২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হজ ব্যবস্থাপনায় ৮০-৯০ ভাগ শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে

-

আব্দুস ছোবহান ভূঁইয়া হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর বিদায়ী সভাপতি। ২০১৭-১৯ সেশনে দুই বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। হাবের আসন্ন নির্বাচনে তিনি নিজে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলেও নিজের মনোনীন হাব গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন। নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেন।
হাবের বিদায়ী সভাপতি আব্দুস ছোবহান ভূঁইয়া মনে করেন, হজ ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। সরকার ও হজ এজেন্সিগুলোর প্রচেষ্টায় সামনে শতভাগ শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। নয়া দিগন্তের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাবের মূল কাজ হলো বার্গেনিং এজেন্ট সরকারের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এজেন্সির যে সমস্যাগুলো থাকে, সেগুলো সমাধান করা এবং সামনে নীতিনির্ধারণের বিষয়গুলো সরকারের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। তিনি বলেন, হজকে শুধু ব্যবসা হিসেবে না দেখে হাজীদের সেবার দিকটিকেও গুরুত্ব দিতে আমরা বলে থাকি। আমাদের যারা হজ এজেন্সির মালিক, এদেরকে সব সময় আমরা হাবের পক্ষ থেকে অনুরোধ করি, আল্লাহর মেহমান হজযাত্রীদের কিঞ্চিত পরিমাণও সমস্যা যেন সৃষ্টি না হয়, সে দিকটি তারা যেন লক্ষ রাখেন। এই প্রচারণা আমরা সব সময় চালিয়ে যাই। এজেন্সিদের আমরা এসএমএস, ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করে কাজ করার জন্য অনুরোধ করি।
তারপরও হজের অনিয়মের যে অভিযোগ কম-বেশি আসছে, বিষয়টি আসলে দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। প্রশাসনিক দায়িত্ব তো হাবের নয়। সরকার হজের লাইসেন্স দিয়েছে। এই দায়িত্ব সরকারের। তারপরও আমরা বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখি। গেল বছর দেখবেন, অনিয়ম অনেক কমে গেছে। আপনি যদি গ্লাসের মধ্যে পানি নেন সব পানি একসাথে খেতে পারবেন না।
কিঞ্চিত পরিমাণ থেকে যায়। ইচ্ছা করে কোনো এজেন্সি অসৎ উপায় অবলম্বন করার প্রমাণ পায়নি আজ পর্যন্ত। আমি দেখেছি, এজেন্সি মালিকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন হাজীদের সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশের মধ্য দিয়ে হজ পালন করার জন্য। তার পরও চলার পথে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটতে পারে, সেটি অবশ্যই মার্জনীয়। সেই জটিলতা অনেকাংশে কমেছে বলে আমি মনে করি। ২০১৭ সালে আমি নির্বাচিত হওয়ার পর যে সমস্যা ছিল, তার থেকে ২০১৮ সালে আরো কমে গেছে। আশা করি, এই ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে ধীরে ধীরে হাজীদের যে সমস্যা আছে, অচিরেই সমাধান হবে। এজেন্সির মালিকেরাও নিরাপদে ব্যবসা করতে পারবেন।
অনেকে বলে থাকেন, হজ ক্রমেই ব্যবসায়িক রূপ নিচ্ছেÑ বিষয়টি সত্য নয়। সরকার পত্রপত্রিকায় প্রচারের মাধ্যমে নানাভাবে হাজীদের সতর্ক করছে। আর বর্তমানে আমাদের দেশে ই-হজের সিস্টেম চালু হয়েছে। তাতে আপনারা হজের রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সাথে সাথে আপনার মোবাইলে মেসেজ চলে যাচ্ছে। আপনি যদি মেসেজ পড়ে দেখেন আপনার রেজিস্ট্রেশন হয়েছে কি না, ঠিকমতো আপনার কাগজপত্র আছে কি নাÑ তাহলে হাজীদের কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। বর্তমানে সরকারও এই সিস্টেম চালু করে দিয়েছে। ই-সিস্টেমের মাধ্যমে হাজীরা অনেকটা পরিত্রাণ পেয়েছেন। আর যদি সরাসরি আপনি এজেন্সি মালিককে টাকা না দিয়ে ইমাম সাহেবকে টাকা দিয়ে দেন, সেই টাকার দায়দায়িত্ব তো আমার এজেন্সি বহন করতে পারে না। এ ব্যাপারেও আমরা হাজীদের সতর্ক করার জন্য নানা কর্মসূচি পালন করি। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেই, মেসেজ দেই, হজ ও ওমরাহ মেলা এবং সেমিনার করছি। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে, যেটা কখনো হতো না, গত বছর থেকে চালু হয়েছে।
হজযাত্রী পরিবহনের ব্যাপারে হাবের সভাপতি বলেন, হজযাত্রী পরিবহনে সৌদি এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমানের বাইরে আরো বিমানকে সুযোগ দেয়ার দাবি, অর্থাৎ থার্ড ক্যারিয়ার থেকে আমরা সরে আসিনি। আমরা একা তো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। এটা সৌদি সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। সেখানে একটি ক্লজ লেখ আছে, ন্যাশনাল ক্যারিয়ার সৌদিয়া ৫০ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ন্যাশনাল ক্যারিয়ার ৫০ শতাংশ বহন করতে পারবে। অন্য কেউ পারবে না। আমরা বারবার এটার জন্য প্রস্তাব করেছিলাম। যেহেতু সৌদি এয়ারলাইন্স এবং বিমান দু’টি ন্যাশনাল ক্যারিয়ারে যে ভাড়া নিচ্ছে তা অত্যন্ত বেশি, সে জন্য আমরা বারবার প্রতিবাদ করেছিলাম। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এ বছর ১০ হাজার টাকা বিমান ভাড়া কমেছে। এই ভাড়া আরো কমানোর জন্য বিশেষ করে এক লাখ টাকার নিচে করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
হজযাত্রীদের ভোগান্তি লাগবে সর্বশেষ পদক্ষেপ সৌদি আরবের জেদ্দা হজ টার্মিনালের ইমিগ্রেশন বিমানে ওঠার আগে ঢাকায় সম্পন্ন করার বিষয়ে আবদুস ছোবহান ভূঁইয়া বলেন, হজ ব্যবস্থাপনায় প্রি-ডিপারচার ইমিগ্রেশনের বিষয়টি আমাদের পক্ষ থেকে আলোচনায় ছিল। সরকারেরও ভূমিকা ছিল। আমাদের দেশের হাজীরা বয়স্ক হাজী। ওখানে গিয়ে তাদের ৭-৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ জন্য প্রথমবারের মতো সৌদি দু’টি টিম এসেছে। প্রথম টিম ইনভেস্টিগেশন করে গেছে। দ্বিতীয় টিমও আসছে। এ বছর আমরা আশা করছি, ডেডিকেটেড ফ্লাইটগুলোর ইমিগ্রেশন ঢাকায় হবে। বাকি ফ্লাইটগুলো সৌদি আরবে হবে। এতে হজযাত্রীরা সৌদি আরবে গিয়ে ইমিগ্রেশনের কষ্ট থেকে রেহাই পাবেন।
এখন যাত্রার আগে আবারো ৭-৮ ঘণ্টা অপেক্ষার ভোগান্তি পোহাতে হবে কি নাÑ জানতে চাইলে হাব সভাপতি বলেন, সৌদি আরবে ৭-৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় বলেই ঝটিকা ইমিগ্রেশনের জন্য এই চেষ্টা। ফলে বাংলাদেশ অংশে আশা করি দ্রুতই ইমিগ্রেশন হবে। এই অংশে দীর্ঘ সময় আগাম ইমিগ্রেশন করতে লাগবে না।
হজযাত্রীর সচেতনতার বিষয়ে বিদায়ী হাব সভাপতি বলেন, যারা হজ করতে যাচ্ছেন, তাদের মনে রাখতে হবে হজ মানে কষ্ট, যখন ওখানে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটে। মিনা, আরাফার ময়দান, মুজদালিফা, জামরাতে পাথর মারাÑ এ কাজগুলো অনেক কঠিন। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের হাজীরা অত্যন্ত বয়স্ক, ৬০-৭০ বছর বয়সী, যা তাদের জন্য কষ্টদায়ক। আর একটা এজেন্সির গত বছর ছিলেন সর্বনিম্ন ১৫০ জন হাজী। একটা এজেন্সির জন্য ১৫০ জন হাজী কন্ট্রোল করা দুরূহ ব্যাপার। তার পর এ বছর থেকে সর্বনিম্ন ১০০ জন করা হয়েছে। আর ওখানে কাউকে সাহায্য করার মতো অবস্থা কিন্তু থাকে না। হজযাত্রীদের ধৈর্যশীল হতে হবে, সতর্কতার সাথে হজ পালন করতে হবে, হাজীরা যদি সরাসরি এজেন্সি মালিকদের সাথে যোগাযোগ করেন, রসিদের মাধ্যমে লেনদেন করেন; তা হলে আমরা আমরা মনে করি, অনেকটা আমাদের নিরাপত্তা এসে যাবে। হজ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আসবে। আশা করি, এটি ৮০-৯০ শতাংশ হয়ে গেছে। বাকি ১০ শতাংশ রয়েছে। এটি আগামী দিনগুলোতে সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হয়ে যাবে।
