২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমরা কি পারি না?

-

ক্রোয়েশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ। আয়তন মাত্র ৫৬ হাজার ৫৯৪ বর্গকিলোমিটার। ুদ্র জনগোষ্ঠীর সেই ক্রোয়েশিয়াই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে দৃষ্টিনন্দন খেলা উপহার দিয়ে হয়েছে রানার্স আপ। ভাগ্য সহায় হয়নি বলে ফ্রান্সের কাছে হেরে মাথায় ওঠেনি মুকুট। তবে তাদের দলনেতা লুকা মডরিচ ঠিকই জিতে নিয়েছেন গোল্ডেন বল, অর্থাৎ ২১তম বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় ক্রোয়েশিয়ারই একজন। এত কম জনসংখ্যার দেশ হয়েও ক্রোয়েশিয়া কিভাবে এমন অবিশ্বাস্য সাফল্য পেল। কিভাবে এত বিশ্বমানের ফুটবলার তৈরি হলো। বিপরীতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। আমাদের এত জনবল থাকতেও আমরা কি পারি না বিশ্বকাপে পৌঁছাতে?
তারা পারার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যা আমরা পারি না। ফুটবলের জন্য তাদের যে হাহাকার রয়েছে, সেটি আমাদের নেই। বিশ্ব ফুটবলে ক্রোয়েশিয়ার অবিশ্বাস্য সাফল্যের মূলে জমজমাট স্কুল ফুটবল। আমাদেরও আছে। তবে কাগজে কলমে। স্কুল ফুটবলের চেয়ে নজর বেশি অর্থকড়ির দিকে, যে কারণে কোনো রকম গা ছাড়াভাবে স্কুল ফুটবল শেষ হলেও বাছাইকৃতদের নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কেউ থাকে না। ফলে ভবিষ্যৎ ফুটবলের মৃত্যু ঘটে ওখানেই।
ফুটবলের উর্বর ভূমি বলা হয় ইউরোপকে। ক্রোয়েটদের রক্তও কিছুটা পক্ষে। জেনেটিকগত কারণেই তারা ফুটবল প্রতিভার অধিকারী। তবে প্রতিভার যথাযথ চর্চা করা, লালন-পালন করে বড় করে তোলাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আর প্রতিভা চর্চার সবচেয়ে আদর্শ মঞ্চ স্কুল ফুটবল। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপর ক্রোয়েটরা ফুটবল উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় স্কুল ফুটবলে। ইউরোপের ফুটবল পরাশক্তি জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেনের মতো উন্নতমানের ফুটবল অ্যাকাডেমি ক্রোয়েশিয়ায় নেই। এ ঘাটতি তারা পুষিয়ে নিয়েছে স্কুল ফুটবলের মাধ্যমে। তারা বুঝতে পারেন ফুটবলারের পাইপলাইন তৈরি করতে হলে স্কুল ফুটবলকে জমজমাট করতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ক্রোয়েশিয়ারও ২০ বছর আগে। সত্তর ও আশির দশকে যে ফুটবল ছিল, যে ফুটবলার ছিল তার চেয়ে বরং বর্তমানে অবনতিই হয়েছে। উন্নতি তো দূরের কথা। এখনো কারো কাছে বর্তমান কয়েকজন ফুটবলারের নাম জানতে চাইলে বলতে পারেন না। অথচ সত্তর ও আশি দশকের ফুটবলারদের নাম ছিল ঠোঁটস্থ।
স্কুল ফুটবলে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে ক্রোয়েশিয়া। দেশের প্রতিটি স্কুলেই রয়েছে ফুটবল মাঠ। পাশাপাশি ভলিবল, বাস্কেটবলের মতো অন্যান্য খেলার কোর্টও; যাতে পড়ালেখার পাশাপাশি প্রতিটি ছাত্রই খেলাধুলা করতে পারে। প্রতিটি স্কুলেই নিয়োগ দেয়া হয় নিজ নিজ খেলাবিষয়ক ক্রীড়া শিক। ফুটবল খেলেছেন, এমন কাউকেই নিয়োগ দেয়া হয় ফুটবল শিক হিসেবে। আর বাংলাদেশের মাঠ দখল হয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় রাজনৈতিক কাব। বসে গরুর হাট, মেলা, হয় কনসার্ট, পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান কিংবা কোনো ঠিকাদারের ইট বালু সিমেন্ট রাখার জায়গা। বাংলাদেশের স্কুলগুলোতেও রয়েছে নামকাওয়াস্তে ক্রীড়া শিক্ষক। হাতেগোনা কয়েকটি স্কুলে পিটি হয়। জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বাধ্যতামূলক করা হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ রেকর্ডে জাতীয় সঙ্গীত বাজায়। তখন মাঠে কেউ সমবেত থাকে না। বারান্দায় বা কাসে বসে শিক্ষার্থীরা দুষ্টুমিতে ব্যস্ত থাকে। বাইরে থেকে কেউ যাতে বুঝতে না পারে সে জন্য জাতীয় সঙ্গীতের সময় মেইন গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্রীড়া শিক্ষককে কাসে কাসে পাঠানো হয় শিক্ষকতা করতে।
ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়, ক’দিন আগেই যিনি বায়ার্ন মিউনিখের কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই নিকো কোভাচ স্পষ্টই বলেছেন, ‘আমাদের দেশের ক্রীড়া অবকাঠামো জার্মানির মতো দেশগুলোর মতো উন্নত নয়। তবে ক্রোয়েশিয়ার স্কুল ফুটবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি স্কুলেই ফুটবল মাঠ, ভলিবল, বাস্কেটবল কোর্ট আছে। স্কুল ফুটবলই আমাদের ফুটবলার তৈরির প্রধান পাইপলাইন। সেখান থেকে প্রতি বছরই উঠে আসছে অসংখ্য ফুটবলার।’
বাংলাদেশের সঙ্গে মেলাতে গেলে হাহাকার ছাড়া কিছুই থাকে না। স্কুল ফুটবলই যে ফুটবল প্রতিভা চর্চার সবচেয়ে আদর্শ মঞ্চÑ এ বিষয়টি বাংলাদেশের ফুটবল কর্তাদের মাথায় ঢুকে না। নেয়া হয় না বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ। স্কুল ফুটবলই যে ফুটবলার তৈরির প্রধান পাইপলাইন, তার বাস্তব প্রমাণ বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। তাদের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই উঠে এসেছেন কয়েকটি স্কুল থেকে।
তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবল উন্নয়নের ল্েয প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেদের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট। পরের বছর থেকে শুরু হয় বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টের। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ফসল এখনো ঘরে তোলা যায়নি। তবে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের সাফল্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেÑ ফুটবলে উন্নতি করতে হলে উদ্যোগ নিতে হবে তৃণমূলে। কার্যকরী পদপে নিতে হবে স্কুল ফুটবলে। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে।
বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায়, যারা তারকা ফুটবলার হয়েছেন তাদের ১০ বছর বয়স থেকেই ফুটবলের হাতেখড়ি। পেশাদার ফুটবলারদের জীবনী বলে ১০-১১ বছর বয়সেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল শিার জন্য ভর্তি হন অ্যাকাডেমি বা ফুটবল স্কুলে। কিন্তু আমাদের দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে ফুটবল চর্চার কোনো উদ্যোগ নেই। দায়সারাভাবে স্কুল টুর্নামেন্ট অবশ্য অনেক আগেই চালু করা হয়। এক বছর হলে পরের দু-তিন বছর খবর থাকে না। ক্রীড়া শিক্ষক হতে হলে যোগ্যতা থাকা দরকার নেইÑ কর্তৃপক্ষের কারো চেনাজানা হলেই হলো।
মাঝে মধ্যে দু-একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনে শুধু টাকাই নষ্ট হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। পাইপলাইন তৈরি করতে হলে অবশ্যই মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে চর্চা শুরু করতে হবে। বিশ্বকাপে আমাদের অনেক শেখার আছে। বিশেষ করে সংগঠক ও ফুটবল ফেডারেশনকে। তৃণমূলে প্লেয়ার তৈরি করে পরবর্তী ধাপ নিশ্চিত না করলে ওখানেই স্বপ্নের মৃত্যু। বাফুফে সভাপতি ২০২২ বিশ্বকাপে খেলার ভিশন তৈরি করেছেন। সেখানে যেতে হলে কী করতে হবে সেটি রোডম্যাপের বাস্তবায়ন নেই। সিলেট অ্যাকাডেমি বন্ধ। বিকেএসপি কোনোমতে চলছে। সেখান থেকে এখনো নামকরা প্লেয়ার বের হয়নি। তার পরও একটা ধারায় রয়েছে। সবার শুধু চেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি। আসনে বসে কী করবেন সে কথা কেউ বলেন না। বিশ্ব ফুটবলে ক্রোয়েশিয়া থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি না?

 


আরো সংবাদ



premium cement