২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বায়োস্কোপে জীবিকা

শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে বায়োস্কোপ উপভোগ করার স্মৃতি আজো অনেকের কাছে অমলিন -

এই বারেতে দ্যাখেন ভালো ‘দার্জিলিংয়ের পাহাড় আছে,
পাহাড়ে ঝরনা আছে
কলকাতা টাউন আছে
বড় লাটের বাড়ি আছে
মুর্শীদাবাদ আইসা গেছে
দেখতে কত বাহার আছে
বনের রাজা সিংহ আছে
বাঘ-ভাল্লুক সবই আছে’Ñ
এমন সুর ও ছন্দের তালে তালে বায়োস্কোপ দেখিয়ে এখনো মানুষকে আনন্দ দিয়ে মন ভরানোর চেষ্টা করেন রাজশাহীর আবদুল জলিল। দুই যুগ আগে এই পেশায় জীবন-জীবিকা নির্বাহ শুরু করলেও প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটায় আগের মতো আগ্রহ নিয়ে বায়োস্কোপ দেখেন না। তারপরও বায়োস্কোপকে টিকিয়ে রাখতে একাই সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এই ঐতিহ্যে রক্ষার সৈনিক।
এক সময়ে আমাদের গ্রামীণ মেলাগুলোতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বায়োস্কোপ দেখতে হয়েছে। এখনকার মতো এত চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না বলেই বায়োস্কোপ দেখে মনের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন অনেকেই। আজ আর গ্রামীণ মেলাগুলোতে সচরাচর বায়োস্কোপের দেখা মেলে না। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধরে রেখে আজো বায়োস্কোপ নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাজশাহীর আবদুল জলিল। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প আয়োজিত গ্রামীণমেলাগুলোকে এখনো আগের মতো বায়োস্কোপ দেখানোর মাধ্যমে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বায়োস্কোপ আমাদের দেশের অতিপরিচিত একটি বিনোদন যন্ত্রের নাম। কাঠ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি যা মানুষের বিনোদনের জন্য ব্যবহার্য। একসময়ে গ্রামগঞ্জে মানুষের বিনোদনে খোরাক জোগানোর অন্যতম এই মাধ্যমটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাত্র দুই যুগ আগেও আমাদের দেশের গ্রামীণ মেলাগুলোতে ছোট-বড় সবার নজর কাড়ত এই বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপে দেখা যেত ঐতিহাসিক স্থানসহ আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোনো ঘটনার ছবি। এ ছবিগুলো বড় পর্দার মতো করে দেখানো হতো। অনেকে বায়োস্কোপ দেখার জন্য বায়না ধরে মেলায় যেত বড়দের সাথে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে বায়োস্কোপ উপভোগ করার স্মৃতি আজো অনেকের কাছে অমলিন। আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ। তবে কারো না কারো কল্যাণে একেবারে হারিয়ে যায়নি বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বায়োস্কোপ। এমনই একজন ব্যক্তি যিনি বংশ পরম্পরায় এখনো এ পেশা ধরে রেখে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছেন। কেবল বায়োস্কোপ দেখানোর জন্য জলিল মণ্ডলের পরিচিতি দেশজুড়ে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) আয়োজিত মেলাগুলোতে দর্শনার্থীদের আনন্দ দেয়ার জন্য বায়োস্কোপ দেখিয়ে থাকেন আবদুল জলিল। বিসিক আয়োজিত গ্রামীণমেলায় দেখা মিলবে এই রশিক মানুষটির। নিজের আনন্দকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যের আনন্দের খোরাক জুগিয়ে বেড়ানো মানুষটির বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘমারা উপজেলার চায়ের শারা গ্রামে। বাবা বকশি মণ্ডল ৪০ বছর এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বাবার উত্তরসূরি হিসেবে মাত্র ১২ বছর বয়সে জলিল মণ্ডল বায়োক্সোপ দেখানোর কাজের সাথে নিজেকে নিয়োজিত করেন।। এরই মধ্যে এ পেশায় কেটে গেছে তার জীবনের দীর্ঘ ৩৫টি বছর। এ পেশার আয় দিয়ে দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে সংসার।
আবদুল জলিলের সাথে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার জয়নুল মেলায়। তিনি জানান, মানুষ আগের মতো নেই, সবাই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুতেই স্বার্থ খোঁজে। স্বার্থ না খুঁজে দেশকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে। দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা হলে আমাকে ডাকলে কেবল সেখানে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখাই। বছরের সব মিলিয়ে দুই-তিন মাস মেলাগুলোতে সময় কাটাই। অন্য সময় বাড়িতে বসে থাকা লাগে। সে সময় নিরুপায় হয়ে অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতে হয়। তখন নিজেকে অপরাধী মনে করেন তিনি। চার পাশে অনেকে ভালো আছেন অথচ দেশীয় একটি শিল্পকে বাঁচাতে গিয়ে অভাব আর নানা দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। আমি আমার মনের টানে এ পেশা ছাড়তে পারছি না। যতদিন বেঁচে থাকব আগামী দিনগুলো আমি মানুষজনকে বায়োস্কোপ দেখিয়ে যেতে চাই। আমার সন্তান আর এ পেশায় আসবে না। তবে পেশার মানুষকে টিকিয়ে রাখতে সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিতে হবে, তা না হলে জাদুঘরে ঠাঁই হবে বায়োস্কোপের।
বায়োস্কোপ দেখানোর বিষয়বস্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বিভিন্ন প্রেমকাহিনী, বিশ^যুদ্ধ, বিশ্বের দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় বিষয়সহ সমসাময়িক বিষয়গুলো স্থান পেত। এজন্য যারা বায়োস্কোপ দেখাতেন তাদের অনেক বিষয়ে জ্ঞান থাকা লাগত। বিষয়গুলোর ওপরই ছবি তৈরি করে তা দেখানোর ব্যবস্থা করা হতো। মেলায় জলিল মণ্ডলের বায়োস্কোপ দেখে অনেকে বলাবলি করেছিলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে সব কিছুই যখন হাতের মুঠোয় তখন দেশীয় সংস্কৃতির বায়োস্কোপের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজো জলিল মণ্ডল সব বয়সের মানুষকে সমানতালে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছেন। যত দিন বেঁচে থাকবেন, বায়োস্কোপ দেখানোর মাধ্যমে মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ঘটাবেন।
আবদুল জলিলের কণ্ঠে সুরের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে এখনো মানুষ বায়োস্কোপ দেখে থাকেন। তিনি যখন বায়োস্কোপ দেখান তখন ছন্দ আর সুরের তালে তালে নিজের শরীরটাকে দুলাতে থাকেন। হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে অনবদ্যভাবে বলতে থাকেন চিরচেনা বাক্যগুলো তার অঙ্গভঙ্গির কারণেই বায়োস্কোপ দেখতে আকৃষ্ট হয়ে থাকেন মেলার দর্শনার্থীরা। তাপরও যে এখনো মানুষ আবদুল জলিলের কল্যাণে বায়োস্কোপ দেখতে পায়Ñ এটা পরম সৌভাগ্য।


আরো সংবাদ



premium cement