২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফিরে এসো

-

মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলেজে গেলাম। আমি এ কলেজে পড়তে চাইনি। বাবা অনেক বুঝালেন আর বললেন-
দেখ বাবা, আমার এত টাকা পয়সা নাই যে তোকে ঢাকায় ভর্তি করাব, এখানেই পড়। ভালোভাবে পড়লে এখান থেকেই ভালো রেজাল্ট করতে পারবি। আমার অবস্থাটা তুই একটু বুঝতে চেষ্টা কর!
কলেজের বারান্দা রঙ-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো। আজ কলেজের নবীনবরণ। বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একদল মেয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। এসএসসি পাসের রেশ যেন তাদের এখনো কাটেনি। সবার গায়ে সাদা এপ্রোন আর সবুজ সালোয়ার। মাথায় হালকা কমলা রঙের ওড়না। তাদের অদ্ভুত সুন্দর লাগছে কেন জানি। একটু পর আমি দোতলায় চলে গেলাম।
একটু পর আবার নিচে এলাম, দেখলাম কিছু ছেলেমেয়েদের গায়ে রঙ ছিটানোর চেষ্টা করছে। কয়েকটি মেয়ে তাতে অনেক মজা পাচ্ছে, হয়তো তারা একসাথে স্কুলজীবন পার করে এসেছে। কিন্তু একটি মেয়ে তার গালে কোনো মতেই রঙ লাগাতে দেবে না আর ছেলেদের বলছেÑ
‘স্যরি, তোমরা এমন করো না। বাসায় এমন দেখলে বাবা খুব বকা দেবে আমায়।’
ছেলেরা নাছোড়বান্দা, তারা লাগাবেই। ছেলেদের এমন অবস্থা দেখে একপ্রকার জোর করেই মেয়েটি দৌড়ে চলে গেল আড়ালে।
নবীনবরণ অনুষ্ঠান চলছে। অনেকেই তাদের দামি মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছে। কেউ কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। ব্যান্ড দল এখনো আসেনি তার ফাকে নবীনরা স্টেজে গিয়ে যে যার মতো গলা ফাটিয়ে গান গাচ্ছে আর চিল্লাচিল্লি করছে। আমি মাঝখানের একটি চেয়ারে বসে আছি। ফয়সাল নামের একটি ছেলে এখন গাইছে-
‘চল সবাই..... জীবনের আহবানে... সামনে এগিয়ে যাই।’
একটু পর একটি মেয়ে গাইতে শুরু করছেÑ
‘এখনো কি কেউ আমারে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে?
এখনো কি কেউ আমার পথ চেয়ে থাকে?’
আমি ওই মেয়েটিকে লুকিয়ে দেখতে চেষ্টা করছি। দেখলাম মেয়েটি পেছনের সাড়ির সামনের চেয়ারে বসে আছে। তার কিছুটা মন খারাপ মনে হলো আমার কাছে। আমারও ভালো লাগছে না। কোনো বন্ধু নেই। সবাই অচেনা।
সামিয়া ক’দিন কলেজে আসেনি। মোবাইল নম্বর নিলো কিন্তু কল দিলো না এখনো। একটু রাগ হলো আমার। সোমবার সকাল। রশিদ স্যারের প্রাইভেটে আছি। মোবাইলে ভাইব্রেশন হলো। আমি স্যারকে বলে বের হলাম। দেখলাম সামিয়ার ফোন। সামিয়া সেই গায়িকা যার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
একদিন সকালে বটতলায় আনমনে বসে আছি। সামনে টেস্ট পরীক্ষা। টেস্ট পেপার এখনো কেনা হয়নি আমার। সামিয়া কিনে ফেলেছে, সামিয়ার কাছে ঐরমযবৎ সধঃযং এর অংশটা চেয়েছি। দেখলাম পুরোনো ক্যালেন্ডারে একেবারে বাঁধাই করে দিয়েছে সে। পুরো ক্যালেন্ডারজুড়ে জবাফুলের ছাপ ছাপ আঁকা।
আমি কিছু না বলে ব্যাগে রেখে দিলাম। কিছুটা উত্তেজিত। কী আছে ওটার ভেতর ?
রাত। বাসার সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন বইয়ের ভেতর খুঁজে পেলাম কয়েক লাইনের চিরকুট-
‘ প্রিয় মুহিত, ভালোবাসা নিও। আমি অনুমান করে একটা কথা বলি, যদিও আমার অনুমান কখনো মিথ্যা হয় না। আমার জন্য তোমার অনেক টান। আমার জন্য তোমার হৃদয়ে যে ভালোবাসা ফুটতে শুরু করেছে তা একেবারেই নির্ভেজাল। আমি আমৃত্যু তোমার ভালোবাসা চাই। আমিও তোমাকে আমার হৃদয়ের রাজা বানাতে চাই।
ইতি-ছঁববহ ড়ভ ুড়ঁৎ যবধৎঃ (ং)
সেদিন রাতে আমার এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। এরপর আর চিরকুট পাই না, পাই চিঠি। প্রাইভেটে আসলে কেউ যখন না থাকত সামিয়া বলত,
-তোমার হাতটা একটু দেখি তো। তোমার সাথে হ্যান্ডশেক করি বলেই ভাঁজ করা চিঠি দিয়ে দিত।
সেদিনটা সত্যি খুব আনন্দের ছিল। সারা দিন বাইকে চড়ি, দুপুরের লাঞ্চ করে আবার কোটবাড়ি যাই। সেখান থেকে ঠিক সন্ধ্যার আগে তাকে হাউজ-বিল্ডিং নামিয়ে দেই।
এটাই সামিয়ার সাথে আমার শেষ দেখা। আগামীকাল আমার ভর্তি পরীক্ষা। আমি আনিসের মেসে আছি। মেসে আজ আমি ছাড়া কেউ নেই। ছুটির দিনে তারা কেউ মেসে থাকে না। আমার বন্ধু নাছিরের কাছ থেকে পাওয়া তাকে দেয়া ‘দেবদাস’ বইটি দেখে চমকে গেলাম। আমিই শুধু জানি এই বইয়ের ভেতরে কিছু একটা আছে। যা ভেবেছিলাম তাই হলো, বইয়ের মলাটের ভেতরে একটি চিরকুটÑ
‘প্রিয় মুহিত, তোমাকে কী বলব জানি না, শুধু এইটুকু জানি আমাদের স্বপ্ন কুঁড়িতেই ঝরে গেল। বাবা আর বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখ বন্ধ করতে এ ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। কালকে আমার বিয়ে। তোমার সুন্দর হৃদয় দিয়ে তোমার হৃদয়রাণীকে ক্ষমা করে দিও। ভালোভাবে লেখাপড়া করবে কেমন, যেন নিজেকে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত করতে পারো!
ইতি-ঝরা ফুল।’
সেদিন মেসে একাকী হাউমাউ করে কেদেছিলাম। এর মধ্যে অনেক ঝড় বয়ে গেছে জীবনে। কিছু কেনর উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজেকে বড্ড বদলে ফেলেছি। ডিজিটাল যুগেও সে একটিবার কেন আমার খোঁজ নেয়নি সেটার উত্তর আমার কাছে আছে তবুও তার দেয়া কিছু শর্ত আমি এখনো পালন করি-লালন করি। সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। তার দেয়া চিঠিগুলোতে এখনো আমি শিউলী ফুলের ঘ্রাণ পাই।
কুমিল্লা

 


আরো সংবাদ



premium cement