২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চোকার আখ্যা থেকে বেরিয়ে এলো বাংলাদেশ

ত্রিদেশীয় ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ট্রফি হাতে টাইগারদের উল্লাস : এএফপি -

১৬ মে। ত্রিদেশীয় ফাইনালের আগের দিন। পাকিস্তানের লিজেন্ড ব্যাটসম্যান রমিজ রাজা ‘চোকার’ তকমা দিয়েই দিলেন বাংলাদেশকে। বড় আসরে নকআউট ম্যাচে এসে বার বার ব্যর্থ হয় বলেই বাংলাদেশকে এই তকমা। অনেক দিন ধরেই এই ‘চোকার’ শব্দটি দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের সঙ্গী।
বড় আসরে এসে তালগোল পাকিয়ে প্রোটিয়াদের হেরে বসার উদাহরণ নতুন নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটেও একই ধারা দেখতে পেয়েছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয়ী রমিজ রাজা, ‘বড় আসরে ভালো পারফরমেন্স নেই বাংলাদেশের। সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলেছে ছয়বার। কিন্তু কোনো ফলাফল পায়নি। ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপ ও নিদাহস ট্রফি, দুই আসরেই ফাইনাল হেরেছে বাংলাদেশ। বড় আসরে একটু হলেও চোকার হয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে চোকারের মতো খেলবে নাকি খেলবে না, সেটা সময়ই বলবে।’
না! তেমন কিছুই হয়নি। রমিজ রাজাসহ অমন চিন্তাধারার সবার মুখে তালা লাগিয়ে দাপটের সাথে খেলেই চোকার তকমা থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। তামিম-সৌম্য-মুশফিক-রিয়াদ-মোসাদ্দেক তাদের উইলোতে বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা সাউথ আফ্রিকা ননÑ তারা লাল-সবুজের পতাকা বহনকারী। যে রঙয়ে মিশে আছে ১৭ কোটি মানুষের ভালোবাসা। যাদের কাপ্তান হিসেবে আছেন ইনজুরিকে জয় করা এক বীর মাশরাফি বিন মুর্তজা। যারা একই সিরিজে পর পর তিনবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।
ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। ডাবলিনে গত শুক্রবার ফাইনাল ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। সিরিজে এর আগে দুইবারের মোকাবেলায় ক্যারিবীয়দের অনায়াসে হারিয়েছে টাইগাররা। স্বাগতিক আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচটা বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও শেষ ম্যাচে উইলিয়াম পোর্টারফিল্ডের দলকে হেসে-খেলে হারায় মাশরাফি বাহিনী। ফাইনালে তাই ক্রিকেটভক্তদের সবার ভাবনাতেই সুস্পষ্ট ফেভারিট বাংলাদেশ। শুধু দুর্ভাবনা ছিল আগের ফাইনালগুলোর ইতিহাস। এর আগে চারটি ওয়ানডে এবং দুটি টি-২০ টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠলেও একবারও শিরোপা জিততে পারেনি বাংলাদেশ দল। রমিজ রাজা সেটিকে পুঁজি করেই বলতে চেয়েছিলেন চোকার।
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো কোনো ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে সিরিজের ফাইনালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে মাহেলা জয়বর্ধনের লঙ্কান দলটির মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ১৫২ রানে অলআউট হয়ে যায় মোহাম্মদ আশরাফুলের দল। তবে বোলিংয়ে স্বপ্নের মতো সূচনা করে টাইগাররা। একপর্যায়ে মাত্র ছয় রানে শ্রীলঙ্কার প্রথম পাঁচজন ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ। কুমারা সাঙ্গাকারার দৃঢ়তার পরও একপর্যায়ে ১১৪ রানে আট উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা। তবে অনভিজ্ঞ রুবেল হোসেনের বলে বেধড়ক পিটিয়ে ১৬ বলে ৩৩ রান করা মুরালিধরন ১১ বল বাকি থাকতেই ম্যাচটা বের করে নেন।
২০১২ সালে এশিয়া কাপে শক্তিশালী ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দলকে ছিটকে দিয়ে ফাইনালে উঠে মুশফিকুর রহিমের বাংলাদেশ। ফাইনালে মিসবাহ-উল-হকের পাকিস্তানকে মাত্র ২৩৬ রানে আটকে রাখে। কিন্তু তামিম ইকবালের ৬০ এবং সাকিব আল হাসানের ৬৮ রান সত্ত্বেও ম্যাচের শেষ বলে গিয়ে মাত্র দুই রানে হারে টাইগাররা। দেশের মাটিতে আরেকটি ফাইনাল হারে ক্রিকেটারদের পাশাপাশি কান্নায় ভেঙে পড়ে পুরো জাতি।
২০১৮ সালে মিরপুরে আরেকটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে দিনেশ চান্দিমালের শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো কোনো ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালে দলকে নেতৃত্ব দেন মাশরাফি। দুর্দান্ত বল করে ২২১ রানে অলআউট করে প্রতিপক্ষকে। তবে সহজ জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় মাত্র ১৪২ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। ৭৯ রানের লজ্জাজনক পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে মাশরাফি বাহিনী।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এশিয়া কাপের ফাইনালে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে রোহিত শর্মার ভারতকে চমকে দেয় মাশরাফির দল। ওপেনার লিটন দাসের মারমুখী ব্যাটিংয়ে একপর্যায়ে ২০.৫ ওভারে ১২০ রান করে টাইগাররা। আরেক ওপেনার মিরাজ ৩২ রান করে বিদায় নিলে ব্যাটিং ধসে নামে। নিঃসঙ্গ যোদ্ধার মতো একপ্রান্তে লিটন ১১৭ বলে ১২১ রানের এক ইনিংস খেললেও অন্যদের ব্যর্থতায় ২২২ রানে অলআউট হয় দল। শেষ পর্যন্ত আবারো ইনিংসের শেষ বলে গিয়ে তিন উইকেটের পরাজয় মেনে নেয় টাইগাররা।
চারটি ওয়ানডে টুর্নামেন্ট ছাড়াও দুটি টি-২০ আসরের ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে দেশের মাটিতে এশিয়া কাপের ফাইনালে বৃষ্টিবিঘিœত ম্যাচে ভারতের কাছে আট উইকেটে হারে যায় মাশরাফির দল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে সাব্বির রহমানের ৭৭ রানের ইনিংসের ওপর ভর করে ১৬৬ রান করে বাংলাদেশ। তবে দিনেশ কার্তিকের আট বলে অপরাজিত ২৯ রানের ইনিংস আরেকবার ফাইনাল হারের দুঃখে পোড়ায়। ম্যাচের শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন দিনেশ কার্তিক।
সব অপয়া মনোভাব পেছনে ফেলে এবার ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০.১ ওভারে ১৩১ রান করে তখন অনেকেই ভেবেছিলেন এবারও বুঝি সপ্তম পরাজয়ের মুখ দেখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বৃষ্টি বাগড়ায় ছেদ পড়ে উইন্ডিজ শিবিরে। প্রায় তিন ঘণ্টা বৃষ্টির পর ফের খেলা শুরু হলে ২৪ ওভারে ১ উইকেটে ১৫২ রান করে উইন্ডিজ। বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৪ ওভারে ২১০ রানের। নানা শঙ্কায় থাকলেও অবশেষে সৌম্য ও মোসাদ্দেকের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ২২.৫ ওভারে ৫ উইকেটে ২১৩ রান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে বাংলাদেশ।


আরো সংবাদ



premium cement