১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হজ যেভাবে পালিত হয়

-

হজ একটি ফরজ আবশ্যকীয় ইবাদত। একাধিকবার হজ করলে পরেরগুলো নফল হিসেবে গণ্য হয়। হজের বিধান সবার জন্যই একই এবং এই বিধানগুলো পালন কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। যদিও তা গতানুগতিক অন্য কোনো বিষয়ের আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে অনেক ভিন্ন। হজের কার্যক্রমে প্রত্যেক আনুষ্ঠানিকতা পালনে হাজীদের আবেগ, অনুভূতি, আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণের এক অন্যরকম স্বর্গীয় বিষয় কাজ করে। হজের মূল কাজগুলোর সাথে শারীরিক পরিশ্রমের বিষয় জড়িত।
পুরুষের জন্য সেলাইবিহীন দুই খণ্ড সাদা কাপড় পরিধানের মধ্য দিয়ে ইহরাম বাধা, মক্কায় পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ, সংলগ্ন সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে দৌড়ানো বা সায়ি করা এবং মক্কার অদূরে অবিস্থত মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা নামক ময়দানগুলোতে অবস্থান, মিনায় অবস্থিত মক্কাপ্রান্তে জামারাহ বা পাথরে প্রতীকী কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানি করা এবং মাথা মুণ্ডনের মতো কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে হজ পালিত হয়। হজের প্রকারভেদের কারণে কিছু কিছু হাজীর ক্ষেত্রে কোরবানি, দম প্রদান ও ইহরাম বাঁধার আলাদা বিধান রয়েছে।
৯ জিলহজ মক্কার অদূরে আরাফার ময়দানে অবস্থানের দিনকে হজের দিন বলা হলেও হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় ৮ জিলহজ থেকে। আর শেষ হয় ১২ বা ১৩ জিলহজ। মূলত এগুলোই হজের দিন এবং এই দিনগুলোর সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আর বাংলাদেশের সরকার ও এজেন্সির লোকজন সহায়কের ভূমিকায় থাকে তখন।
উপরোক্ত হজের দিনগুলোর আগে ও পরে মদিনা সফর করে রাসূল সা:-এর রওজা জিয়ারত, মসজিদুল হারামাইনে নিয়মিত জামাতের সাথে নামাজ আদায়, মক্কা মদিনায় রাসূল সা:, সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শনও করে থাকেন হাজীরা। সরকারি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকার ও সৌদি সরকারের নির্ধারিত নিয়ম মেনে সৌদি আরবে যাওয়ার পর সৌদি মোয়াল্লেমের নিয়ন্ত্রণে হাজীরা হজের জন্য নির্ধারিত দিনগুলোতে হজ সম্পাদন করেন। সৌদি আরবে পৌঁছার পরই হাজীদের পাসপোর্ট সৌদি মোয়াল্লেমরা নিয়ে নেয়। পরিবর্তে যাবতীয় তথ্যসংবলিত পরিচয়পত্র ও ডিজিটাল কবজি বেল্ট দেয়।
বিমানে হজযাত্রীদের নেয়ার পর দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত হজের নির্ধারিত ৮ থেকে ১২-১৩ জিলহজের দিনগুলো বাদ দিয়ে বাকি দিনগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের মক্কা-মদিনায় হোটেল বা বাড়িতে থাকা খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। গাইডদের তত্ত্বাবধানে ইবাদত-বন্দেগি ও দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখানো হয়। গাইডরা হজের দিনগুলোতেও হজ কার্যাদি সম্পাদনে গ্রুপভিত্তিতে হাজীদের সহায়তা করে থাকেন। হাজীরা দেশে ফেরার সময় সৌদি মোয়াল্লেমের জিম্মায় থাকা পাসপোর্ট ফেরত পান। বিমান সংস্থা সীমাবদ্ধ থাকার কারণে হাজীদের সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত মক্কা মদিনায় অবস্থান করতে হয়। বিমানের আসা যাওয়ার টিকিট একসাথেই করতে হয়। এতে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সের ফিরতি টিকিট এ সময়ের আগে দিতে পারে না।
