২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মুসলমানমাত্রই কাবা দেখার আজন্ম ইচ্ছা লালন করেন

-

শারীরিক ও আর্থিক দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর হজ ফরজ হলেও হজ পালনের আকাক্সক্ষা লালন করেন সবাই। মুসলমানমাত্রই বায়তুল্লাহ তথা আল্লাহর ঘর কাবাঘর নিজ চোখে দেখা এবং সেই ঘর তাওয়াফের তীব্র বাসনা পোষণ করেন। যে কাবাঘরের দিকে মুখ করে প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন সেই ঘরকে সরাসরি সামনে রেখে নামাজ আদায় এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে নিজেকে সমর্পণ, তাঁর ঘরের সামনে বসে তাঁরই কাছে প্রার্থনার অনুভূতিই আলাদা! এজন্য অনেকে হজে যাওয়ার জন্য অর্থ সঞ্চয়ও করেন। অবশেষে আজন্ম লালিত ইচ্ছার বাস্তব রূপ দিতে হজে গমন করেন।
হজে যাওয়ার পর তার মুুখের অন্যতম ভাষা হয়ে দাঁড়ায়- ‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক...’ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি তোমার দরবারে হাজির...! এভাবে একজন হাজী কাবা শরিফ তাওয়াফ, সাফা মারওয়া সাই, মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দানে অবস্থানসহ অন্যান্য কার্যাদির মাধ্যমে হজ পালন করেন। এভাবেই তার আজন্ম লালিত বাসনা পূরণ করেন। নিজেকে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ করার আধ্যাত্মিক দীক্ষা নিয়ে ফেরেন।
যার ওপর শরিয়ত অনুযায়ী হজ ফরজ হয়ে দাঁড়ায় না তিনিও হজ পালন করতে পারেন। যেভাবেই হোক কেউ হজ পালন করলে সেটা আদায় হবে এবং ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে সেই অবস্থায় সেটা নফল হিসেবে আদায় হবে। তা ছাড়া যারা একাধিকবার হজ পালন করেন তাদের ক্ষেত্রেও বাকিগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।
হজ ফরজ। ইসলামের পাঁচটি রোকন বা স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম। নবী করীম সা: থেকে এ পর্যন্ত হজ ফরজ হিসেবে পালন হয়ে আসছে। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী হজ অস্বীকার কিংবা একে অন্য নামে আখ্যায়িত করা কুফরি।
কাবাঘর জিয়ারাতের মাধ্যমে হজ পালনের নিয়ম আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। ইসলামে হজ ফরজ হওয়ার আগে ভিন্ন যুগে বিভিন্ন নিয়মরীতিতে হজ পালিত হয়েছে। রাসূল সা:ও আগে কোরাইশদের রীতি অনুযায়ী হজ পালন করেছেন বলে কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়।
ইসলামে হজ কখন ফরজ হয় তা নিয়ে ইমামদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ আছে। আলেমদের একটি অংশের মতে, রাসূল সা:-এর হিজরতের আগেই হজ ফরজ হয়। তবে পরিবেশ না থাকায় তখন সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। বেশির ভাগ ইসলামী বিশেষজ্ঞের মতে, হিজরতের পরে হজ ফরজ হয়। হিজরতের পর কখন ফরজ হয় তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে।
নেসাব পরিমাণ মালের অধিকারীর ওপর যেমন জাকাত ফরজ তেমনি হজে যাওয়ার আর্থিক ও শারীরিক ক্ষমতা রাখেন এমন প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাধীন মুসলমানের ওপর একবার হজ করা ফরজ। নামাজ রোজার মতো সবার ওপর হজ ফরজ নয়।
হজ ফরজ হওয়া মাত্র আদায় করতে হবে নাকি দেরিতে অর্থাৎ সুবিধাজনক সময় আদায় করা যাবেÑ এ নিয়েও ইসলামী শরিয়ত বিশেষজ্ঞ তথা ইমামদের দুই ধরনের মত রয়েছে।
প্রথম মত হচ্ছে : হজ ফরজ হওয়ার সাথে সাথে আদায় না করে দেরিতে আদায় করার অবকাশ আছে। এই মত দিয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, শাফেঈ, সুফিয়ান সওরি।
দ্বিতীয় মত : হজ ফরজ হওয়ার সাথে সাথেই আদায় করতে হবে। ইমাম মালিক, আহমদ, আবু ইউসুফ এই মত দিয়েছেন।
হজে আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যের প্রকাশ ঘটে। হজ পালনের পুরো বিষয়ের সাথেই আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য প্রকাশ এবং তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। হজযাত্রীর হজে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের পর থেকেই তার মধ্যে আল্লাহর ঘর দর্শন ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের তীব্র আকাক্সক্ষাজনিত আবেগ সৃষ্টি হয়। যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পবিত্র কাবা দর্শনের পর সেই আবেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আল্লাহর কাছে নিজের উপস্থিতির জানান দিতে তিনি উচ্চারণ করেনÑ ‘লাব্বায়িক আল্লাহুমা লাব্বায়িক...।’
হজ পালনে একনিষ্ঠতার জন্য হজের উদ্দেশে রওনা দেয়ার পর থেকেই হজ পালনেচ্ছু ব্যক্তিকে বিশেষ পোশাক পরিধান করতে হয়। কিছু বৈধ কাজ থেকেও তাকে বিরত থাকতে হয়। শরিয়তের পরিভাষায় যাকে ‘ইহরাম’ বলা হয়। মক্কার চারদিকে বিভিন্ন এলাকার মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কিছু স্থান চিহ্নিত করা আছে যেগুলো পার হওয়ার আগে হাজীদের অবশ্যই ইহরাম বাঁধতে হয়। বর্তমানে হাজীরা বিমানে যাতায়াত করে থাকেন বলে নিজ নিজ দেশ থেকে রওনা হওয়ার সময়ই ইহরাম বেঁধে ফেলেন।
নামাজের জন্য শুরুতেই তাকবির-ই তাহরিমা যেমন জরুরি তেমনি হজের শুরুতে ইহরামও জরুরি। সাধাণরত হাজীরা ইহরাম বাধার পর বেশি করে দরুদ ও ইস্তিগফার এবং উচ্চৈস্বরে তালবিয়া পাঠ করেন। তালবিয়ার এই অংশ বেশি পড়া হয়Ñ ‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লা শারিকালাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিঈমাতি লাকা ওয়াল মুলকা লাকা লা শারিকালাকা।’ অর্থাৎÑ হে আল্লাহ, আমি তোমার দরবারে উপস্থিত! আমি তোমার দরবারে উপস্থিত! তোমার কোনো শরিক নেই। আমি তোমার দরবারে উপস্থিত! যাবতীয় প্রশংসা ও নিয়ামাত তোমারই। আর রাজত্বও তোমার, তোমার কোনো শরিক নেই। এসব শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বান্দার আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও দাসত্ব প্রকাশ পায়। এসব বাক্য বারবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে অন্তরে সে ভাব উদিত হতে থাকে।
মূলত হজের জন্য পা বাড়ানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা পর্যন্ত পোশাক-আশাক, কথা-কাজ চিন্তা-চেতনায় সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তাঁর প্রতি বিনয়াবত হওয়ার প্রকাশ ঘটে। যা হজের পরেও হাজীদের বাস্তব জীবনে কম বেশি প্রতিফলন ঘটে।

হজের বহুবিদ উপকারিতা
হজকে মিশ্র ইবাদাত বলা যায়। এতে শারীরিক শক্তি ও অর্থ ব্যয় দুটিরই প্রয়োজন হয়। ইসলামে হজের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিম জাতির সর্ববৃহৎ সম্মেলন হলো হজ। মুসলিম জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ঐক্য এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ সৃষ্টির প্রকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে হজ।
ইসলামে হজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদাত। হাদিস শরিফে হজের ব্যাপারে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন : ‘মাবরুর (কবুল) হজের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়’ (বোখারি)।
‘যে হজ করল ও শরিয়ত অনুমতি দেয় না এমন কাজ থেকে বিরত রইল, যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এলো’ (বোখারি)।
‘আরাফার দিন এত সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য কোনো দিন দেন না। এদিন আল্লাহ তায়ালা নিকটবর্তী হন ও আরাফার ময়দানে অবস্থানরত হাজীদের নিয়ে তিনি ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন, ও বলেন ‘ওরা কী চায়?’ (মুসলিম)
সর্বোত্তম আমল কী এ ব্যাপারে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে বললেন, ‘অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তারপর মাবরুর হজ যা সব আমল থেকে শ্রেষ্ঠ। সূর্য উদয় ও অস্তের মধ্যে যে পার্থক্য ঠিক তারই মতো’ (আহমদ)।
অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘উত্তম আমল কী এই মর্মে রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হলো। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হলো, ‘তারপর কী’? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। বলা হলো তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মাবরুর হজ’ (বোখারি)। ‘হজ ও উমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। তারা যদি আল্লাহকে ডাকে আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দেন। তারা যদি গুনাহ মাফ চায় আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন (ইবনে মাজাহ)। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এক উমরা হতে অন্য উমরা, এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয় (বোখারি)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কারো ইসলাম গ্রহণ পূর্বকৃত সব পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সব গুনাহ মুছে দেয় ও হজ তার পূর্বের সব পাপ মুছে দেয়’ (মুসলিম)।
ইসলামের অন্যতম বিধান হজ পালিত হবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর। হজ পালনের জন্য ইতিমধ্যেই মক্কার পবিত্র ভূমিতে পৌঁছে গেছেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য রাত দিন তাওয়াফ আর ইবাদাত বন্দেগির মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছেন সমবেত মুসল্লিরা। তাদের লক্ষ্য কাবা শরিফ। উদ্দেশ্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ও সন্তুষ্টি অর্জন।
নির্দিষ্ট দিনে আনুষ্ঠানিক কিছু কার্যাদি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে হজ পালিত হয়। হজ পালন করে মুসলমানেরা এক দিকে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন, অন্য দিকে আল্লাহর পথে আরো দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠভাবে চলার জন্য মন স্থির করেন এবং বাস্তব শিক্ষা অর্জন করেন। সেজন্যই হজ পালন করে আসার পর মুসল্লিদের মধ্যে ইবাদাত-বান্দেগির প্রতি ঝোঁক বেশি লক্ষ করা যায়। যথাসম্ভব শরিয়ত অনুযায়ী জীবনযাপনের চেষ্টা করতে দেখা যায়।
আল্লাহ তায়ালা বান্দার ওপর নামাজ, রোজা, জাকাত, হজের মতো কিছু বিধান পালন বাধ্যতামূলক করে দিলেও এসবের মাঝে বান্দাহর জন্য বহুবিদ উপকারিতা রেখেছেন। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বাধ্যতামূলক কাজ মুসলমানদের তার আসল কাজ তথা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁরই সব আদেশ নিষেধ পালন করার উপযোগী করে তোলে। বিশেষ করে মানুষ যাতে জীবনের কোনো অবস্থায় আল্লাহকে ভুলে না বসে, তার পথ থেকে দুরে সরে না যায় তার জন্যই এসব আনুষ্ঠানিক কাজকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এ ধরনের ফরজ ইবাদাতকে কেউ কেউ বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ বলে মত দিয়েছেন।
বাস্তবেও নামাজ রোজা হজের মতো বিধানসমূহের যাবতীয় কার্যাদির দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাই মনে হয়। প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, শারীরিক সক্ষমতা অর্জন এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন দিকের প্রভাব লক্ষ করা যাবে। তাই হজ পালনের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের এর আনুষ্ঠানিকতার সাথে সাথে অন্তর্নিহিত শিক্ষাগুলোর প্রতিও নজর দেয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার
দৈনিক নয়া দিগন্ত

 


আরো সংবাদ



premium cement