২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোধূলীর আলো

-

এই শেষবার নীলা সময় দেখল। ডাক্তার হোসনে আরা যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবেন। তিনি না আসা পর্যন্ত জুনায়েদ এর সাথে কথা বলা যেতে পারে।
কী করছো?
ওপাশে জুনায়েদ এর ব্যথিত গলা। সে বলল, মনটা ভালো নেই। কাল তোমার সাথে ঠিকমতো কথা হয়নি। আজো কথা বলা যাচ্ছে না।
নীলা বলল, মন খারাপ করো না। আমার ছোট্র একটা অপারেশন হবে। অপারেশন হওয়ার পর তোমার সঙ্গে কথা শুরু করব। তুমি ভালো থেকো।
ঠিক আছে। আমি অজু করে আসি। নফল নামাজ পড়ব দুই রাকাত তোমার জন্য। আমার জানটা সারাজীবন সুস্থ থাকবে এই প্রার্থনা আল্লাহর কাছে।
আমি ভয় পাই না। আমার সাথে আল্লাহ আছেন। যার কেউ নেই তার সাথে আল্লাহ থাকেন। অপারেশন হয়ে গেলেই তোমাকে কল দেবো। মোবাইল বন্ধ করব এখন।
দুই ঘণ্টা পর।
নার্স একজন চিন্তিত মুখে বললেন, ম্যাডাম, অনেক ব্লিডিং হচ্ছে। মনে হয় রোগী বাঁচবে না। ইয়াছমিন ম্যাডাম দেখছেন।
ডাক্তার হোসনে আরা বললেন, রোগীর আত্মীয়স্বজনকে খবর দাও তাড়াতাড়ি।
বলেই নিজের কেবিন থেকে ব্যথিত মন নিয়ে ধীর গতিতে তিনি বেরিয়ে এলেন। ঢুকলেন ৫১৩ নম্বর কেবিনে। নীলা শুয়ে আছে। তিনি আস্তে করে ডাকলেন।
নীলা চোখ মেলে তাকাল। হোসনে আরা শুকনো মুখে বললেন, বাসায় যেতে পারবে একা? কাউকে একজন সাথে দেবো?
নীলা ম্লান মুখে বলল, কাউকে লাগবে না। আমি একা যেতে পারব।
হোসনে আরা বললেন, তোমার মানসিক অবস্থা আমি বুঝি। তখন যদি অপারেশন করে টিউমার ফেলে দিতে পারতে আজকের এত বড় সমস্যা হতো না। শুরুতেই অপারেশন করাটা তোমার উচিত ছিল।
নীলা কিছু বলতে পারল না। উদাস মুখ নিয়ে জানালার বাইরে চেয়ে থাকল। উত্তেজিত অবস্থায় সেই নার্স এসে ঢুকল। উত্তেজনায় তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। সে বলল, ম্যাডাম তাড়াতাড়ি ৬২৭ নম্বর কেবিনে আসেন। রোগীর অবস্থা একটুও ভালো নেই।
নার্সের পেছনে ডাক্তার হোসনে আরা দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলেন। নীলা বেড ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে হেঁটে চলে এলো হাসপাতালের বাইরে। তার খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। হাসপাতালের পানি খেতে গিয়ে মুখ থেকে ফেলে দিয়েছিল। পানিতে গন্ধ। একটা গাছের ছায়ায় বসল সে। পৃথিবীটা খুব ভারী মনে হতে লাগল আজ। ধূসর মনে হচ্ছে। পৃথিবী থেকে সব সুখ মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেছে। এমন লাগছে কেন তার?
পার্স থেকে মোবাইল ফোন বের করে নিল। খবরটা প্রথমেই কাকে বলা যায়? মাকে বাসায় গিয়েও বলা যাবে। শোনামাত্রই মেয়ের জন্য শোক ছাড়া আর কিছুই করার নেই! জুনায়েদ? সে যখন জানবে তখন কী হবে পরিস্থিতি? সে কি মেনে নিতে পারবে? অসম্ভব, কোনো পুরুষই জেনেশুনে এটাকে মানতে পারবে না। সে স্বামী হলেও মেনে নেয়া তার জন্য কঠিন। নীলা জুনায়েদের নম্বর চাপল। খবরটা এখনি তাকে বলা দরকার। তার ভালোবাসার মানুষকে কখনোই সে ঠেকাতে পারবে না।
কেমন আছো?
ওপাশে জুনায়েদ এর অস্থির গলা। সে বলল, আমি তোমাকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি। একা একাই ডাক্তারের কাছে গেছো। কেউ একজন নেই তোমার পাশে। আজ যদি আমি তোমার পাশে থাকতে পারতাম হাতে হাত রেখে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। আমি তোমার পাশেই থাকতাম সর্বক্ষণ।
নীলা বলল, আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি ভালো আছি। তোমাকে একটা কথা বলব জুনায়েদ।
জুনায়েদ বলল, তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
আমি ঠিক আছি। বাসায় যাব এখনি। জুনায়েদ শোনো, তোমাকে একটা জরুরি কথা বলা দরকার।
হ্যাঁ বলো।
জরুরি কথা বলতে গিয়ে নীলার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সে অনেক কষ্টে কান্না আটকাল। শক্ত করল নিজেকে। স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল।
ওপাশে জুনায়েদ এর অস্থির গলা। সে বলল, কী হলো নীলা? কোনো সমস্যা হয়েছে তোমার?
নীলা বলল, আমাকে তুমি ভুলে যাও জুনায়েদ। আমি কখনোই তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।
পাগলের মতো এসব কী বলছ? কী হয়েছে তোমার নীলা? তুমি কি অসুস্থ?
না, আমি পুরোপুরিই সুস্থ আছি। আর স্বাভাবিকভাবেই তোমার সাথে কথা বলছি।
জুনায়েদ উত্তেজিত গলায় বলল, না, তুমি একটুও স্বাভাবিক নেই। তুমি কী বলছ তুমি নিজেও জানো না।
আমি যা বলছি ঠিকই বলছি জুনায়েদ। আমাকে তুমি ভুলে যাও। কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হও। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই।
জুনায়েদ রেগে গিয়ে বলল, আমার সুখ কিসে যদি সত্যিই তুমি জানতে তাহলে এমন কথা আজ তুমি বলতে পারতে না। তুমি যে আমার মায়া, তুমি আমার জান। আমার আত্মায় মিশে গেছো তুমি। তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর কোনো সুখই আমাকে সুখী করতে পারবে না।
নীলা কান্না জড়ানো গলায় বলল, সব সুখ ভেঙে গেছে জুনায়েদ। আর কোনোদিন তোমাকে আমি সুখী করতে পারব না।
এমন কেন বলছো নীলা? কী হয়েছে তোমার?
আমি কোনোদিন মা হতে পারব না জুনায়েদ। কোনোদিনই তোমাকে আমি সন্তান দিতে পারব না। আমার সেই ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি বিয়ে করো। ভালো থাকো। আজীবন আমি তোমার ভালো থাকা দেখতে চাই।
জুনায়েদ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আল্লাহর কসম এই কথা দ্বিতীয়বার বলছো তো আমার মরা মুখ দেখবে। তোমাকে ছাড়া আমি কখনোই কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমি কোনো সন্তান চাই না, আমি শুধু আমার নীলাকে চাই।
লাইন কেটে দিয়েছে জুনায়েদ। নীলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল তার পানি পিপাসা এখন আর নেই। চোখের সামনে বেদনার রঙ মুছে গেছে মুহূর্তেই। পৃথিবীকে খুব আপন আর খুব কাছের মনে হতে লাগল। পৃথিবীতে এত সুখ কেন !
নবাবগঞ্জ, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement