২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

খুকুমণির ছবি আঁকা

-

খুকুমণি সূর্য আঁকে, আঁকে ফুল, ঘাস, লতাপাতা আরো কত কী। কিন্তু সে মানুষ আঁকতে পারে না। খুকুমণির মানুষ আঁকার খুব ইচ্ছে। তাই মাকে বলল, মা তুমি আমার সামনে বসে থাকবে, আমি তোমার ছবি আঁকব। মা বললেন, সময় নেই। খুকুমণি মন খারাপ করল, সে গেল বাবার কাছে। বাবা, তুমি আমার সামনে বসে থাকবে; আমি তোমার ছবি আঁকব। বাবা বললেন, আমাকে অফিসে যেতে হবে, মামনি। খুকুমণি এবারো মন খারাপ করল।
অবশেষে খুকুমণি বাসার কাজের মেয়েটিকে বলল, বাবলি তুমি আমার সামনে বসে থাকবে; আমি তোমার ছবি আঁকব। বাবলি অবাক হয়ে বলল, কী কন আপা! আপনে আমারে আঁকতে পারবেন? দেখি না চেষ্টা করে। আইচ্ছা তয় চলেন, আমি আপনার সামনে বয়া থাকুম। খুকুমণি রঙ-তুলি নিয়ে বসে পড়ল, সে একমনে বাবলিকে দেখছে আর আঁকছে। বাবলিকে আঁকতে গিয়ে, হয়ে গেল কার্টুনের মতো কী যেন একটা। সে ছবি দেখে বাবলি হি হি করে হেসে উঠল, তার হাসি যেন থামতে চায় না। হাসতে হাসতে বলল, আপা, আমার মেলা কাজ আছে, আমি এখন যাই। খুকুমণি বলল, আরো একটু বসো আর একবার চেষ্টা করে দেখি। গুরুজনেরা বলে, একবার না পারিলে দেখো বহুবার।
আইচ্ছা আর একটু বইলাম, তয় মনে রাইখেন এইবার না পারলে আমি কিন্তু সত্য সত্যই চইলা যামু।
খুকুমণি দ্বিতীয়বার ছবি আঁকার আগে খুব ভালো করে দেখে নিলো বাবলিকে। তারপর আঁকতে শুরু করল, প্রথমে বাবলির গোলাকার একটি চেহারা আঁকল, সেখানে দুটো চোখ আঁকল, নাক আঁকল, ঠোঁট আঁকল। এখন একটু একটু বাবলির মতো দেখাচ্ছে। তারপর কালো রঙ দিয়ে চুল আঁকল। বাবলির পরনে ময়লা জামা, তার হাড্ডিসার শরীর, সে দেখতে খুব রোগা। খুকুমণি আরো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল বাবলিকে। বাবলির হাতে কিসের যেন একটা কালো দাগ! খুকুমণি মনে মনে ভাবল, আমি ছবির মধ্যে এই দাগটাও আঁকব। আচ্ছা তোমার হাতে ওটা কিসের দাগ? বাবলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপা এইটা আমারে জিগায়েন না, আমি কইতে পারুম না। খুকুমণি মুখ ভার করে আবারো ছবি আঁকাতে মন দিলো এবং একে চলল এক মনে এক ধ্যানে। ঘণ্টাখানেক পর ছবি আঁকা শেষ। খুকুমণি বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগল ছবিটি। তারপর বাবলির হাতে দিয়ে বলল, দেখোতো কেমন হয়েছে? বাবলি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ছবিটা হাতে নিয়ে বলতে লাগল, আপা আপনে দেখি সত্য সত্যই এইটা আমারে আঁকছেন! কেমনে আঁকলেন? তাই? তোমার মতো হয়েছে? হ, আপনে মিলাইয়া দেখেন। খুকুমণি বাবলিকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে তার পাশে টাঙ্গিয়ে দিলো ছবিটি। অবাক হয়ে দেখতে লাগল আরে সত্যিই তো! ছবিটা একদম বাবলির মতোই হয়েছে। খুকুমণি ভীষণ জোরে একটা লাফ দিলো। বাবলি ভয় পেয়ে বলল, আপা এত জোরে লাফায়েন না, পইড়া যাইবেন তো। খুকুমণি হো হো করে হেসে উঠে বলল, না না পড়ব না, আমার তো নাচতে ইচ্ছে করছে। আমি এতদিন যা আঁকার চেষ্টা করেছি, আজ সেটাই এঁকে ফেলেছি, কী মজা হৈ হৈ, আব্বু-আম্মু আসলে দেখাব। না, না, দেখাইয়েন না। খুকুমণি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল কেন? সেইটা বলা যাইব না, আপা আমার মেলা কাজ আছে, এখন যাই। বাবলি এইটুকু বলেই চলে গেল। খুকুমণি ছবিটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল, তার মনে ঘুরতে লাগল নানান রকম প্রশ্ন, যে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
কয়েক দিন পরের কথা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে শুরু হয়েছে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা। খুকুমণি লেখা পড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে নাচ, গান, আবৃত্তি ও ছবি আঁকা শিখত। একদিন সময় করে খুকুমণি তার আঁকা বাবলির ছবিটি প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যে জমা দিয়ে এলো। তার কয়েক দিন পর ফলাফল ঘোষণা করা হলো এবং খুকুমণির আঁকা ছবিটি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করল। বাবলির ছবিটা কি এতই সুন্দর ছিল? খুকুমণি বিশ্বাস করতে পারছে না তার এই প্রথম হওয়া। আনন্দে চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে খুকুমণির।
বাড়ি ফিরে কোনো দিকে না তাকিয়েই খুকুমণি জড়িয়ে ধরল বাবলিকে, সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল, আমি ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছি। বাবলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ফাসটো কী আপা? খুকুমণি বলল, আমি প্রথম হয়েছি তোমার ছবি এঁকে। হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে ফেললেন খুকুমণির মা, তিনি খুকুমণির দিকে রাগি চোখে তাকালেন। খুকুমণি ছুটে এসে তার মাকেও জড়িয়ে ধরল। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, মামনি আমি বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছি। মা এটা শুনে পারেন তো সেখানেই নাচানাচি শুরু করেন। খুকুমণির বাবা যখন এই খবরটি শুনলেন তখন তারও একই অবস্থা। বাবা-মা সব আত্মীয়স্বজনকে ফোন দিয়ে গর্ব করে বলতে লাগলেন আমাদের খুকুমণি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছে।
বাবা-মা এই উদ্দেশ্যে বাসায় খুব সুন্দর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন, সবাই খুকুমণিকে ফুল, চকলেট ও নানা রকমের উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল। এতকিছুর পরেও খুকুমণির মন খারাপ। কারণ যার জন্য তার এই পুরস্কার পাওয়া সেই বাবলিকেই পাশে রাখতে পারেনি, মা নিষেধ করেছেন। কেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পায়নি খুকুমণি।
প্রতিযোগিতায় যারা বিজয়ী হয়েছে তাদের সবাইকে পুরস্কৃত করা হবে, নিয়ে যেতে হবে অভিভাবককে সাথে করে। খুকুমণি রাতে খাবার টেবিলে বাবা-মাকে বলল, টিচার তোমাদের নিয়ে যেতে বলেছেন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য। বাবা-মা দু’জনই সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললেন, আমরা অবশ্যই যাবো। কী ছবি এঁকেছে খুকুমণি সেটা দেখার জন্য উদগ্রীব বাবা-মা। অবশেষে তাদের উৎকণ্ঠার অবসান হলো। বিজয়ীদের আঁকা ছবি প্রদর্শিত করা হলো। ছবিটির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন বাবা-মা, আরে এটাতো বাবলির ছবি! কেমন করে আঁকল খুকুমণি? হাতের সেই কালো দাগটাও আছে, কিভাবে সম্ভব? খুকুমণিকে এ ব্যাপারে তারা কিছুই বললেন না, দু’জনই চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন। শুরু হলো অনুষ্ঠান, বিশেষ অতিথিসহ সম্মানিত ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখলেন। তারপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক পর্ব। সবশেষে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেয়া হলো পুরস্কার। খুকুমণি আনন্দে কেঁদে ফেলল, তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল বাবলির মায়াবী মুখ।

 


আরো সংবাদ



premium cement