হজের মূল দিনগুলোতে যা করতে হয় হাজীদের : শুধু হজের দিনগুলোতে ইহরাম বেঁধে হজের কাজ সম্পাদন করা একধরনের হজ। এই হজকে কিরান বলে। আবার হজ ও ওমরাহর জন্য ইহরাম বেঁধে ওমরাহ পালন করে একই ইহরামে হজের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে হজের দিনগুলো এলে ওই ইহরামে হজের দিনগুলোতে হজের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করাকে কিরান হজ বলে। আর প্রথমে ওমরাহর জন্য ইহরাম বেঁধে মক্কায় গিয়ে প্রথমে ওমরাহ পালন করে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করে ইহরাম ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে হজের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করা এবং হজের দিনগুলোর দিন আবার নতুন করে ইহরাম বেঁধে হজের দিনগুলোতে হজের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করাকে তামাত্তু হজ বলে। আবার ইহরাম বাঁধার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে আসা মানুষের জন্য আলাদা আলাদা এলাকা রয়েছে। ওই সব এলাকা অতিক্রম করার আগে ইহরাম বাঁধতে হয়, এমনকি সৌদি আরবে যারা অবস্থান করেন তাদেরও বিভিন্ন দিক থেকে আসার ক্ষেত্রে ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত জায়গা রয়েছে; এমনকি যারা মক্কায় রয়েছে তাদের বাসাবাড়িতে ইহরাম বাঁধতে পারেন। এভাবে হজের কার্যাদি সমাপ্ত করবেন।
শরিয়তের বিধান অনুযায়ী স্থানীয় অর্থাৎ সৌদি আরবের হিজরি মাস গণনা অনুযায়ী ৮ জিলহজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে, গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহার করে ইহরাম বেঁধে মিনার তাঁবুতে অবস্থান গ্রহণ করা এবং পরবর্তী দিনগুলোতে হজের কার্যাদি করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তবে ভিড় সামাল দেয়ার জন্য সৌদি মোয়াল্লেমরা সরকারি সিদ্ধান্তে ৭ জিলহজ সন্ধ্যা থেকেই হাজীদের মিনার তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। একইভাব ৯ জিলহজ যেহেতু আরাফার ময়দানে অবস্থানে দিন সেহেতু ভিড় এড়াতে একইভাবে ৮ জিলহজ রাত থেকেই হাজীদের আরাফার ময়দানে নেয়া শুরু করেন। কিন্তু মূল নিয়ম হচ্ছে ৮ জিলহজ মিনায় গিয়ে তাঁবুতে অবস্থান করে পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা, হজের মাসলা মাসায়েল শেখা ও সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা।
হাজীদের জন্য ৮ জিলহজ ‘ইয়াওমুল মিনা’ হিসেবে পরিচিত। মিনা থেকে আরাফার ময়দানে যাওয়া, মুজদালিফায় রাত কাটানো এবং তার পরের দুই বা তিন দিন মিনায় জামারায় পাথর নিক্ষেপের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। নিজ অবস্থানে থেকে ইহরাম বাঁধবেন। তার পর দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে মিনার দিকে রওনা হবেন। ৮ জিলহজ ফজরের নামাজ পড়েই মিনায় রওনা হওয়ার নিয়ম। ওই দিনের বাকি চার ওয়াক্ত নামাজ এবং পরের দিনের ফরজ নামাজ মিনাতেই পড়তে হয়। ৯ জিলহজ হজের দিন। এ দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে হয়। সে জন্য এ দিনকে ‘ইয়াওমুল আরাফা’ বলা হয়। এ দিনই মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আরাফার ময়দানে উপস্থিত হতে না পারলে হজ আদায় হয় না। এটি হজের অপরিহার্য করণীয়। এই আরাফার ময়দানেই রাসূল সা: বিদায় ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ঐতিহাসিক ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত। আরাফার দিনে জোহরের সময় জোহর আসরের নামাজ একই সাথে পরপর কসর আদায় করা হয়। ইমাম মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেন। বিশ্ব মুসলিমের জন্য দিকনির্দেশনা দেন, দোয়া করেন।
আরাফার ময়দান দোয়া কবুলের জায়গা। এখানে হাজীদের দুই হাত উঁচিয়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহর দরবারে গুনাহ মাফ এবং তার সান্নিধ্য লাভের আকুতি জানান সন্ধ্যা পর্যন্ত। হাজীদের অশ্রুসিক্ত কান্নার রোলে পুরো ময়দানে এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যায় প্রশাস্ত মন নিয়ে আরাফা ত্যাগ করেন হাজীরা।
আরাফার ময়দানে অবস্থানের পর দিনের শেষে সূর্যাস্তের পর মুজদালিফা নামক স্থানে চলে যেতে হয়। রাতে সেখানে অবস্থানের পর ফজরের নামাজ শেষে ১০ জিলহজ মিনার দিকে রওনা দিতে হয়। মিনায় ওই দিন জামারাহ বা নির্দিষ্ট পাথরে কঙ্কর নিক্ষেপ এবং কোরবানি করতে হয়। এ দিনই হজের স্মারক হিসেবে ঈদুল আজহা পালন করা জয়। মিনায় কোরবানি করার পর হাজীরা মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছোট করে ইহরাম ভেঙে ফেলেন। এরপর হাজীরা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ সব কাজ করতে পারেন। এরপর কাবাঘর তাওয়াফ করার জন্য তাদের কিছু সময়ের জন্য মক্কায় যেতে হয়। এর নাম তাওয়াফে জিয়ারাত। প্রথমে মক্কা যাওয়ার পরই হাজীরা মক্কায় প্রবেশ করেই একবার তাওয়াফ করেন, যা তাওয়াফে কুদম নামে পরিচিত। আবার মক্কা থেকে ফিরে আসার সময় আরেক বার কাবা শরিফ তাওয়াফ করেন, যাকে তাওয়াফে বিদা বলা হয়। হজের দিনগুলোতে মাথা মুণ্ডনের পর এ তাওয়াফ ১২ জিলহাজ তারিখের যে কেনো সময় করা যায়। এরই মধ্যে কাবা শরিফ সংলগ্ন সাফা-মারওয়া নামক পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সায়ি (দৌড়ানো) করতে হয়। যারা ১২ জিলহজ মিনার তাঁবুতে থেকে যান তাদের ১৩ জিলহজও জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করে তবেই মিনা ত্যাগ করতে হয়। ১৩ জিলহজ হজের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটে।
হজের যাবতীয় কাজের মধ্যেই তাকবির, তালবিয়া, নফল নামাজ প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করেন হাজীরা। হাজীরা ৭ বা ৮ জিলহজ ইহরাম বাঁধার পরই তালবিয়া পাঠের মধ্যেই থাকেনÑ লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক। ৯ জিলহজ পুরো আরাফার ময়দান লাব্বাইক ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ১২-১৩ জিলহজের পর তুলনামূলক আগে যাওয়া হাজীরা তাদের ফিরতি বিমান টিকিটের সময় অনুযায়ী নিজ নিজ দেশে ফেরা শুরু করেন। বাকিরা মক্কা মদিনায় ইবাদত-বন্দেগি ও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার মধ্য দিয়ে দেশে ফেরার তারিখের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। হজে মারুর যার ভাগ্যে জেটে হাদিস শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি নিষ্পাপ শিশুর মতো হয়ে ফেরেন।
হজ ব্যবস্থাপনা দেখাশোনার জন্য জেদ্দা হজ টার্মিনালে বাংলাদেশ প্লাজা, মক্কা ও মদিনায় হজ মিশন রয়েছে। হজের সময় হজযাত্রীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য চিকিৎসক দল, আইটি সেবা দেয়ার জন্য আইটি দল এবং অন্য সেবা দেয়ার জন্য সহায়ক দল ও প্রশাসনিক দল সৌদি আরব গমন করেন। থাকেন মওসুমি হজ কর্মকর্তাও। সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি হজযাত্রীদের দেখা শূরা ও অভাব অভিযোগের সমাধান করে হজ মিশনসহ সরকারি প্রশাসনিক দল।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক নয়া দিগন্ত

 


আরো সংবাদ



premium cement
মাতৃভূমি রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য : সেনাপ্রধান ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সাথে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ১ হাজার টাকার জন্য পেশাদার ছিনতাইকারীরা খুন করে ভ্যানচালক হারুনকে দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় : মতিউর রহমান আকন্দ টানা ১১ জয়ে ডিপিএলের প্রথম পর্ব শেষ করলো আবাহনী দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের অংশ নিতে মানা সবল-দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে? জনগণের শক্তির কাছে আ'লীগকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় মেরিনা তাবাসসুম বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল কাদের

সকল