জাতীয় মুক্তির চেতনা ও আজকের ৭ নভেম্বর
- আবদুল লতিফ মাসুম
- ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
একটি দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে দুটো পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা হয়। প্রথমত, রাষ্ট্রের আদর্শ ও লক্ষ্য বা উৎসমূলের বিকাশ ও উন্নয়ন মাত্রায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একে ‘জাতি গঠন’ প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করা হয়। ‘জাতিরাষ্ট্রের’ আদর্শিক ভিত্তিভূমি যদি শক্ত পাটাতনে নির্মিত না হয় তাহলে কালক্রমে সৃষ্ট রাষ্ট্র নামক গৃহটি দুর্বল, ব্যর্থ এমনকি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের দৃশ্যমান মানচিত্র তথা ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার শক্তি ও সক্ষমতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তার পরিচায়ক। জাতিগঠন প্রক্রিয়া একটি তাত্ত্বিক বিষয়। অপর দিকে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়াস দৃশ্যমান। প্রতিরক্ষা বাহিনী, সীমান্ত সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়াস বিধৃত। কোনো দেশ বা জাতি যখন কোনো সঙ্কট, হুমকি ও যুদ্ধের মুখোমুখি হয় তখন তাত্ত্বিক ও বাস্তবÑ উভয় পর্যায়ই জাতিকে পরীক্ষার মোকাবেলা করতে হয়। ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ অর্জিত আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে এ ধরনের সঙ্কট মোকাবেলা করতে হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর।
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ’৭৫ একটি রহস্যময় অধ্যায়। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে কমপক্ষে তিন ধরনের বিভক্তি রয়েছে। প্রথমত, জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপির কাছে এটি সিপাহি-জনতার বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এটি ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা অধিষ্ঠানের ভিত্তিভূমি। বিপ্লব নামের সার্বিক পরিবর্তন এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের আবেদন তারা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার নৈতিকতা ও বৈধতা প্রমাণ করতে চায়। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা দিয়ে তাদের জন্য নিরাপদ বলয় স্থাপন করতে চায়। ৭ নভেম্বর ’৭৫-এর যে ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যাই আওয়ামী লীগের অনুকূল নয়। সে অস্থির সময়ে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ৭ নভেম্বরের মূল অনুঘটক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠানের জন্য সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। তাদের নেতা ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’র ডেপুটি লিডার হাসানুল হক ইনু এই সেদিন ক্ষমতার ভাগীদার ছিলেন। তারা সে সময়ের তৃতীয় পক্ষ। তাদেরও একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা এবং বিবৃতি রয়েছে। সে কারণে আনুষ্ঠানিক উপসংহারে পৌঁছানো একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার। ১৯৮৮ সালে আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের পটভূমি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ শুরু করি।
১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রাষ্ট্রের প্রাথমিক শাসক এলিট এবং তাদের নেতৃত্ব আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের বিপরীতে জনগণের জন্য দুর্যোগ ও দুঃখ-কষ্ট বয়ে আনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী অংশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। জনগণের দুর্ভোগ এবং শাসন-প্রশাসনের ব্যর্থতার সুযোগ নেয় তারা। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলিকে প্রকারান্তরে সেনাবাহিনী অনুমোদন দেয়। ওই দিন বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর সদর দফতরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হত্যাকারী মেজরেরা নিজেদের সেনাবাহিনীর কাছে সমর্পণ করে। সেনাবাহিনী তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত এমনভাবে প্রকাশ করে যে, ‘হট হ্যাপেন্ড ইজ হ্যাপেন্ড’। জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দেন। তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্যার কাছে দায়িত্ব সমর্পণের পরামর্শ দেন। অবশ্য ততক্ষণে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রাথমিক আবেগ-উত্তেজনা এবং ভাব ও বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুনি মেজররা বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্র চালাচ্ছিল। আর সিনিয়ররা সেনানিবাসে বসে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ মেজরদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। সিনিয়রদের তার প্রতি দৃঢ় আনুগত্য ছিল না। খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি-কে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগ করলে স্বস্তির আশাবাদ সৃষ্টি হয়। কিন্তু উভয় পক্ষই তাকে যেমন বিশ^াস করছিল তেমনি অবিশ^াস করছিল। উল্লেখ্য, তত দিনে সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। জিয়া তার স্বভাবসুলভ কুশলতা এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। জিয়ার প্রতি মেজরদের আস্থায় ঘাটতি না থাকলেও সিনিয়ররা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়েন। ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় পদাধিকারী খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকা ব্রিগেড প্রধান কর্নেল সাফায়াত জামিল দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। বিশেষ করে কর্নেল সাফায়াত জামিল ‘হট হেডেড’ বলে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই দু’জন মুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের কমান্ডকে অস্বীকার করেন। তারা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান। জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেন। তারা খন্দকার মোশতাকের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। তিনটি প্রেক্ষাপট দিয়ে এ পরিস্থিতিটি ব্যাখ্যা করা যায়।
জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গোপনে কর্মরত ছিল। ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থান সেনাছাউনিতে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব একটি আত্মঘাতী যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করে। সেনাবাহিনীর রাজনীতি সচেতন অংশ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের কাছে করণীয় নির্দেশ আশা করে। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। নির্দেশনা দেয়ার জন্য ট্রেনে তিনি ঢাকা আসেন এবং এলিফ্যান্ট রোডে এক শুভাকাক্সক্ষীর বাড়িতে অবস্থান নেন। কর্নেল তাহের এ পরিস্থিতিকে কাক্সিক্ষত বিপ্লবের জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ মনে করেন। কিন্তু তার জনবল এবং কাঠামো বিপ্লব কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তিনি জিয়াউর রহমানের বন্দিদশা, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তার ইমেজ এবং সৈনিকদের মধ্যে তার সদ্ব্যবহারের সুনাম ব্যবহার করার কৌশল গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সৈনিককে পৃথকভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়। নির্দেশ ছিল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ঢাকায় এনে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু জিয়াকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন অগ্রসর হয় তখন উপস্থিত শত শত সৈনিক তাদের অনুগমন করে। সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে সেøাগান, আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে করতে তাকে কাঁধে বহন করে ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। ফলে কর্নেল তাহেরের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। কর্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডের বাসার বারান্দায় অধীর আগ্রহে জিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন খালি হাতে এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছে তখন কর্নেল তাহের তার স্বভাবসুলভ গালমন্দ করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে ধিক্কার জানান। পরে তারা আরেকবার চেষ্টা চালায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসার জন্য। ২২ বেঙ্গলে গিয়ে তারা জিয়াউর রহমানকে বলে যে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে আপনি মুক্ত হয়েছেন। চলুন তার সাথে দেখা করে আসবেন। ধীরস্থির অথচ দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী জিয়াউর রহমান ততক্ষণে অনেক কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। নাটকীয় কায়দায় তিনি বললেন, ‘কর্নেল তাহের তোমাদের নেতা এবং আমারও নেতা। একদিন তাকে এই সেনানিবাস ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাকে আবার এখানে নিয়ে আসো। তিনি এখান থেকেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন। পরে কর্নেল তাহের ২২ ইস্ট বেঙ্গলে চলে আসেন। এ সময় জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, জিয়াকে ফুলের মালা পরিয়ে দিতে চাইলে জিয়া নিজে তা কর্নেল তাহেরের গলায় পরিয়ে দেন এবং বলেন, এটা তাহের ভাইকেই শোভা পায়। কর্নেল তাহের ক্রমেই উপলব্ধি করতে থাকেন যে তার পায়ের নিচের মাটি আর নেই। তাহেরের লোকেরা জিয়াউর রহমানকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার জন্য রেডিও অফিসে নিয়ে আসার জন্য আরেকবার শেষ চেষ্টা চালায়। ঢাকা ব্রিগেডের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি কর্নেল আমিনুল হক মতলব বুঝতে পেরে একটি রেকর্ডিং ইউনিট ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ করেন। সর্বশেষ সমাপনী ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ গ্রন্থে বলেন, ‘৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি সায়েম যখন বেতার ভাষণ দেন তখন জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহের উভয়ই বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। বেতারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কামরায় বসে জিয়ার সাথে তাহেরের কথাবার্তা হয়। তাহের জিয়াকে বলেন, বিপ্লবী সৈনিকদের কিছু দাবি আছে। জিয়া যেন তা শোনেন এবং অবিলম্বে মেনে নেন। জিয়া স্বভাবসুলভ ধীরস্থিরভাবে বলেন, তিনি একটু পরে সৈনিকদের সাথে দেখা করবেন। উল্লেখ্য, বেতারের স্টুডিওতে আসার আগেই রাষ্ট্রপতির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল, যাতে আলোচনার সময় তাহের বা জাসদের সশস্ত্র সৈনিকেরা কোনো শর্ত বা দাবি-দাওয়া নিয়ে চাপ না দিতে পারে। জিয়ার এ কৌশল ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল।’ ‘রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেষ হওয়ার পর জিয়া খুব হালকা মেজাজে তাহেরকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। সেখানে জাসদপন্থী ২০-২৫ জন সশস্ত্র সৈনিক দাবি-দাওয়ার একটা লম্বা তালিকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। জিয়া ঘরে ঢুকেই সৈনিকদের সাথে হাত মেলালেন, কুশল জিজ্ঞেস করলেন এবং ছোট একটা টেবিলের ওপর বসে খোশমেজাজে হেসে হেসে তাদের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। তিনি সৈনিকদের মধ্যে একজনকে দাবি-দাওয়া পড়ে শোনাতে বললেন। পড়া শেষ হলেই জিয়া বললেন, দাবিগুলো খুবই ন্যায্য এবং তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত। দাবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল জেলে আটক ও জাসদ নেতা জলিল ও রবের মুক্তি। জিয়া সাথে সাথে তাদের মুক্তির নির্দেশ দিলেন। এতে জাসদপন্থী সৈনিকদের মধ্যে যেটুকু উত্তেজনা অবশিষ্ট ছিল, তাও মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। বাকি দাবিগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করা হবেÑ এই আশ^াস দিয়ে জিয়া অত্যন্ত আস্থার সাথে সৈনিকদের সাথে হাত মিলিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। (মহিউদ্দিন আহমেদ, ২০১৬ :৭৬)। জুবায়ের সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়ার এই তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন কৌশলের কাছে কর্নেল তাহের একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে হতাশ এবং অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়লেন।
খালেদ মোশাররফ একান্তই আওয়ামী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের এমপি ছিল। খালেদ মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগের ওপর যে খুশি ছিলেন তাও নয়। তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে তিনি ভারতের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ৪ নভেম্বর যখন তার বৃদ্ধ মাতা এবং ভাই বঙ্গবন্ধুর শোক প্রকাশে মিছিলে অংশগ্রহণ করেন তখনই খালেদ মোশাররফের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। খালেদ নিজে তার মাকে তার পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। য হোক, তখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে এবং ঘটনাচক্রে সেনাবাহিনীতে তার অবস্থান আওয়ামী লীগ অনুকূলে হিসাব করা হয়। সেনানিবাসে সাধারণ সৈনিক থেকে কে এম শফিউল্লাহ পর্যন্ত অর্থাৎ সেনাপ্রধান পর্যন্ত একটি প্রচ্ছন্ন ভারতবিরোধী মনোভাব বর্তমান ছিল। ৪ নভেম্বরের মিছিল ভারতবিরোধী মনোভাবে ঘৃতাহুতির কাজ করে। সৈনিক থেকে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে শঙ্কিত হয়ে ওঠে, আবারো ভারতমুখী সরকারের অধীন হতে হবে। কর্নেল তাহের এই সস্তা ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগান এবং তাদের কথিত বিপ্লবে অংশীদার হওয়ার জন্য সাধারণ সৈনিকদের আহ্বান জানান। সাধারণ সৈনিকরা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এবং প্রচণ্ড ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে তাহের বাহিনী সঞ্চারিত বিপ্লবে যোগদান করে। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ‘জিরো আওয়ারে’ গুলিবর্ষণের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করা হয়। শহরমুখী ট্রাকগুলোতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকদের গাইড হিসেবে প্রদান করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সেøাগান দিতে বারণ ছিল সেই সেøাগান মুখে মুখে প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়। এই প্রতিবেদক ব্যক্তিগতভাবে সেই মিছিলের ঘনঘটা এবং জনগণের উল্লাস প্রত্যক্ষ করেন। সৈনিকরা নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার সেøাগান দেয়। খন্দকার মোশতাকের ছবি বহন করে তাকে প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃঅধিষ্ঠানের আহ্বান জানায়। তবে মজার ব্যাপার এই যে, খালেদ মোশাররফ নিজেই খন্দকার মোশতাকের পক্ষে দাঁড়ান। তিনি তাকে প্রেসিডেন্ট পদে অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু রাজনীতির চতুর্মুখী সমীকরণে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ পরাজিত হন। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী কর্নেল সাফায়াত জামিল মূল ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগের দৃঢ় সমর্থক কর্নেল জামিল খন্দকার মোশতাককে অপমান অপস্থ করেন এবং পদত্যাগে সই করতে বাধ্য করেন। এভাবে যখন নাটকের শেষ অঙ্ক অভিনীত হচ্ছিল বঙ্গভবনে তখন সেনাবাহিনীতে ঘটছিল আরেক নাটকের শুরু। কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানের দিকে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ধরেন। জিয়াউর রহমানকে যেখানে নিয়ে যায় সৈনিকেরা সেখানেই দিবারাত কাটাতে থাকেন। অস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনী পরিত্যাগকারী সৈনিকদের ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। পলায়নপর সেনা অফিসারদের সাহস ও সহমর্মিতা দিয়ে আবার একত্র করেন। তিনি তাদের এই বলে ভর্ৎসনা করেন যে, ‘সৈনিকের জীবন তো মৃত্যুর জন্যই। ভীরু কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেয়ো না। ঘুরে দাঁড়াও এবং দেশকে রক্ষা করো।’ জিয়াউর রহমানের সর্বাত্মক চেষ্টা, সাহস ও অনুপ্রেরণায় শিগগিরই সেনানিবাসগুলোতে ক্রমান্বয়ে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। একজন মার্কিন সাংবাদিক মন্তব্য করেন, It was Zia himself who saved the army from and impending doom.Õ (Marcus franda : 1982.258)
৭ নভেম্বর ’৭৫-পরবর্তী অধ্যায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রজীবনে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আরো পাঁচ বছর জাতিকে সমৃদ্ধির সোপানে প্রতিস্থাপন করে। তিনি অলস আমুদে বাংলাদেশ জাতিকে নতুন কর্ম উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করেন। দেশের সর্বপর্যায়ে সংস্কারের সূচনা করেন। কৃষি ক্ষেত্রে তিনি বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটান। নদীনালা পুনঃখনন করেন। এভাবে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ পর্যায়ে উন্নীত হয়।
একটি জাতীয় রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠে না। জাতি গঠনের জন্য জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা পেতে অনেক অনেক সময় অতিক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশের জন্ম ও বিকাশে ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস, ভূগোল ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সমন্বিত ভূমিকা পালন করেছে। জিয়াউর রহমান তার ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদের সব উপাদান একসাথে নিয়ে ‘বাংলাদেশী জাতীয়বাদ’-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। এটিই জাতীয় আদর্শ। এটি জাতীয় চেতনা, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাণভোমরা। ৭ নভেম্বর এই জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। আজ সেই চেতনা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। রাষ্ট্র কাঠামোর ধারকেরা জাতীয় আদর্শ, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিধানে সক্ষমতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে জাতীয় চেতনার আলোকে আমাদের দৃপ্ত উচ্চারণ হোক, ‘৭ নভেম্বরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আর একবার’। হ
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা