত কোরিয়া এভাবে দুই রাষ্ট্রে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে আপসরফায় ভাগ হয়ে যায়। সামনে উদাহরণও ছিল ১৯৪৯ সালে বিপ্লব করা মাওয়ের চীন। সেটাও চীন বিপ্লবের শেষের দিকে মূল চীন থেকে দ্বীপাঞ্চল তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র বলে ভাগ করে বিপ্লব বা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি করা হয়েছিল।

আসলে পুরনো জাপানিজ কলোনি কোরিয়া মুক্ত হয়ে আমেরিকান প্রভাবমুক্ত কোরিয়া হবে, না কমিউনিস্ট কোরিয়া হবে- এ বিষয়টিরই আপাতমীমাংসা মনে করা হয়েছিল কোরিয়া ভাগ করে দিয়ে। ফলে এটাকে বলা যায় সোভিয়েত-মার্কিন ‘কোল্ড ওয়ারের’ যুগ শুরুর অন্যতম উদাহরণ। আর সেই সময় থেকে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে নিজের সেনা ব্যারাক বানিয়ে অবস্থান নিয়েছিল, যা এখনো বর্তমান। আর তা থেকে এর পরে আরেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে এসে যেকোনো সময় উত্তর কোরিয়ায় হামলা করতে পারে, উত্তর কোরিয়ায় এই আশঙ্কা বাড়তে থাকে। আর এই চাপ থেকে মুক্ত হতে একমাত্র সমাধান হিসেবে সে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে যায় ও সফলতা লাভ করে। এতে চাপ এবার উল্টো আমেরিকার ওপর পড়ে। আমেরিকা বোঝে যে, উত্তরকে কোনো রকম ভুলভাবে নাড়াচাড়া করলে পারমাণবিক বোমার বিপর্যয় দেখতে হতে পারে।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়া প্রমাণ করেছিল, পারমাণবিক বোমা লাভ নিঃসন্দেহে দুনিয়ায় প্রাণ প্রকৃতি ও জীবন টিকে থাকার দিক থেকে খুবই বিপজ্জনক ও চরম আত্মধ্বংসী ও ক্ষতিকারক এক কাজ। তা হওয়া সত্ত্বেও অন্য আরেক দিক বিচারে পারমাণবিক বোমা অর্জন আর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রায় সমার্থক। বোমা নিজ নাগালে থাকলে আমেরিকার মতো পরাশক্তির হাত থেকেও নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব। আবার এটাও ঠিক, এই বোমা অর্জন মানে গরিব দেশের জনগোষ্ঠীর সীমিত সম্পদের বিপুল পরিমাণ ওই অর্জনের খরচ জোগাতে ব্যয় হয়ে যায়। উত্তর কোরিয়া তবুও সব বিবেচনা শেষে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকেই প্রাধান্যে রেখে অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

অপর দিকে এতে আমেরিকার দিক থেকেও কিছু সান্ত্বনা ছিল যে, উত্তর কোরিয়ার বোমা সরাসরি আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছানোর যোগ্য নয়। কারণ, আমেরিকা হাজার পাঁচেক মাইল দূরে আরেক মহাদেশে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে আমেরিকান স্থাপনা বা বিনিয়োগ সহজেই উত্তর কোরিয়ান বোমার নাগালে ছিল, এটাও কম ঝুঁকি বা বিপদের নয়। তবে সামগ্রিক ফলাফলে সেই থেকে কোরিয়া-জাপান-চীন এশিয়ার এই কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলের প্রায় সবার (আমেরিকাসহ) পকেটে পারমাণবিক বোমা আছে বলে কেউই আর যুদ্ধের ঝুঁকিতে যায়নি, এড়িয়ে চলতে পেরেছে। কিন্তু ভুলচুকে বা উত্তেজনায় কখনো সবাই বোমা খেয়ে মরতে হতে পারে, পারমাণবিক বোমার ভয়ে ভীতিকর সেই সম্ভাবনা ওই অঞ্চলে আছে।

ইতোমধ্যে বিশ্বব্যবস্থায় দু’টি বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমটি চীনের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে নিশ্চিত উত্থান ঘটেছে আর সম্ভাব্য গ্লোবাল লিডার হিসেবে আমেরিকার জায়গা দখল করার সক্ষমতার দিকে যাচ্ছে। এ ছাড়া, বিশ্বের উদ্বৃত্ত সম্পদ একুমুলেশন বা সঞ্চিত হওয়ার একমাত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী গন্তব্য হয়েছে এখন চীন। ফলে ভিন্ন শব্দে বললে চীন এখন একমাত্র ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সক্ষমতার কেন্দ্র। ফলে এক নির্ধারক রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী এখন চীন। এ দিকে যত সম্পদ বাড়ে ততই সেটি সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তাও বেশি হয়, চীনের এই স্বার্থ বা ফলে তার কথার ওজনও অন্য সবার চেয়ে বেশি ভারী হয়ে ওঠে। যদিও চীন খোদ নিজে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়েছিল সেই ১৯৬৪ সালে; তবুও চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের সাথে সাথে পারমাণবিক বোমা ঝুঁকিতে থাকা তার নিজের অঞ্চলকে মুক্ত দেখার এক তাগিদ চীনের ভেতর দেখা দেয়াই স্বাভাবিক। ফলে এ সম্পর্কে একটা নীতির কথা চীন বলা শুরু করে তখন থেকে। তা হলো, কোরিয়া-জাপান-চীনের ওই পুরো অঞ্চলকেই পারমাণবিক বোমামুক্ত করা। এতেই সবার স্বার্থ সুরক্ষিত হতে পারে। আরো ভেঙে বললে ওই অঞ্চলে আমেরিকান কোনো সেনাঘাঁটিতে অথবা তাকে আশ্রয় দেয়া কোরিয়া ও জাপানের হাতে অথবা চীনের হাতেও কিংবা সম্ভাব্য অন্য কারো হাতে বোমা মজুদ না রাখাÑ এই নীতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যে আসা। যদিও সবচেয়ে বড় প্লেয়ার আমেরিকা কখনো চীনের এই প্রস্তাবের প্রতি গরজ দেখায়নি। অর্থাৎ এই প্রস্তাবের ভেতরে আমেরিকা নিজের তাৎক্ষণিক স্বার্থ দেখেনি; বরং পাল্টা উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের ডালি খুলে বসে থেকেছে সব সময়। যদিও সেসব অভিযোগ আবার মিথ্যাও নয়। উত্তর কোরিয়াও আবার আমেরিকার বিরুদ্ধে নিজের নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে রাখার জন্য হাজারটা অভিযোগ তুলতে পারবে, সেগুলোও মিথ্যা নয়। তাতে প্রেসিডেন্ট বুশ উত্তর কোরিয়াকে ‘এক্সিস অব এভিল’ বলে ক্ষোভ ঝাড়লেও কিছু এসে-যায় না। উত্তর কোরিয়া পাকিস্তান বা ইরানকে বোমা সংগ্রহ ও অর্জনে সাহায্য করেছে, এ কথা মিথ্যা নয়। এক কথায় বললে ১৯৪৫ সালে জাপানে আমেরিকার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ, অর্থাৎ ব্যবহার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর থেকে সোভিয়েত-মার্কিন সমঝোতা হয় যে, দুনিয়ায় আর সব রাষ্ট্রকে বোমা অর্জন থেকে দূরে রাখা তাদের উভয়েরই স্বার্থ। ফলে বলা যায়, এর উল্টো ফলে এখান থেকে এ দুই রাষ্ট্রের বাইরের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে টেকনোলজি শেয়ারের এক নতুন দুনিয়া শুরু হয়েছিল। তবে ওয়ার অন টেররের আমলে ব্যাপারটি কিছু নতুন মাত্রা পেয়েছিল আমেরিকার এই ভয় থেকে যে, সশস্ত্র ইসলামি রাজনীতির ধারাগুলো এই টেকনোলজি বা বোমা যেন হাতে না পেয়ে যায়। উত্তর কোরিয়া যেন এর সরবরাহকারী হিসেবে না হাজির হয়ে যায়। সেই সম্ভাবনা ঠেকানোর অভিপ্রায় থেকেই বুশ ‘এক্সিস অব এভিল’-এর তত্ত্ব হাজির করেছিলেন।

ইতোমধ্যে একালের উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় নতুন ঘটনা হলো উত্তর কোরিয়ার ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল অর্জন। মানে মহাদেশ টপকিয়ে মিসাইল ছুড়ে মারার যে সীমাবদ্ধতা উত্তর কোরিয়ার ছিল, তা সে কাটিয়ে তুলতে পেরেছে। এসবের ঘোষণাও প্রকাশ হয়ে পড়া থেকেই নতুন তোলপাড় শুরু হয় কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলে। চীনের পুরনো প্রস্তাব আবার আলো-বাতাস পায়। আমেরিকা এখন তার যৌবন হারিয়ে উত্থান রহিত শরীর ও ক্ষমতায় যখন এটা তার মুরব্বিয়ানা ঢলে পড়ার আমলে এসে গেছে তখন এসব ঘটছে। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের ডালি খুলে লড়াই শুরু করেছে। ট্রাম্প লজ্জার মাথা খেয়ে চীনকে নিজের প্রভাব বিস্তার করে উত্তর কোরিয়াকে মানাতে কাজ করতে অনুরোধ করে। অর্থাৎ আমেরিকান প্রভাব এখানে ভোঁতা ও অকার্যকর, সেটাই যেন মেনে নিয়েছিল আমেরিকা। সবচেয়ে বড় কথা, অতি দ্রুততায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাম্প চীনকে তাগিদ দিয়ে জানান, উত্তর কোরিয়াকে ডি-নিউক্লিয়ারাইজড অবস্থায় তিনি দেখতে চান। এর জন্য আমেরিকাকে কী কী করতে হবে সেসব শর্ত নিয়ে কথা শুরু করতে তিনি রাজি। এ অংশটির সিদ্ধান্ত ট্রাম্প নিয়েছিলেন কল্পনার চেয়েও দ্রুততায়। ফলে চীন মাঠে নেমে তৎপরতায় নিজের প্রভাব ব্যবহার করে কাজে নেমে যায়।

আগামী দিনে ইতিহাস লিখতে বসে ঐতিহাসিকেরা নিশ্চয়ই মৃদু তর্ক করতে পারেন যে, কবে থেকে অথবা কোন ঘটনা থেকে চীন আমেরিকাকে হটিয়ে সেই জায়গায় বসে দুনিয়াকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছিলÑ সেই প্রারম্ভিক ঘটনা কোনটি? সেই প্রারম্ভিক ঘটনাটি কী হবে, তাই যেন নির্ধারিত হতে যাচ্ছিল প্রায়। সেটি হতো সম্ভবত চীনা উদ্যোগে আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পারমাণবিক ইস্যুতে সমঝোতা ঘটিয়ে দেয়া।
বলছি এ জন্য যে, এটা যত দ্রুত ঘটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তাতে হঠাৎ ‘জন বোল্টন’ সিম্পটম দেখা দেয়ায় ছেদ ঘটে যায়। ফলে তা থমকে দাঁড়িয়েছিল। আগে ঠিক হয়েছিল ১২ জুন সিঙ্গাপুরে ট্রাম-কিম সরাসরি এক আলোচনা থেকে চীনা উদ্যোগ কাজ শুরু করবে।

