২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল

ফারাক্কা -

বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক ক’দিন আগে ঢাকার প্রেস ক্লাবের এক সভায় বলেছেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি হলে বাংলাদেশ পানির অভাবে পড়বে বলে উপলব্ধি করেছিলেন। তার বক্তব্য মনে হয় ঠিক ঐতিহাসিক নয়। কেননা, ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৫৪ সালে। এ সময় সাবেক পাকিস্তান সরকার ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরির বিপক্ষে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অন্য দিকে ভাসানী কেবলই করে চলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা। তিনি এ সময় ছিলেন একজন কড়া বিপ্লবী। তিনি ফারাক্কা ব্যারাজ নিয়ে এ সময় কোনো কথাই বলেননি। অনেক পরে তিনি করেছিলেন ফারাক্কা মিছিল। আর এই মিছিল করতে পেরেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিশেষ সহযোগিতায়। এটা তার একক প্রচেষ্টার ফল ছিল না। কিন্তু এখন কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী বলতে চাচ্ছেন, এই মিছিল ছিল কেবলই ভাসানীর একক উদ্যোগের ফল।

অনেকেই জানেন না যে, ভাসানীর মিছিলের একদিন আগে তিনি রাজশাহীতে ঘরোয়া সভায় প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, তড়িঘড়ি করে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়া ভুল হয়েছে। ভেঙে দেয়া না হলে গঙ্গার পানি পাওয়া অনেক সহজসাধ্য হতো। কেননা ভারতের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হতো পূব ও পশ্চিম থেকে, যা এখন আর সম্ভব নয়। ভাসানীর রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আসা অনেককে বিস্মিত করেছিল। কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ভাসানী বলেছিলেন, তিনি ভোটে বিশ্বাস করেন না। তিনি চান ভোটের আগে ভাত। কিন্তু সেই তিনি, আবার ভোট হবার পরে বলেছিলেন, ভোট আসলে হয়েছে গণভোট। পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাতে হবে ‘স্লামালেকুম’।
ভাসানীকে সবাই জানত চীনপন্থী কমিউনিস্টদের পক্ষে। কিন্তু তিনি একাত্তরে যান ভারতে। কলকাতায় বন্দী হয়ে থাকেন ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে। ভাসানীর রাজনীতি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল খুবই কঠিন। এই ভাসানী দেশে ফিরে হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একজন সহযোগী। আর তার নির্দেশেই তিনি দেন ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব। এই হলো বিখ্যাত ফারাক্কা মিছিলের পটভূমি। আমি তাই ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতনামা অধ্যাপকের বচনের সাথে ঐকমত্য পোষণ করতে পারছি না। সে সময় থেকে এখন নদীর পানির সমস্যা হয়ে উঠেছে আরো অনেক জটিল।

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পানি আসে গঙ্গা নদী দিয়ে নয়, ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য ২৬৭০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থল হল চীনে তিব্বতের মানস সরোবর থেকে। যেসব নদীর উদ্ভব হ্রদ থেকে হয়, তাদের আমরা বাংলায় নদী না বলে উল্লেখ করি নদ বলে। যেমন সিন্ধু নদ, ব্রহ্মপুত্র নদ, নীলনদ। গঙ্গা নদী কোনো হ্রদ থেকে হয়নি। এর উদ্ভব হয়েছে হিমালয়ের তুষার নদী গঙ্গোত্রী থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদকে তিব্বতে বলা হয়, সাং-পো (ঞংধহম-চড়)। ব্রহ্মপুত্র নদের ১৪৪৩ কিলোমিটার পড়েছে তিব্বতের মধ্যে। একে তাই প্রায় বলা চলে তিব্বতের নদী।
চীন সরকার চাচ্ছে এই নদীর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে তিব্বতে পানি সেচব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন। চীন এটা করলে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে পানি আসা অনেক কমে যাবে। আগে ছিল কেবল গঙ্গার পানির সমস্যা। কিন্তু এখন আমাদের ভাবতে হবে ব্রহ্মপুত্রের পানি সমস্যা নিয়েও। চীনের সঙ্গে আমাদের হওয়া উচিত পানি সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ চুক্তি। না হলে আমাদের পানি-সমস্যা নিকট ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে খুবই জটিল।

ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ করেছিল তিন কারণে। কলকাতা বন্দরে নাব্যতা রক্ষা; ফারাক্কা ব্যারাজের ওপর দিয়ে রেলপথ ও সড়কপথ নির্মাণ করে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের যোগাযোগ স্থাপন এবং ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে গঙ্গার পানি আটকিয়ে যুদ্ধের সময় সাবেক পাকিস্তানকে যুদ্ধে কাবু করা। চীন সাং-পো নদীর ওপর যে ব্যারাজ তৈরি করছে, তার লক্ষ্য কৃষি-উন্নয়ন। তাই ফারাক্কা ব্যারাজ আর সাং-পো ব্যারাজ উদ্দেশ্যের দিক থেকে তুলনীয় নয়। ভারতের সাথে আমাদের যেরকম ঐতিহাসিক বিরোধ আছে, চীনের সাথে তা নেই। তাই চীনের সাথে একটা পানি চুক্তি অনেক সহজেই হতে পারে। অবশ্য চীনের সাথে ভারতের আছে চরম বিরোধ।
ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বত থেকে সরাসরি বাংলাদেশে বয়ে আসছে না, বয়ে আসছে ভারতের মধ্য দিয়ে। তাই এই নদীর পানি বিরোধ নিষ্পন্ন হলে লাগবে তিনটি দেশের সম্মতি। এই সম্মতির ব্যাপারটা নিতে পারে জটিল রূপ। ফারাক্কা ব্যারাজ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তাতে তার কার্যকারিতা আর থাকছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, গঙ্গা নদী এখন মুর্শিদাবাদের দিকে না ভেঙে, ভাঙছে উত্তরে মালদহের দিকে। অর্থাৎ গঙ্গা নদীর নতুন খাত সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। গঙ্গা নদীর প্রবাহ বিশেষভাবেই বদলে যেতে চলেছে।

ভারতে যা গঙ্গা নদী, বাংলাদেশে তার নাম হয়েছে পদ্মা। গঙ্গা নদী ফারাক্কা ব্যারাজের উত্তরভাগ ঘুরে এসে যুক্ত হতে চাচ্ছে পদ্মা নদীর সাথে। নদীর ঢাল যে দিকে থাকে, নদীর পানি সেদিকেই গড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই গঙ্গার পানি তাই গড়িয়ে আসবে বাংলাদেশের মধ্যে। এরকমই আমার ধারণা। ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হয় জিয়া যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। মোরারজি দেশাইয়ের পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। বাজপেয়ী আমাদের যথেষ্ট পানি দিয়েছিলেন। কিন্তু মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ক্ষমতায় আবার আসেন ইন্দিরাগান্ধী। তিনি আমাদের পানি দিতে চান না। এরপর আবার ইন্দিরা সরকারের পতন হয়। দেবগৌড়া হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দেবগৌড়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় গঙ্গার পানি বণ্টন-চুক্তি। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পেছনে ছিল পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর আন্তরিক প্রচেষ্টা। আমরা অবশ্য এখনও বাস্তবে প্রতি বছর শুকনো মওসুমে (১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে) চুক্তি অনুসারে পানি পাচ্ছি না। কিন্তু এই চুক্তির ফলে একটি লাভ হয়েছে, তা হলো ভারত নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে যে, গঙ্গা নদীর পানির ওপর বাংলাদেশেরও অধিকার আছে।

ভারতের সাথে নতুন করে পানি বিরোধ দেখা দিয়েছে তিস্তার পানি নিয়ে। তিস্তা নদীর উদ্ভব হয়েছে সিকিমে। সেখান থেকে তা বয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে। সেখান থেকে সে বয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এটি বয়ে এসে পড়ছে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রে। তিস্তা এক সময় এসে পড়ত পদ্মা নদীতে। কিন্তু ১৭৭৭ সালে প্রবল বন্যার সময় তিস্তা তার খাদ বদলায়। এসে তিস্তা পড়তে আরম্ভ করে ব্রহ্মপুত্রে। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগকে বলে নতুন ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা। আর অন্য ভাগকে বলা হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। যা প্রবাহিত হয়েছে ময়মনসিংহ শহরের মধ্য দিয়ে। এই ধারাকে বলা হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।
ভারতের সাথে নদীর পানির বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বরাক নদীর পানি নিয়ে। এই নদীর উদ্ভব হয়েছে নাগা-মণিপুর জলপ্রপাত থেকে। সিলেট বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বরাক নদী বিভক্ত হয়েছে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দু’টি শাখায়। পরে সুরমা ও কুশিয়ারা একত্র হয়ে ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। নাম ধারণ করেছে মেঘনা। যমুনা ও পদ্মা নদী গোয়ালন্দের কাছে একত্র হয়ে পদ্মা নামে পরিচিত হয়েছে। এই পদ্মা ও মেঘনা একত্র হয়েছে চাঁদপুরের কাছে। এই একত্রিত ধারা মেঘনা নামে পরিচিত হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

ভারত চাচ্ছে বরাক নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে। কিন্তু এ রকম বাধ নির্মাণ করলে বাংলাদেশ আর আগের মতো বরাক নদীর পানি পাবে না। এ ক্ষেত্রেও তাই দেখা দিয়েছে একটা পানি বণ্টন চুক্তির প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ছিল একটা নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু সে আর আগের মতো নদীমাতৃক দেশ থাকছে না। তাকে এখন অধিক নির্ভরশীল হতে হবে বর্ষার বৃষ্টির পানির ওপর। বর্ষাকালে বাংলাদেশে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে পানির অভাব পূরণে। সাধারণত মরুময় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হয় বছরে ৫০ সেন্টিমিটারের কম। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো অংশেই বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এত কম নয়। বর্ষার পানি ধরে রেখে তাই পানির অভাব পূরণ করা সম্ভব। বাংলাদেশে শীতকালে বৃষ্টি হয় না। কিন্তু শীতকাল এ দেশে থাকে মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষভাগ পর্যন্ত। বাংলাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বাতাসের প্রভাবে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বাতাসে বঙ্গপোসাগরীয় শাখা বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প বহন করে আনে। যা জমে পরিণত হয় মেঘে। মেঘ থেকে হয় বৃষ্টি। মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ার একটা কারণ হলো, জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস হিমালয় পর্বতমালায় ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ফলে সহজে মেঘের উদ্ভব হয়। পাহাড় আছে বলেই এরকম বৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয়। না হলে হতো না।

দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর ভাগের যে অংশে থর মরুভূমি অবস্থিত, সেখানে আড়াআড়ি পাহাড় নেই বলে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস তাতে ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে মেঘে পরিণত হতে পারে না। এই অঞ্চল তাই বৃষ্টি বিরল অঞ্চল। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এরকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থাকছেই। যাতে মওসুমি বাতাস ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে মেঘ সৃষ্টি হবেই। হিমালয় পাহাড় পেরিয়ে মওসুমি বাতাস যখন তিব্বতে যায়, তখন তাতে জলীয়বাষ্প থাকে না বললেই হয়। তিব্বত তাই একটা বৃষ্টি-বিরল অঞ্চল ((Rain Shadow)। আমি প্রাথমিক ভূগোলের এসব কথা বলছি, কেননা অনেকেই বলছেন বাংলাদেশ ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে একটা মরুময় অঞ্চল। কিন্তু তার সম্ভাবনা নেই। ভৌগোলিক বাস্তবতার বিচারেই সেটা বলা যায়।

গত সংখ্যার সংশোধনী : গত লেখায় (১৯ মে ২০১৮) ভুলবশত ছাপা হয়েছে : ‘কার্ল মার্কস বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রথমে প্রবর্তিত হল বিলাতে।’ সেখানে আসলে হবে ‘কার্ল মার্কস বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রথমে প্রবর্তিত হবে বিলাতে।’

চিঠির উত্তর : নয়া দিগন্তের ২৩ মে ২০১৮ সংখ্যায় ফরিদ মুন্্শী, ঢাকা থেকে জানতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের জমিদারি পতিসরে একটি সমবায় কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি কি না। আমি এই সম্পর্কে বিশদ কিছু জানি না। যা জানি তাও কতটা নির্ভরযোগ্য সেটা নিয়ে আমার নিজের মনেই সংশয় আছে। তাই এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা সমীচীন হবে বলে মনে করছি না। রবীন্দ্রনাথ পতিসরের জমিদারি লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর নওগাঁর কালিগ্রাম মৌজার জমিদারি কিনেন ১৮৩০ সালে। পতিসর কালীগ্রাম মৌজায় অবস্থিত একটি গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ এই জমিদারি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। এ বিষয়ে যথাযথভাবে জানতে হলে পড়–ন সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখিত প্রবন্ধ ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ’ (দেশ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ২৫)।
শাহজাদপুর রবীন্দ্রনাথের জমিদারি নয়। শাহজাদপুর হলো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি। শিলাইদহ হলো গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি। এরা যখন নাবালক ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন এই দুই জমিদারি এদের পক্ষ হয়ে দেখাশোনা করতেন। তাই ভুল ধারণা জন্মেছে যে, এ দুটিও ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির জমিদারি ছিল বহু ভাগে বিভক্ত। এর ছিল অনেক শরিক। ১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুর স্টেশনের কাছে জায়গা কিনে শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে এখানে ‘ব্রহ্মাচার্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এতে কেবল হিন্দু ও ব্রাহ্মণ ছাত্ররাই পড়তে পারত। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে বিশ্বভারতী নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ এই অর্থের জন্য সে সময়ের ভারতে বিভিন্ন দেশীয় রাজাদের কাছে চাঁদা চেয়ে পাঠান। কিন্তু কোনো দেশীয় রাজা চাঁদা দেন না, একমাত্র হায়দ্রাবাদের নিজাম ছাড়া। তিনি এক লাখ টাকা চাঁদা দেন। এক লাখ টাকা সে সময় ছিল একটা বড় রকমের অঙ্ক। এই চাঁদা পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে কিছু হাতেগোনা মুসলমান ছাত্রের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। এসব ছাত্রের মধ্যে বিশেষ খ্যাত হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যা ছিল ব্রহ্মাচার্যাশ্রম, তাকে বলা হতে থাকে শান্তিনিকেতন। অর্থাৎ শান্তিনিকেতন হলো স্কুল আর বিশ্বভারতী হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এখন শান্তিনিকেতন অথবা বিশ্বভারতীতে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ ভবন’। যা নিয়ে খুব সোরগোল করা হচ্ছে। বিশ্বভারতীয় লেখাপড়ার ব্যাপারে তেমন কোনো নামকরা প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্বভারতী খ্যাতি অর্জন করেছে চিত্রকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাসে। এই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে ও করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলেই পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল। যারা হলেন আজকের বাংলাদেশের উদ্ভবের ভিত্তিভূমি। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে পালন করেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে তার মৃত্যুর পরে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের একদল বুদ্ধিজীবী বোঝাতে চাচ্ছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আসলে বিশ্বভারতীই হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতির উৎসভূমি। আমি জনাব ফরিদ মুনশীর চিঠির উত্তরে এসব কথার অবতারণা করছি এ জন্য যে, রবীন্দ্রনাথ কেমন জমিদার ছিলেন, সেটা আর আমাদের আলোচ্য হওয়া উচিত নয়। আলোচ্য হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশে যে বিশেষ রাজনীতি করা হচ্ছে, সেইটাই; যদি আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে চাই।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি চীনের আনহুই প্রদেশের সাথে ডিএনসিসি’র সমঝোতা স্মারক সই আ’লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষ : ২ শতাধিক ককটেল বিষ্ফোরণ, আহত ৫ রাঙ্গামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে নিহত ৬, আহত ৮ প্রতিবাদ সমাবেশকারীদের গ্রেফতারের নিন্দা জামায়াতের ‘সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না’ ফরিদপুরে বেইলি ব্রিজ অপসারণ করে স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন

সকল