২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাসুর বিজয় দেখা

-

ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। আবছা আলো ছায়ায় রাস্তায় জনমানুষের দ্রুত চলাচলের শব্দ শোনে হাসু। তাতেই তার ভোররাতের স্বপ্নমায়া ঘুমটা ভেঙে যায়। এ রাস্তায় এ সময়ে সাধারণের চলাচল একেবারে অস্বাভাবিক। অদুরেই চাঁদপুর রিভারডিউ ক্লাবে আর্মি ক্যাম্প। প্রায় চৌদ্দ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা পূর্বপ্রান্ত রিভারভিউ ক্লাব ছুঁয়ে চলে গেছে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে। অন্য মাথা বাঁক নিয়ে চাঁদপুর রেলস্টেশন ঘুরে স্টিমার ঘাটে।
আর্মি ক্যাম্পকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী। বিশেষ পাস ছাড়া ওপথে সাধারণের চলাচলে নো এন্ট্রি। রাস্তার দক্ষিণ পাশ ঘিরে সারি সারি দেবদারু গাছ পাক সেনাদের মতোই অনড় দাঁড়িয়ে। এক সময়ে হাসুর বন্ধু ছিল এগাছগুলো। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাব কোর্টে টেনিস খেলা দেখত। মাঝের একটা গাছের নিচু ডালে ঝুলে দোল খেত সকাল-বিকেল। তার মনে হতো পোলিও আক্রান্ত চিকন পা-টা বুঝি একদিন ঝুলতে ঝুলতে ঠিকাই মেরামত হয়ে যাবে। সে পথ আজ পাক সেনাদের ঘেরে বন্দী। দেবদারু গাছগুলোও যেন ওদের পক্ষ হয়ে গেছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাইনিজ রাইফেল হাতে দাঁড়ানো সেনাগুলোর চোখের দিকে তাকাতে পারে না হাসু। গা হিম করা কেমন ওদের শিকারি চাহনি। তিন-চার বছর ধরে আমজাদ আলীর বস্তিতে তাদের বসবাস। এক চালার নিচে পূর্ব-পশ্চিমে ১০টি কামরায় ১০টি গরিব পরিবার কোনোভাবে দিন কাটায়। তাদের বস্তিটা ক্লাবের দিকে চলার রাস্তা ঘেঁষা। রাস্তার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে আছে বাঁশের বেড়া। সামনে এক চিলতে উঠোন। তারপর কলতলা, রান্নাঘর, পায়খানা এসব।
পূর্ব পাশে চাঁদপুর সাবজেলের চৌদ্দ ফুট কালো দেয়াল। দেয়াল ঘেঁষে এক ফালি রাস্তা ঢুপ করে ঢুকে গেছে বস্তিতে। আর্মিদের নিষিদ্ধ রাস্তায় ওদের পা ফেলতে মানা। সব সময়ই তটস্থ থাকতে হয় বস্তির মানুষগুলোকে। একাত্তরের এপ্রিলের প্রথমেই এখানে ক্যাম্প পাতে পাক আর্মি। চাঁদপুরে নেমে প্রথমই রাতেই ওরা বস্তি ঘিরে ফেলেছিল যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে। গরিব হাড্ডিসার মানুষগুলোকে ঘর থেকে বের করে বেধড়ক পিটুনি দিয়েছে। দুটো বেতের বাড়ি হাসুর পিঠেও পড়েছে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বলে। মা কাজ থেকে তখনই ফিরে এসে ছেলেকে আড়াল করে দেয়। দুটো বেতের বাড়ি হজম করে মা ওদের জানায়, ‘লেংড়া পোলা আমার, মাইরেন না স্যার।’
একজন আর্মি হাসুর চিকন বাম পা-টা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় খানিক দূর। আরেকজন হাসতে হাসতে বলে, আরে ইয়ার ছোড় দো লেড়কাকো। হামকো সাথ লড়েগা! লেংড়া বাঙালি! শালে! দিন রাতে ডিউটিরত আর্মিদের ‘হল্ট’ শব্দটি শুনলে হাসুর বুকের ধড়পড়ানি বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে ‘হল্ট’ শব্দটির সাথে সাথে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, এই বুঝি গুলির শব্দ শোনা গেল! হাসুদের যাওয়ার জায়গা কোথাও নেই। জীবন-মরণ ঘেরের মধ্যে তাদের বসবাস। বড় ভাই আদম আলী চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে ভাত বিক্রি করে। দিনরাত কাজ আর কাজ। সুযোগ পেলে সপ্তাহে একবার এসে কিছু সদাইপাতি কিনে দিয়ে যায়। মা রেলস্টেশনের ‘ওয়ানটাইম’ রেস্টুরেন্টে কাজ করে। সন্ধ্যা বেলায় আঁচল ঢেকে ভাত-ডাল কিছু একটা নিয়ে আসে। মা ছেলের দিন এমনি চলে যায়।
হাসুর বয়স চৌদ্দ-পনেরো হলেও দেখতে দশ-বারো বছর বয়সী ছেলেদের মতোই। পুষ্টিহীনতার কারণে তার শরীর বেড়ে ওঠেনি বয়সের তুলনায়। অসময়ে বাপটা মরেই সংসার এলামেলো করে দিলো। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকায় স্কুলে যাওয়া হয়নি হাসুর। বাবা মরলে মা ভিটেছাড়া। স্থান হলো এ বস্তিতে।
‘আইয়ুবশাহী নিপাত যাক, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’Ñ এসব স্লোগানের চেতনায় সেও চমকায়। স্লোগানের তেজোদীপ্ত ভাষায় যেন শুনতে পায় আত্মার আহ্বান। ছুটে বেরিয়ে পড়ে মিছিলের উদ্দেশে। লেংড়া পা-টা কোনো বাধা হয় না। মার সাথে এ শর্তে কোনো সমঝোতা নেই।
হাসু বুঝতে পারে না এ মিছিল, আন্দোলনের মাঝে কী আছে? কেন আছে? কিসের অধিকার? কেন অধিকার? এর মধ্যে হঠাৎ যুদ্ধ, হঠাৎ আক্রমণ, ধেয়ে এলো দেশের মাটিতে। ইয়া লম্বা লম্বা মছুয়া পশ্চিমা সেনারা যেন গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো ইয়াজুজ মাজুজের রূপ ধরে। নির্বিচারে গুলি করে মারল চেতনায় উদ্ভাসিত কতগুলো নিরস্ত্র মানুষ। তার পর কয়েকটা দিন চুপচাপ। হানাদারদের অট্টহাসি। এরই মধ্যে চলল বাঙালির প্রস্তুতি, প্রতিরোধের আন্দোলন। চরমপত্রের আক্রমণ। হাসুর বুকেও সে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। নিজের অক্ষমতাকে অতিক্রম করে অস্ত্র ধরতে চায় সে। কিন্তু পারে না। বুকের মধ্যে আক্রোশের ফণা জেগে ওঠে। নির্বাসিত শব্দাবলি বুকের ভেতরে জিগির তোলে : নিপাত যাক, নিপাত যাক। হাসু জানে সারা দেশটা হানাদারদের বন্দুকের নিশানায়। কার দেশ, কার মাটি, কারা হুকুম জারি করছে। উল্টো পিঠের খবরও তাকে উদ্দীপ্ত করে। ‘মছুয়াগো চুবানি দিতাছে বাংলার ছেরা-বেরা পোলাপনে’। দেশের জন্য যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ, বাংলার মাটি থেকে হানাদারদের উৎখাতের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ নিজেদের অস্তিত্বের যুদ্ধ, বাঙালির মুখের ভাষার জন্য যুদ্ধ।
হাসুর মন ফিরে যায় অতীতে। চিতলমারী গ্রামের সোনালি সবুজ ঘ্রাণের অতীত। কলাপাতার দোল খাওয়া তাদের বসতভিটা। আজ আজমত বেপারির পেটে। ভিটে ছাড়া, মাটি ছাড়া, শিকড়হীন হাসু। তাদের হিসাব নিকাশে কী! যুদ্ধ বাংলার মাটি রক্ষার যুদ্ধ, তাদের তো মাটি নেই, শেকড় নেই।
ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন ভেঙে যায়। কারা যেন বলে, জমি, মাটি, ভিটে তোর নেই; কিন্তু তোর রয়েছে জন্মভূমি। এ দেশের চন্দ্র, সূর্য-আলো-বাতাস, এ সবে রয়েছে তোর অধিকার। কেউ কোনো দিন বলতে পারবে নাÑ তোর তো শেকড় নেই, বেরিয়ে যা এ দেশ থেকে!
হাসুর হৃৎপিণ্ডের পরিধি বেড়ে যায়। নাক টেনে ফুসফুসটাকে ভরিয়ে তোলে, আবার ছেড়ে দেয়। জন্মের দাবি-বড় দাবি। স্বাধীনতা, জন্মভূমি। এ দেশ তোমার-আমার। লেংড়া পায়ে লাফিয়ে উঠে বাতাসে। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’। নদীর প্রবল স্রোতের উচ্ছ্বাসে শেকড়হীন মানুষের জয়যাত্রায় শামিল হয় হাসু। মা কাজ ফেলে খুঁজে বেড়ায় ভূখা-নাঙ্গা হাসুকে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসে। হাসুও ফিরে আসে বেলা শেষে এক রাশ ভূখণ্ড নিয়ে।
মাকে বোঝায়, ‘দেশ স্বাধীন অইব। আমরাই থাকুম, নিজেরা নিজেরা। কেউ কাউরে মাইরধর করব না। নিজের কথা নিজের মতোন কইতে পারুম। ডাক্তাররে বুঝাইতে পারুম আমার ঠ্যাংটা জন্মের মতোন লেংড়া না। স্বাধীন দেশের ডাক্তার আমার ঠ্যাং মেরামত কইরা দিব। খিদা লাগলে কমু চাইল দেন, ডাইল দেন, দিব না মা? দুইবেলা ভাত খামু, একবেলা লুডির লগে ঘন কইরা ডাইল রানবা।’ বড় বড় ভাতের নলাগুলো না চিবিয়ে গিলতে থাকে হাসু।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থালাবাটি নিয়ে যায় কলকাতায়। যুদ্ধের মাঝামাঝি আদম আলী একটা রিকশা নিয়ে ঢোকে বস্তিতে। রিকশায় এক বস্তা চাল, আলু, ডাল, গুড়-মুড়ি কত কী! পরিমাণ আন্দাজ করে মার তো চোখ কপালে। হাসু ভাবছে, একখান আস্ত রিকশা ভাইজানে দুই ফুইট্যা চিপা রাস্তা দিয়া হান্দাইলো কেমতে! এইডাতো পাক আর্মিগো আলকাতরা মারা রাস্তা না ছুঁইয়া আহনের কথা না। ‘হল্ট’ ধমকাটাতো শুনে নাই। বেলা দুপুরে সাত আট জুড়া সাত ফুইট্যা সেয়ানা মানুষের চোখে ফাঁকি মারব। বিশ্বাস অয়না !
হাসু লক্ষ করে মার আঁচলে কড়কইরা কয়খান পঞ্চাশ টেকার নোট গিট্যু মাইরা দেয় ভাইজান। হেরপরে নিমেষেই রিকশা লইয়া পার। মায়ে কিছু জিগানের সময় পায় না। বস্তির আর মাইনষেও হা কইরা চাইয়া থাহে।
এ ঘটনার পর থেকেই হাসুর তেজোদীপ্ত মনের বিকাশ যেন স্থবির হয়ে যায়। কী করে ভাইজান! এক টেকা প্লেট বেচইন্যা ভাইজান এত টেহা কই পাইল! চাঁদপুর রেলস্টেশনের ভেতরে ঢুকে প্যাসেঞ্জার বেঞ্চে বসে থাকে সারাদিন। মনে হয় ভাইজান যেন তাদের ফাঁকি দিতাছে! দেশের মাটি লগে বেইমানি... না না ভাবতে চায় না হাসু।
ঝক্ ঝক্ করে কুমিল্লা ফেরত রেল ইঞ্জিন অনেক বগি নিয়ে ঢুকে পড়ে স্টেশনে। তারপর বগি ছাড় নিয়ে ইঞ্জিন চলে যায় এক মাইল দূরে স্টিমার ঘাটে। হিস্-হিস্-হিস্-হিস্ সান্টিং মেরে ইঞ্জিন আবার ঘুরে এসে জোড়া লাগে উল্টো দিকে। তার পর ফের গন্তব্যে। হঠাৎ একদিন লক্ষ করে পুরো রেলগাড়িতে পাকসেনা। ভয় পেয়ে ওদের নেমে যাবার আগেই স্টেশন ছাড়ে হাসু। দূরে দাঁড়িয়ে দেখে পাক সেনারা মার্চ করে এগিয়ে যায় স্টিমার ঘাটে। হাসুর ইচ্ছে হয়, হাতে একটা গ্রেনেড থাকলে ফাটিয়ে দিতো ওদের ওপর। বাঁ পায়ের অক্ষমতা তার চেতনা স্তিমিত করে দেয়। কিন্তু তার তো রয়েছে দু’খান শক্ত মাসলের হাত। কেউ তাকে কোনো দায়িত্ব দিতে চায় না। মুক্তিযোদ্ধা তার বন্ধু কালুকে বলেছিল দেনা রাইফেলটা একটা ফুটাই! একটা দাঁত খিঁচুনি মেরে সে রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে যা।
রাতে ভাইজান আসে, তখনো ঘুমায়নি হাসু। মার এটা ওটা রান্না-বান্নার আয়োজন দেখে হাসু ঠিকই বুঝতে পারে। কুপির আলো জ্বালিয়ে বসে থাকে মা। হাসুকেও খেতে দেয় না। বলে, তোরা দু’জন এক লগে খাবি। অনেক রাতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে মা কুপির আলো নিয়ে বেরিয়ে যায়। একটা কালো চাদর মুড়ি দিয়ে ভাইজান ঘরে ঢোকে।
দু’ভাই একসাথে খেতে বসে। মাছের মুড়োটা মা তুলে দেয় আদম আলীর পাতে। বলে দু’জন ভাগ কইরা খা। মুড়োর নরম হাড় কড়মড়ে দাঁতে পিষে হাসু জিজ্ঞেস করে ভাইজান তুমি তো মাশাআল্লাহ্ অহন পুরা বেডা অইছো, তুমি তো মুক্তিযুদ্ধে যাইতে পারো। আমি লেংড়া-লুলা কেমতে যে কী করি! জানো, আমার বন্ধু কালু মুক্তিতে গেছে। ট্রেনিং দিয়া অহন পুরা ফাইটার। ট্রেনিং দেওনের পর থেইক্যা হের সাহস বাইড়া ১০ গুণ অইয়া গেছে। ইস্ আমি যদি পারতাম... মুহূর্তে কদম আলীর চোখের রং বদলে যায়। কুপির লাল আলোয় হাসু দেখে তার ভাইজানের চোখের রং আরো লাল হয়ে আছে। যেন পাঞ্জাবি সেনাদের চোখের ছায়া। ভয় পেয়ে যায় হাসু। তার হাতে ধরা নলাটা মুখে না উঠে পাতে পড়ে যায়।
কদম আলী নিজকে সামলে নেয়। মুড়োর নরম হাড় সেও মুখে নিয়ে পিষতে পিষতে খুব আস্তে বলে, শোন হাসু, ভাই আমার, ওই সব মুক্তিটুক্তি করিস না। জবান বন্ধ। জান বাঁচান ফরজ। দেখস নাই কত লম্বা লম্বা মছুয়া পাঞ্জাবিরা আমাগো তিনজনের হমান একজন। হেরা একেকটাই সেনাপতি। এই সেনাপতির জাতেগো আমগো পিচ্ছি পিচ্ছি পোলা পানে হারাইতে পারব? কোনো দিন না। আজকা দেহসনা, পুরা রেল ভইরা আইছে। ডাকাতিয়া নদীর ওই পাড় থেইক্যা মুক্তিরা পিটিস্ পিটিস্ করে, বেবাক বন্ধ অইয়া যাইব কাইলই।
দু’ভাইয়ের খাবারের থালাটা যেন ভাগ হয়ে যায়। হাসু বুঝতে পারে না, ভাইজান কী কয়। তার মনে হয়, এ তো তার ভাইজান নয়, অন্য কেউ। পনেরো দিনের মাথায় ভাইজান আবার আসে অনেক রাতে। মার অসুখ। মার জন্য কমলা, আপেল, কত কিয়ের ঠুঙ্গা আর ঠুঙ্গা। হাসু মশারির ভেতর থেকে দেখছে ভাইজান কমলার খোসা ছাড়িয়ে মার মুখে তুলে ধরছে, মা কিছুতেই হা করছে না। ভাইজানের কয়েকবার অনুরোধের পরে মায়ের জবান খোলে, বাজান তুই দল ছাইড়া দে। আমার কথাটা হন। দল? কীসের দল? হাসু বুঝতে চায়। মাথার তার কাজ করে না। মা আবার কথাটা পাড়ে।
‘মা জোর করতাছ ক্যান? জান না, কত কষ্ট কইরা আমি কমান্ডার অইছি।’
হাসুর হৃৎপিণ্ডের শব্দ যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে মশারি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, ভাইজান তুমি কী স্বাধীন দেশ চাও না? কোন দলের কমান্ডার তুমি? নাহ্ ভাবতে পারছে না। সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শোয়, নিজেকে আড়াল করার জন্য। ভাইজান চলে যায়। মার ফোঁপানো কান্নার শব্দ শোনে হাসু।
হাসুর চমক ভাঙে। ডাকাতিয়া নদীর পাড় থেকে শোনা যায় ‘জয় বাংলা’। পরক্ষণে হাসুদের বস্তির ওপাশ থেকে চলাচলরত মানুষের কণ্ঠে জয় বাংলার বিস্ফোরণ ঘটে।
তবে কী দেশ স্বাধীন হলো! লাফিয়ে উঠে হাসু। ক’দিন থেকেই ডাকাতিয়া নদীর পূর্বপাড় আর পশ্চিম পাড়জুড়ে চলছে ক্রস ফায়ারিং। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ডাকাতিয়া নদীর পূর্বপাড় পুরান বাজার এলাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি মিত্রবাহিনীও শহরে ঢুকে পড়েছে।
এলাকাটা শহরতলি হলেও গ্রাম পরিবেষ্টিত। পাক সেনাদের কর্তৃত্ব শহরকেন্দ্রিক। ডাকাতিয়া নদীর পূর্বপাড় থেকে রাত বিরাতে মুক্তিরা এসে কানা মাইর দিয়ে ওদের শান্তি ভঙ্গ করে দেয়। তাতেই সব সময় তটস্থ থাকে তারা।
আজ ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোরের কুয়াশা খান খান করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আকাশে বাতাসে কম্পন ধরিয়ে দেয়। হাসু কারেন্টের শক্ খেয়ে যেন চৌকি থেকে নিচে পড়ে যায়। বেড়ার ঝাঁপটা খুলে বেরিয়ে পড়ে দ্রুত। পেছন থেকে মা তার জামার হাতাটা টেনে ধরে। হাতাটা ছিঁড়ে মায়ের হাতেই থেকে যায়। মা কাল চাদরটা নিয়ে পেছন পেছন দৌড়ায়। ‘বাজান, বাজান পৌষ মাইসা শীত, চাদর লইয়া যা।’
শত মানুষের স্লোগানের ভিড়ে হাসুও মিশে যায়। ডাকাতিয়া নদীর পাড় ঘিরে উৎসবের ভোর জেগে ওঠে। গত রাতেই মুক্তি আর মিত্রবাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে হানাদাররা পালিয়েছে। চাঁদপুর শহর আজ স্বাধীন। এত দিনের না বলা কথা, আত্মার নিমজ্জিত ধ্বনি যেন উথলে ওঠে। হাজার জনতার মাঝে রাইফেল, এসএলআর আর স্টেনগানের গুলির নিশানা আকাশ ভেদ করে বলে যাচ্ছে সূর্যলোকে। ডাকাতিয়া পাড়ের সূর্য আজ স্বাধীন। ওপার থেকে নৌকার পর নৌকায় আসছে মুক্তিযোদ্ধারা। নদীর হাঁটুজলে হাসুও নেমে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করার জন্য। ডাকাতিয়া নদীর উত্তাল আনন্দের তরঙ্গে দোলায়িত আজ চাঁদপুরবাসী। সূর্যের রক্তিম আলোর বিকিরণে লাল হয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদীর জল। বিজয়ের মিছিল এগিয়ে চলে রেলস্টেশনের দিকে। হাসুর কেবলই মনে হচ্ছে একটা এসএলআরের ট্রিগার টিপে আকাশে গুলি ছুড়বে। কিন্তু কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তার খোঁড়া পা-টি যেন মূল কারণ। কেউ তার ওপর ভরসা করতে পারছে না। অথচ অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে রাইফেল নিয়ে ট্রিগারের চাপ মেরে আনন্দ ফোটাচ্ছে। হ্যাঁ, তবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ক’জন মিলে কাঁধে উঠিয়ে নেচেছে এটা তার বাড়তি আনন্দ, যদিও নাচার তাল হারিয়ে সিট্কে পড়েছিল ড্রেনে।
বিক্ষিপ্ত মিছিল ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’ গান গাইতে এগিয়ে যায় স্টিমার ঘাটের দিকে। গত ক’মাসে যেখানে পাকসেনা আর রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা কেউ সেখান থেকে গিয়ে ফিরে আসেনি। এমনকি তাদের লাশও পায়নি কেউ। মেঘনার মোহনায় নৌকা করে পায়ে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দিয়েছে একেকজনকে হানাদারের দোসররা। মিছিলটি হঠাৎ করে আক্রান্ত হয় লুকিয়ে থাকা একদল রাজাকারের গুলিবর্ষণে। বেশ ক’জন উল্লসিত জনতা হতাহত হয়। জনতা লাঠি, কোদাল, ইট, শাবল নিয়ে মুহূর্তে ঘিরে ফেলে তাদের। পরক্ষণে গণ-আক্রোশের শিকার হয় তারা। মানুষের উল্লাস আর ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের মুখোমুখি একদল রাজাকার। তাদের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী না হয়ে হয় উল্লসিত। হাসু জনতার ভিড় ভেদ করতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠে না। তার মানসপটে ভেসে ওঠে একটি রক্তাক্ত মুখমণ্ডল। যার পতিত দেহটি তড়পাচ্ছে, যেন সে তার আপন মায়ের পেটের ভাই।
হাসু ধীর পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যায় ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে। দুপুরে মাঝ সূর্যের আলোয় ডাকাতিয়া নদীর জল মৃত্যু কম্পনে যেন তড়পাচ্ছে। হাসু একটা ঢিল সজোরে ছুড়ে মারে নদীতে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে না। নদীর ওপারে উড়ছে হাজার হাজার স্বাধীন পতাকা। হঠাৎ হাসুর মনে হয় তার ভাইজানের জন্য এক ফোঁটা ব্যথার জলও তার চোখের কোণে জমা হয়নি। হ


আরো সংবাদ



premium cement

সকল