২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

শ্রাবণী

-

ছোট্ট খুকি শ্রাবণী। সকাল থেকে পড়ার টেবিলে বসেনি। জোর করে তাকে পড়ানোর উপায় নেই। পড়তে যখন মন চায়Ñ তখন সে বেশ মনোযোগী। শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি। হোম ওয়ার্ক নেই, তাই পড়ার জন্য বাড়তি চাপও নেই। এ জন্যই সুযোগ নিচ্ছে শ্রাবণী। সকালের নাস্তা-পর্ব সেরেছে কিছুক্ষণ আগে। তার ইচ্ছে খেলাধুলা করবে। কী খেলবে বুঝে ওঠার আগেই আবার জামা পাল্টাচ্ছে। সকাল থেকে এ নিয়ে তিনবার। এবারের জামাটা একটু লম্বা। জামা পরেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথার চুল খাটো। হঠাৎ যেন কী বুদ্ধি খেলেছে মাথায়, তাই তড়াক করে ছুটে আসে আলনায়। সোনালি রঙের একটি ছোট্ট ওড়না মাথায় জড়িয়ে পিঠের ওপর চুলের মতো ঝুলিয়ে দিয়েছে। তারপর তাতে একটা রাবার-বেন এমনভাবে আঁটকায়, মনে হয় যেন মাথার চুল বেঁধেছে।
ড্রেসিং টেবিলে রাখা কিছু প্রসাধনী লাগিয়েছে মুখে। তারপর চোখে চশমা পরে বারবার আয়নার দিকে তাকায়। এক ফাঁকে পাশের টেবিল থেকে একটা খাতা হাতে নেয়। ভাইয়া তখন পড়ার টেবিলে। পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই ভাইয়ার ওপর রাজ্যের পড়ার চাপ। শ্রাবণী তো কেবল নার্সারিতে। ভাইয়া পড়ার টেবিল থেকে দেখে, শ্রাবণী সাজগোজ করে স্কুলের শিক্ষিকা সেজেছে। তাই এবার ভাইয়া হাঁক ছেড়ে বলে, স্কুলের ম্যাডাম নাকি?
-হ্যাঁ।
-তা কই যাচ্ছেন আপনি?
-ক্লাসে যাচ্ছি।
-কোন ক্লাসে যাবেন ম্যাডাম?
-নার্সারিতে।
-আপনার ক্লাসে ছাত্র ক’জন?
-একজন।
-কী নাম ছাত্রের?
-ছাত্র না তো। ছাত্রী। নাম কুলসুম।
-ও তাই বলুন। কুলসুম তাহলে আপনার ছাত্রী। ম্যাডামকে আবার তুমি তো বলা যায় না। তাই আপনি বলছি।
-হুম।
রাশভারী গলায় শব্দটা উচ্চারণ করে শ্রাবণী তখন শ্রেণী শিক্ষকের মতো অনুকরণ করে ডাকে, কুলসুম! কই তুমি? তাড়াতাড়ি আসো। ক্লাসের সময় চলে যাচ্ছে তো।
-এই যে আইতেছি।
এই বলে কিশোরী কাজের মেয়ে তার দু’ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে শ্রাবণীর কাছে আসে। বলে, অহনই কি পড়া লাগব? আমার যে কাম আছে।
-কাজ পরে হবে। আগে পড়া।
এ কথা বলেই শ্রাবণী কিশোরী কাজের মেয়ে কুলসুমকে টেনে নিয়ে পড়তে বসায়। যে পড়াগুলো শ্রাবণী ইতোমধ্যে ক্লাসে শিখে ফেলেছে, সেগুলেই কুলসুমকে পড়ায়। পড়া শেখানোর পর তাকে লিখতে দেয়। এভাবে সত্যি সত্যিই সে কুলসুমকে অক্ষর জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। পড়ানোর ভঙ্গি ঠিক যেন তার স্কুলের শিক্ষিকার মতো। যেন শ্রেণী শিক্ষকের হুবহু অনুকরণ করে শ্রাবণী। তার পড়ানোর কৌশল আব্বা-আম্মা আড়াল থেকে কিছুক্ষণ দেখে এবং নিঃশব্দে হাসে।
ওদিকে ভাইয়া টেবিলে পড়াশোনা করলেও তার হাত-পায়ে যেন নিস্তার নেই। কোনো না কোনো দুষ্টুমি সে করবেই। শ্রাবণী যখন কুলসুমকে পড়ায় এবং চশমা চোখে দিয়ে বড়দের মতো এদিক-ওদিক তাকায়, তখনি ভাইয়ার মাথায় হঠাৎ একটা দুষ্টুমি চাপে। আচমকা সে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেই শ্রাবণীর মাথায় পরা সোনালি ওড়নায় যে চুলের মতো বেন এঁটেছিল, সেটা ধরে দেয় হেঁচকা টান। অমনি ওড়না ঢিলা হয়ে যায়, আর সে গিয়ে পালায় পাশের ঘরে।
অমনি শ্রাবণী মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ওর কান্না শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে আম্মু। বলে, কী হইছে শ্রাবণী?
-ভাইয়া আমার চুলের বেন নিয়ে গেল ক্যান?
আব্বু এ অভিযোগ শুনে পাশের ঘর থেকে ভাইয়াকে কানে ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে আসে। ভাইয়া হেসে হেসে বলে, সত্যি আমি বেন নিই নাই তো। ওই দেখো মাথায় জড়ানো শ্রাবণীর ওড়নাতেই আছে।
-তুই ওকে কাঁদাতে গেলি ক্যান?
-ও আমার পড়ায় ডিসটার্ব করে ক্যান?
-আহা! এটা তো ওকে বুঝিয়ে বললেই হতো, তাইলেই তো অন্য ঘরে গিয়ে কুলসুমকে পড়াত।
-এ্যাহ! কী শিক্ষকটা সাজছে। তার আবার কুলসুমকে পড়ানো লাগে!
-শোন্। খেলার ছলে কুলসুমকে পড়ালেও সে একটা মহৎ কাজ করছে। কই আমরা তো পারিনি কুলসুমকে অক্ষরজ্ঞান দিতে! কিন্তু শ্রাবণী তো প্রায় তাকে অক্ষরজ্ঞান দিয়েই ফেলেছে। তুই তো কুলসুমকে পড়াতে যাসনি। কিন্তু সে করছে।
বাবার কথা শুনে ভাইয়া থ বনে যায়। আম্মু ততক্ষণে শ্রাবণীকে মেঝে থেকে তুলে তার পাশে দাঁড় করায়। আব্বু স্নেহভরে শ্রাবণীকে কোলে নিয়ে বলে, আমার এ লক্ষী মেয়েটি ভবিষ্যতে এমনই আরো মহৎ কাজ করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।


আরো সংবাদ



premium cement