২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সংসার কিস্তি

-

বাইরে প্রচণ্ড বাতাস। পলিথিনের বেড়াটা পতপত শব্দ করে উড়ছে। কখন যে এক ঝটকায় উড়িয়ে নেÑ কে জানে। লণ্ঠনের দশাও নিভু নিভু। মরণ দশা তারও! ঠেরেঠুরে দেখা গেল সলিতাটা ঠিকই আছে। তেলের বুঝি মাস ফুরোলো। জানলাটা খুলে দিয়ে জোছনা রাতের তারা গুনছে সুলতানা। অগুনতি তারার মেলা বসেছে আজ চাঁদের হাটে। এত এত সব আলোর ভেতর ঠিকই রাজত্ব করছে সবচেয়ে উজ্জ্বল চাঁদটি।
প্রথম প্রথম ঝিরঝির বৃষ্টি বাতাসের দমকা হাওয়ায় গায়ে এসে ছিটা মারছিল, দেখতে না দেখতে শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি। এরপর শব্দ করে মুষলধারায় বৃষ্টি নামে। পা দুটো ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটাও খোয়া গেছে। তাও আলগোছে হাতের কাছের টর্চলাইটারটি নিয়ে দাওয়ায় গিয়ে অপেক্ষা করে সে। লোকটি কোথায়! আজো কি বাড়ি ফিরবে রাত করে? ঘরে তেল নুনের বংশ পর্যন্ত নেই। কবে আসবে বাদবাকি কাজ গোছাবে! আমি তো গেলামই গোল্লায়। মা তো আরো অনেকেই হয়, তাদের এত ঝামেলা পোহানোর প্রয়োজন পড়ে না। আমার বেলাই ষোলো আনার হিসাব, ঝক্কিতো তাই পোহাতেই হবে। ছোট্ট হালকা পাতলা লিকলিকে শরীরটা যেন রোগ বালাইয়ের আস্ত গোডাউন। এর সাথে তো পোয়াতে। প্রতিরাতে ঘুমাতে গেলে কত হাবিজাবি স্বপ্ন দেখে সে ভয়ে হাত-পা বরফের মতন শীতল হয়ে যায়। মা-বাবার অমতে বিয়ে করেছিল বলেই কি তার এত কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।
আরে দূর না; নিমিষেই আবার ভুলে যায়। যখন মনে পড়ে নিহালের চেহারাটি। সব কষ্ট তখন হাওয়া হয়ে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করেছে দু’জন। বছর চারেক ধরে। শেষে জানাজানি হবার পরে বাপ-মা তাদের বিয়েটি মানতে চায়নি। পরে সুলতানার বাবা-মা মেনে নিতে চাইলেও ভাইয়েরা বাধা দেয় শক্তপোক্তভাবে। সে ছোট বংশের ছেলে বলে মানতে তাদের আপত্তি। তার বাবা ছিল কাঠুরে। কড়লডাঙ্গার পাহাড়ে কাঠ খাটত। কাঁধে করে বয়ে এনে তা তালুকদার পাড়ায় নিয়ে আসত। সেখান থেকে বটবটি করে পটিয়ায় হাটে বিক্রি করা। বর্ষায় পাহাড়ের পিচ্ছিল পথ বেয়ে যাতায়াত বড় রিস্কি কাজ। সে সুবাধে অবসর সময়টায় মাঝে মধ্যে মানুষের বাড়িতে ফায়-ফরমেয়াশও নাকি খাটত। এখনো ছমির উদ্দিন বলেন জানো বৌমা গতর খাটালে পয়সার অভাব নেই। অলসের ভাত নেই। খোদা শক্তি দিয়েছেন নড়েচড়ে খাবার জন্যই তো। অনেক কষ্টেসৃষ্টে মানুষের রঙ ধরিয়েছেন নিহালকে। বড় ছেলে তার রয়ে গেছে এখনো তেপান্তরের পথে। বাবার আগে চুল-দাড়িতে পাকন ধরলে যা হয়। তার বেলায়ও তাই হয়েছে। এখন সে নতজানু বৃদ্ধ, বিছানায় এগিয়ে দিলে তবে খেতে পারে। যতœআত্তির নাম-গন্ধ বাকি রাখে না বৌমা। দেখতে দেখতে একদিন তাদের এই টানাটানির ঘরে এলো চাঁদের টুকরোর মতন ফুটফুটে চাঁদনি। দাদাতো ভীষণ খুশি। নাতনীর চেহারাটি তার একেবারে চান্নির রাইতের মতন ফকফকা লাগে। কত করে তার চেহারার আবরণে তার স্ত্রী ফাতেমাকে মেলায়। এই দেখো বৌমা তোমার চাঁদনির নাকটা ফাতেমার মতন কিন্তু। চেঁচানোটা একদম কিন্তু ফাতেমা। সুলতানা টিপটিপ করে লাজুক ভঙ্গিতে হাসে।। নানা বাড়ির কেউ খোঁজখবর নেইনি চাঁদনির। এ কথা বারেবারে সুলতানার বুকের ভেতর প্রবল স্রোতে আঘাত হানছিল। কতটা অভিমান মানুষকে পাথর বানাতে পারে সেটাই যেন দেখালো তারা। একটা সামান্য কাঠুরের ছেলেকে বিবাহ করবে তাও তালুকদারের বোন।
ছিঃ! আভিজাত্যের গৌরব। তাদের তালুকদারগিরি সেই কবে দেউলিয়া হলেও তাতে কি! নামের সাথের সাইনবোর্ডটি তো এখনো মূর্তমান। কলিমুদ্দিন তালুকদার। সাইনবোর্ডের একটা মূল্য আছে না! তলে তলে তার ছোট ভাই কাসেম তালুকদার বেজায় খুশি ছিল। সে বাপের ব্যাটা শাব্বাশ! একটা কাপুরুষ বটে। যত আকাম আছে তাদের সবার জাত গোষ্ঠীসহ চেনে। বোনটিকে কোনরূপ ছলেবলে গছিয়ে দিয়ে আখেরে লাভই হলো। মাকে যদি ফুঁসলিয়ে ফাঁসলিয়ে জায়গা-সম্পত্তিগুলো যদি এবার খোয়ানো যায়। পরে যা হওয়ার হবে। ছোট বোন ভুল করেছে ক্ষমা না করে পারে! বাপ মরে যাওয়ার আগে সহায়-সম্পত্তির দু-দশ খানি যা কিছু অবশিষ্ট আছে সবই মার নামে লিখে গেছেন।
সুলতানাকে বাবা প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। শেষকালে এই মেয়েটি জন্মালো বলে লোকের ঠাট্টা-মশকারির অনেক শিকার হতে হয়েছিল তাকে। মারও মেয়ের নাম শুনলেই জল গড়িয়ে পরে। তাই ছেলে পাঁচটির মাথার ভেতর শুধু একটি ভূত। মা যদি আবার সুলতানার সাথে কখনো মিলমিশ হয়ে যায়, সহায়-সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারায় তাদের টান পরবে নাতো! তাই সকাল-সন্ধ্যা পালা করে ভাইয়েরা কানের কাছে বকবক করে। হ্যান হয়েছে ত্যান হয়েছে। মায়ের চোখ দুটো গলগলিয়ে অশ্রু নদী বয়ে যায় কপোল ছুঁয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ে মধ্য গালে গিয়ে মিলিয়ে যেত। মাকে ছোট ছেলে নিজের কাছে রাখার তফদারি চেয়ে বসে। বড় ভাইগুলো ভাগড়া দেয়, না। এ হতে পারে না। মা-কি একা তোর! মা সবার, সবার কাছে থাকবে মাÑ বুঝলি। সত্যিকারার্থে সবার কাছে থাকবে বা কেমন করে। বাপ থাকতেই বড় তিন ভাই বিভেদের পথ ধরেছে। ছোট দু’টিও এখন ঝাপ্টাঝাপ্টি করে, নিত্য লোক হাসায়। তার চাচাতো ভাই করিম তালুকদার। বাপ-মা নিয়ে কত সুখে। তাদের এই চিল্লাপাল্লা শুনে মনে মনে হাসে।
সিদ্ধান্ত হলো সবাই এককাতারে আসবে। এটি মার চাওয়া। নয়তো মা ঝামেলা-টামেলা দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভেতর নেই। জায়গা খানিকটা বেচে দিয়ে তার টাকাই লোক রেখে আলাদা রেঁধে খাবে। এই তার সাফ কথা। কথাটা শুনেই সবার মনে রাগ জন্মে। ডেকে বলে, ‘মা তুমি আমাদের মান-সম্মানের বংশ রাখবে তো?’
পরিশেষে সবাই মিলে একজোট হয়ে বাস করতে লাগল। এতে টুকাটুকি হয় না কে বলল! হয়, হবেই। বড় পরিবারে ঢিল ছুড়লে ছোট আওয়াজ হয়, ছোট পরিবারে মারলে বড় আওয়াজ হয়। অনেকটা জলে ঢিল ছোড়াছুড়ির মতন। বড় বৌটা শয়তানের হাড্ডি। এত কূটচাল সারাক্ষণ মাথায় নিয়ে কেমন করে ঘুমোতে যায় খোদা মালুম! মার একদিন খুব জ্বর। ছোট ছেলে মাকে নিয়ে সদরে যায়। গাড়ি ভাড়া করে। মেডিক্যালে ভর্তি করে। জরুরি একটি সাইনের প্রয়োজন দেখিয়ে সেদিন মার সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। আপন উদরজাত সন্তান এটা করল! তার পর অসুস্থ মাকে নানান ছুঁতো তুলে দেয় তাড়িয়ে। এবার যেখানে মন চায় যাও।
বর্ষাকাল। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি। এর মধ্যে বেরোয় সে মেয়ের বাড়ি যাবে বলে। ভিজে ভিজে সব দুঃখ-ক্ষোভ, অভিমান ঝেড়ে বৃদ্ধা আছিয়া বিকেলের আগেই মেয়ের বাড়ি উঠে। প্রথমবার বেয়াই বাড়ি যাওয়া। হাতে টাকা কড়ি নেই। আধ পোয়া চালের ভাজা। পলিথিনে করে নিয়ে যায়। ভালো কিছু নিতে না পারার কষ্টে তার মাথা হেঁট হয়ে যায়। মেয়েটি অভিমান করে। তবে তার কাঠুরে শ্বশুর স্বামী নিমিষেই অতিথিকে ঘরে নেন। কত সমাদরে। কত যতেœ। বেয়াইন যে! আসুন আসুন।

 


আরো সংবাদ



premium cement