নিজের সফলতার ব্যাপারে তিনি বলেন, হাবের সভাপতি হিসেবে আমার সফলতা বলতে গেলে বলতে হয়, হজযাত্রীদের ট্রলি ব্যাগের একটি বিড়ম্বনার বিষয় ছিল। এটা নিয়ে এক ধরনের ব্যবসার প্রবণতা ছিল, সেটা আমরা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। হজ এজেন্সি প্রতি ১০০ জনের কোটা, সেটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি এবং রিপ্লেসমেন্টের যে বাণিজ্য হতো, সেটা অনলাইনের মাধ্যমে সরাসরি করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। সরকারি কোটার অবশিষ্ট যে হাজী ছিলেন, সেগুলোকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। হাবের যে দুর্নীতি ছিল, সেগুলো দূর করতে শুধু আমি নই আমার কমিটির সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছিলাম। এই কাজের ফসল হিসেবে এটা বস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি মনে করি, গত দুই বছরে আমরা হাবকে ৯৯ শতাংশ দুর্নীতিমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি।
আসন্ন নির্বাচনে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার বিষয়ে আব্দুস ছোবহান ভূঁইয়া বলেন, আমি নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম। প্রার্থীও হয়েছিলাম। কিন্তু পরে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে আমার মনোনীত হাব গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছি। আগামী ২৫ এপ্রিল হাবের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আমার প্রার্থী না হওয়ার কারণ সংক্ষেপে আমি এটুকু বলতে চাই, আমি যেহেতু দলটাকে পছন্দ করি। দলীয়ভাবে আমার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আসছে নির্বাচন না করার জন্য। আমি দলকে ভালোবাসি, দলনেত্রী শেখ হাসিনাকে ভালোবাসি। তার নির্দেশ যদি এসে থাকে তারা বলেছেন। সেই নির্দেশকে সম্মান দিতে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। যেহেতু আমি একটি প্যানেলকে নিয়ে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, প্রস্তুতি মিটিংও করেছি কয়েকবার। যেহেতু আমি নিজে করতে পারছি না, আমার দলের লোকেরা করছে। তাদের জন্য যদি প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন না করি, তাহলে তাদের কাছে আমি রাজনৈতিকভাবে হেরে যাবো। সে জন্য আমি আমার লোকজন নিয়ে এখন মাঠে আছি। আমি শতভাগ আশাবাদী, এই প্যানেল আমার মনোনীত প্যানেল। আমি যাদেরকে মনোনীত করেছি, নিশ্চয়ই আমার কথা শুনবে। আমার এখানে দিকনির্দেশনা থাকবে। সেই দিকনির্দেশনা মোতাবেক তারা কাজ করবেÑ এই বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে তাদেরকে আমি প্যানেল দিয়েছি। আমি আমার প্যানেলের বিজয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী।
হাবের নতুন নেতৃত্বের প্রতি কী উপদেশ থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হজ ব্যবস্থাপনায় মেজর যেসব সমস্যা ছিল, সেগুলো সমাপ্তির পথে। তার পরও কিছু কাজ আছে। যেমন হজযাত্রীপ্রতি ৫০ রিয়াল করে এজেন্সি মালিকেরা সরকারের কাছে পাওনা আছেন, সেই টাকা সরকারের ফান্ডে আছে। সেই টাকাগুলো এজেন্সি মলিকেরা কিভাবে পেতে পারেন সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর যারা মোনাজ্জেম হিসেবে যান, তাদের সর্বোচ্চ ছয় মাস না হলেও অন্তত তিন মাস প্রথম ফ্লাইট থেকে শেষ ফ্লাইট পর্যন্ত থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য ব্যবস্থা করা যায়। সততার সাথে হাবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। হজ ব্যবস্থাপনা খুবই জটিল কাজ। আল্লাহর মেহমান হাজীদের সেবার দিকটি মাথায় রেখে অতি ব্যবসায়িক মনোভাব পরিহার করে সেবার মানসিকতায় হজ এজেন্সিগুলোকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। হ

 

 


আরো সংবাদ



premium cement