জন বোল্টন এখন ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, একজন হকিস্ট বা যুদ্ধবাজ। বুশের আমলে তিনি জাতিসঙ্ঘের আমেরিকান প্রতিনিধি ছিলেন, আজকের নিকি হ্যালি যে পদে আছেন। বোল্টনের বৈশিষ্ট্য হলো, বল প্রয়োগ আর জবরদস্তিই সব কিছুর উপযুক্ত সমাধান বলে বিশ্বাসী তিনি। ট্রাম্পের গ্রিন সিগনালে চীনা উদ্যোগ পারমাণবিক সমঝোতার তৎপরতা যখন মাঠে কাজে নেমেছিল, সে সময় হঠাৎ করে সম্ভবত সেকেন্ড থট হিসেবে ট্রাম্প পিছটান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর এরই বাস্তবায়নে তিনি বোল্টনকে ভিলেন করে মাঠে ছেড়ে দেন বলে অনেকের অনুমান। লিবিয়ার গাদ্দাফির কথা আমাদের মনে আছে। তিনিও তার পারমাণবিক কর্মসূচি যা ছিল তা গুটিয়ে রেখে আমেরিকার সাথে ডিল করতে গিয়েছিলেন, আমেরিকা লিবিয়ায় আক্রমণে যাবে না- এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। কিন্তু মাঝখানে ওবামার আমলে আরব ¯িপ্রংয়ের উত্থানের কালে আমেরিকা বিশ্বাসঘাতকতা করে ওই দুর্বলতার সুযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও নৃশংসভাবে পাবলিক লিঞ্চিংয়ে হত্যা করেছিল। জন বোল্টন এক টিভি কথোপকথনে ‘লিবিয়া মডেল’ প্রয়োগ করবেন বললে সেখান থেকেই এই সন্দেহের ঝড় উঠে আসে।

তবে মূল বিবাদ বা ছেদমূলক ঘটনা ঘটে যখন উত্তর ও দক্ষিণের প্রেসিডেন্টদ্বয় পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও কথাবার্তার কারণে ইতিবাচক আবহ তৈরি হয়েছিল; কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ করে দক্ষিণ কোরিয়া আর আমেরিকা যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করে। আর তা থেকে উত্তর কোরিয়ার কিম সব যোগাযোগ-আলোচনা ভেঙে দেন। তিনি দক্ষিণের প্রেসিডেন্টকে ঘটনার গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে ‘অজ্ঞ’ ও ‘অযোগ্য’ বলে অভিযুক্ত করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার নেপথ্যের সংবাদ হলো, জেনারেলরা নিজ স্বার্থে ও আমেরিকান প্ররোচনায় এই কাজ করেছিল। উত্তর কোরিয়ার কিমের ঘোষণার ফলে ১২ জুনের বৈঠক অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরে এবার ট্রাম্পের দিক থেকে ২৫ মে ওই বৈঠক বাতিল উল্লেখ করে কিমকে চিঠি দেয়া হয়। ফলে সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে যায়।

এতে চীন নিজে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত বলে আমেরিকাকে নিজের উদ্বিগ্নতার কথা জানিয়ে বলে, কোরিয়া উপদ্বীপকে অনিশ্চয়তায় ফেলে রাখলে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চীন। ফলে ট্রাম্প এটাকে আবার উদ্যোগ নেয়ার অছিলা হিসেবে নেয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করে উত্তরে সফরে যান। আর তাতেই আবার ১২ জুনের বৈঠক প্রাণ ফিরে পায়।
এতে ফলাফল কী আসবে, সেটি জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ঘটনার শুরু থেকেই কোনো পশ্চিমা মিডিয়া বা একাডেমিক বা থিংকট্যাংক ধরনের প্রতিষ্ঠান- কেউ ট্রাম্পের কথা বা কাজের ওপর আস্থা রেখেছেন, এমন দেখা যায়নি। যেমন বোল্টনের মন্তব্যের সময় থেকেই মিডিয়ায় সব ধরনের ভাষ্যের সারকথা ছিলÑ কোন ডিল কেমন করে না করতে হয়, ভেঙে দিতে হয়, এড়িয়ে যেতে হয়; ট্রাম্প তার ওস্তাদি আমাদের দেখাচ্ছেনÑ এই ছিল তাদের মূল্যায়ন। অর্থাৎ সব কিছুর দায় এককভাবে পশ্চিমা সমাজ ট্রাম্পের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। ট্রাম্পের একা চলার নীতি যেমন এই বৈঠকে দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের স্বার্থের দিক থেকে কথা তুলবে না, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে। হ
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement