২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হেরে যাওয়ার আনন্দ

-

ক্লাসের লাস্টবয় আর ফার্স্টবয়ের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হতে পারে এরকম দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুব একটা নেই বললেই চলে। ফার্স্টবয়ের বন্ধুত্ব হবে যাদের রোল দশের ঘরে তাদের সঙ্গে। লাস্টবয়ের বন্ধুত্ব হবে ফেল করতে করতে যারা ক্লাস গুনেছে কিংবা কোনো রকম টেনেটুনে পাস করেছে তাদের সঙ্গে। এমনটাই নিয়ম। এমনটাই হয়ে থাকে। এর বাইরেও যে কথা থাকে তা হলো ‘ব্যতিক্রম’। আমার সঙ্গে রামিমের বন্ধুত্বও সেরকম। আমি ফার্স্টবয়। রামিম লাস্টবয়। রামিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার দীর্ঘ দিনের। ক্লাস ফাইভে আমাদের প্রথম জানাশোনা শুরু। গাঢ় বন্ধুত্ব যাকে বলে, সেটা শুরু হয় ক্লাস এইট থেকে।
একটা বিষয় আমি খেয়াল করেছি, ভালো ছাত্ররা ভালো ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তবে বন্ধুত্বের চেয়ে ঈর্ষাটাই বেশি কাজ করে এই ভালোদের মনে। কিন্তু খারাপ ছাত্রদের মধ্যে ঈর্ষা থাকে না। থাকে সহযোগিতার মনোভাব। বড় আশ্চর্যের কথা হলো, আমাদের বন্ধুত্ব টিকে যায় বিশ^বিদ্যালয়ের স্বপ্নিল দিনগুলো পর্যন্ত। আমি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করছি। আর রামিম কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স করছে। ফাইনাল পরীক্ষার এখনো ৬ মাস বাকি। ৬ মাস পর বিশ^বিদ্যালয় জীবনের ইতি ঘটবে। জীবনের প্রয়োজনে কে কোথায় হারিয়ে যাবেÑ তা তো শুধু জীবনের স্রষ্টা আল্লাহপাকই জানেন। শুধু মাঝে মাঝে রামিমের জন্য মনটা হু হু করে ওঠে। এত দিনের তিল তিল করে গড়ে ওঠা প্রাণের বন্ধুকেও ছাড়তে হবে জীবিকার তাগিদে, জীবনের প্রয়োজনে।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘ভালো ছাত্রদের কোনো বন্ধু থাকে না’। তাই তাঁরও ছাত্রজীবেন কোনো বন্ধু ছিল না। আমি যখন বিখ্যাত কেউ হয়ে যাবো, তখন বলবÑ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের কোনো গার্লফ্রেন্ড থাকে না। আমারও ছিল না। সাবরিনাকে দেখার আগ পর্যন্ত প্রেম বিষয়ে এটাই ছিল আমার একামাত্র এবং সর্বশেষ সিদ্ধান্ত। যেদিন সাবরিনাকে প্রথম দেখি, মনে হলো আমি এত দিন জন্মান্ধ ছিলাম। সাবরিনাকে দেখার অপেক্ষায় আমার চোখ দুটো এতদিনে সার্থক হলো।
২.
সাবরিনার বোন তাজিয়া পড়ত আমার কাছে। সে সূত্র ধরেই সাবরিনার সঙ্গে পরিচয়। ওদের বাসায় গিয়ে প্রথম জানতে পারলাম, আমার ডিপার্টমেন্টেই সে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ারে। প্রেম-ট্রেম নয়। সিদ্ধান্ত নিলাম সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো সাবরিনার বাসায়।
সাবরিনার বাবা-মা খুব রক্ষণশীল। কয়েক মাস আসা যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি, আর যাই হোক সাবরিনার সঙ্গে প্রেম সম্ভব নয়।
পাত্র হিসেবে আমি সাবরিনার বাবা-মায়ের মনের মতো। বাবা-মায়ের মতে সাবরিনা অমত হবে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সবদিক বিবেচনায় পথ আমার পরিষ্কার। প্রস্তাব পাঠাব। বিয়ে করে সুখের সংসার করব। একটি সফল তৃপ্তির জীবন কাটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো। কিন্তু কথায় আছে সুখে থাকতে ভূতে কিলায়।
আমি ঠিক করলাম এরকম নিরুপদ্রবভাবে সাবরিনাকে পাওয়াতে না আছে বীরত্ব না আছে কৃতিত্ব। এমন কিছু করা উচিত যেন বিয়ের পর সাবরিনাকে দেখামাত্রই নিজেকে ‘বিজয়ী বীর’ হিসেবে সমীহ করতে পারি। তবে প্রতিপক্ষ হিসেবে শক্তিশালী কাউকে কল্পনা করতে পারলাম না ‘যদি হেরে যাই’ এই ভয়ে। বারবার মনে হচ্ছে, মহা গবেট রামিমই আমার এ খেলার সুযোগ্য প্রতিপক্ষ।
একদিন রাতে শোয়ার সময় সাবরিনার ছবি দেখিয়ে রামিমকে বললাম, দোস্ত! মেয়েটিকে পছন্দ হয়? রুমের আলো নেভানো ছিল। মোবাইলের স্ক্রিনের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম রামিমের চোখ কপালে ওঠে গেছে। এক মনে তাকিয়ে আছে সাবরিনার ছবির দিকে। অনেকটা জোরের সঙ্গেই আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে আরো ভালো করে দেখতে লাগল ছবিটি। কখন যে দুই বন্ধু শোয়া থেকে ওঠে বসলাম টেরও পাইনি।
চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে! বিয়ে করবি না কি ওকে?
নাম কী? পরিচয় কী? কী করে? পাত্রীর এসব খোঁজখবর জানা আবশ্যক। কিন্তু রামিমের মনে হলো, এ যেই হোক আর যেমনই হোক, একে আমার চাই-ই চাই। সে ধড়মড় করে বলল, দোস্ত! এত মানুষ না রে অপ্সরা।
ভেতরে ভেতরে আমি আনন্দে ফেটে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাইরে তা বুঝতে দিইনি একবিন্দুও। ঘুঘু ফাঁদে ধরা দিয়েছে। এবার আমার চাল চালা যাক। সত্য-মিথ্যা গল্প সাজিয়ে রামিমকে আমার প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছাড়লাম। রামিমকে বলেছি, ছবির এই মেয়েটি আমার স্টুডেন্ট তাজিয়ার বোন। তোর ছবি সে দেখেছে। ওর বাবা-মাকে তোর কথা বলেছি। তারা তোর ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। অবশ্য তারা আগ্রহী আমার ব্যাপারেও। কিন্তু...
কথাটা শেষ করলাম না ইচ্ছে করেই। শব্দের জগতে ‘কিন্তু’ শব্দটা বড় অদ্ভুত। কোনো কিছু বাদও দেয় না, নিশ্চিতও করে না। সম্ভব-অসম্ভবের মাঝে ঝুলিয়ে রাখে মানুষকে। এই যেমন এখন ঝুলালো রামিমকে।
হঠাৎ ঘুম থেকে জাগালে মানুষ যেমন ধড়মড়িয়ে বলে, কী হয়েছে; রামিম তেমন কণ্ঠে জানতে চাইল, কিন্তু কী?
আমি বললাম, সাবরিনাকে বিয়ে করতে হলে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। পারবি?
সাবরিনাকে ছবি দেখানো কিংবা রামিমের ব্যাপারে ওর বাবা-মায়ের আগ্রহের কথা পুরোটাই আমার চালের অংশ মাত্র। বিসিএসের কথা শোনে রামিম পিছিয়ে যাবে এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম, কিন্তু এতটা জোরের সঙ্গে যে ‘পারব, পারতেই হবে’ বলে চেঁচিয়ে উঠবে তা আমি ধারণাও করিনি। ওই দিন প্রথম আমি আত্মবিশ^াস কাকে বলে রামিমের চোখে মুখে দেখেছি।
আমাদের মধ্যে চুক্তি হয়ে যায়, রামিম বিসিএস ক্যাডার হলে আমি তার হয়ে প্রস্তাব নিয়ে যাবো। আর নয়তো রামিম নিজে আমার হয়ে প্রস্তাব নিয়ে যাবে সাবরিনার বাসায়। লাভের লাভ এটা হয়েছে, প্রাণের বন্ধু রামিমকে যে আমি নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছি, তা সে বুঝতেই পারেনি। অর্থাৎ সাপও মরল আবার লাঠিও ভাঙল না।
৩.
শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘খুব পরিকল্পিত কাজের শেষ ফলও ভগবানের হাত থেকেই নিতে হয়।’ সাবরিনার গল্পের শেষ ফলও আমাকে তাকদিরের খাতা থেকেই নিতে হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম শুক্রবারে রামিম-সাবরিনার বিয়ে। শর্তমতে ঘটকালিটা আমাকেই করতে হলো।
রামিমের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর আমি নিশ্চিন্ত মনে দিন গুনতে লাগলাম। অল্প অল্প করে বিয়ের প্রস্তুতিও নেয়াও শুরু করি। বাসায় সাবরিনার ছবি দেখিয়ে বলে দিয়েছি, পরীক্ষার পর এই মেয়েকেই বিয়ে করছি। বাসার লোকজনও তাদের মতো করে প্ল্যানিং করতে লাগল।
রামিম ঠিক কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল আমি সবটা বুঝতে পারেনি। তাই স্পষ্ট কিছু বলতেও পারছি না। সকালে বেরোয়, ফিরে গভীর রাতে। জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক কিছু বলে না। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, বিসিএসের প্রিপারেশন নিবি না? সে বলত, হ্যাঁ রে, একটু ফ্রি হয়ে নিই তারপর পড়া শুরু করব।
এর মধ্যে ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা শেষ হলো। আমি বরাবরের মতো ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। কোনো রকম সেকেন্ড ক্লাস নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিøট করে রামিম। কয়েক মাস পর বিসিএস পরীক্ষার সার্কুলার দেয়। ফরম পূরণ করে পরীক্ষার অপেক্ষা করতে থাকি দু’জনে।
পরীক্ষা যতই ঘনিয়ে আসছে আমার পড়ার তোড়জোড় আরো বাড়ছে। কিন্তু রামিমের রুটিনের কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। সকালে যায়, রাতে ফেরে। কোনো কোনো রাতে ফেরেও না। আমিও অযাচিত কৌতূহল দেখানোর প্রয়োজন মনে করিনি। শত হলেও এখনো আমার প্রতিপক্ষ। মাঝে মাঝে শুধু এটুকুুই মনে করিয়ে দিই, চুক্তির কথা মনে আছে তোর? বিসিএসে না টিকলে সাবরিনাকে হারাতে হবে।
চেহারায় একরাশ হতাশা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকায় রামিম। কখনো মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। কখনো ঘাড় ঘুরিয়ে কাজে মন দেয়। যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে তার চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই।
গত তিন দিন রামিম বাসায় আসেনি। যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করে ডায়েরিটি ড্রয়ারে রেখে যেতে ভুলে যায়। আর আমার কৌতুহলী মন ডায়েরির পাতা উল্টাতেই দেখি তাতে লেখা আছে।
‘সাবরিনাকে দেখার পর থেকেই আমি ঠিক করি, যে করেই হোক ওকে আমার চাই-ই চাই। এ জন্য যা যা করা দরকার সব করতে প্রস্তুত আমি। আমাকে বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে।’
রামিম হোসাইন
তারপর ভেতরের একেকটি পাতা উল্টাই আরো আশ্চর্য হয়ে দেখি, বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য কতটা অমানবিক পড়াশোনার হিসাব লিখে রেখেছে রামিম। কত দুপুর না খেয়ে থাকাসহ কী না করেছে ও। এসব জানার পর নিজেকেই নিজের কেমন যেনো ঘেন্না হতে লাগল। নিজের অসুস্থ তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এমন অমানবিক খেলা খেলতে পারলাম বন্ধুর সঙ্গে? এখন যদি রামিম সাবরিনাকে না পায় তাহলে কতটা আঘাত পাবে, কতটা ভেঙে পড়বে ও ভাবা যায়?
ছয় মাস পরের কথা। পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্টও বেরিয়েছে। রামিম বিসিএস ক্যাডার। আমার নাম আসেনি। আসবে কিভাবে আমি তো পরীক্ষাই দিইনি। হেরে যাওয়ার আনন্দ যে এত তীব্র হতে পারে এই প্রথম বুঝতে পারলাম।
ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement