২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে বাজে রুদ্রবীণায়

-

‘এলো এলো রে বৈশাখী ঝড় এলো এলো রে। ঐ বৈশাখী ঝড় এলো এলো। মহিয়ান সুন্দর এলো এলো, পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর চরাচর থরথর এলো এলো রে॥’
কাজী নজরুলের বৈশাখী গান। বৈশাখীর কথাÑ কালবৈশাখের রূপ বর্ণনা করে এসব গান তিনি রচনা করেছেন। অথচ খুঁজে দেখলে শুধু বৈশাখের রূপ বর্ণনাই নয়, বোশেখ-বন্দনার বাণীও মিলে যায়। রুদ্ররূপ-রসের তালে তালে এই মাসকে স্বাগত জানানোর ভাষা খুবই স্পষ্ট। সুরেও আগমন-ঘণ্টা বাজছে। বাংলা বছরের প্রথম মাস এই বৈশাখ। বাঙালির ঘরে ঘরে বৈশাখের আনন্দধ্বনি বেজে উঠেছে। চৈত্রের তীব্র দাবদাহের পরও তো বৈশাখ আসছে খরতাপের প্রশ্ন নিয়ে। তবে কেন আবার বন্দনা। কবি তার গানের ভেতর দিয়ে সেই দাবদাহের অবসান চেয়ে প্রকৃতির কাছে যেন প্রার্থনা করছেন সেই দহন জুড়িয়ে প্রকৃতিকে শান্ত করে দিতে। প্রকৃতির বাসিন্দারা যে-সব কষ্টে ভুগছে তা যেন জুড়িয়ে ভুুলিয়ে, ডম্বরু বল্লরী ঝাঁঝর বাজিয়ে সব প্রশান্ত করে দেয় প্রকৃতি। বৈশাখ তো প্রকৃতিরই- তো দাও না ভরে ফুলে-ফসলে, সবুজে, নতুন পাতায়। পুরনো ধুলো ধুয়ে মুছে নিয়ে আবার সাজিয়ে দাও তোমার প্রকৃতিকেই।
কাজী নজরুল ইসলাম বৈশাখ মাসের এক গুরুত্ব দিয়েছেন তার বিভিন্ন আঙ্গিকের গানে। কখনো এই মাসের রূপ বর্ণনা করে লিখেছেন,
‘আগের মতো আমার ডালে বোল ধরেছে বৌ।
তুমি শুধু বদলে গেছ, আগের মানুষ নও।’
যত রসালো ফল সব এই মাসেই ফলে। জামরুল, আম, কাঁঠাল, আতা ফল, হিজল ফুল আরো কত ফুল ফল ইত্যাদি এই মাসেই ফুটে প্রকৃতিকে সবুজ-স্নিগ্ধতায় সুবাসিত করে দেয়।
ধূলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে
আমার প্রলয়-সুন্দর এলে॥
পথে পথে ঝরা কুসুম ছড়ায়ে
রিক্ত শাখায় কিশলয় জড়ায়ে,
গৈরিক উত্তরি গগনে উড়ায়ে
রুদ্ধ ভবনের দুয়ার ঠেলে॥

শুদ্ধ সারং রাগে-ত্রিতালের এই গানে তিনি যেন বৈশাখের রূপ বর্ণনা করে কোথায় যেন আবার তাকে ভুলিয়ে রাখছেন তোমাকে বৈশাখী-পূর্ণিমার চাঁদের তিলকে সাজিয়ে দেবো। তাই তো সঞ্চারীটি হলো এ রকমÑ
বৈশাখী পূর্ণিমা চাঁদের তিলক তোমারে পরাব
মোর অঞ্চল দিয়া তব জটা নিঙাড়িয়া
সুরধুনী ঝরাব।
কী আশ্চর্য অনুভূতি এই গানে। আমাদের ‘খুকু ও কাঠবেড়ালির’ মতোন। যেন সাধছেন যে সাজিয়ে দেবো তোমাকে যে প্রলয়-সুন্দর এলো তাকে স্বাগত জানাতে হবে। যে পরম আকাক্সিক্ষত এসে তাকে আলিঙ্গন করে প্রকৃতিকে বরণ করে দিতে হবে তাই...। যা হোক, গাইতে গেলে বারবার উচ্চারণ করতে ইচ্ছা হয় এই শব্দগুলো। আর তার গানে তো প্যাটার্ন বলে একটা ছোট্ট স্বাধীনতা আমরা ভোগ করি। সেটা যখন ব্যবহার করার মওকা মিলে যায় তখন তো কথাই নাই। সেখানে প্রেম, অভিমান, আহ্বান, আদর সব কিছুই এসে ভিড় করতে থাকে। শুদ্ধ সারং যেন বাণীর সাথে মিশে গিয়ে রাগের রক্ষণশীলতা ভুলে যায়।
তার আরো গান যেমনÑ
ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে কাহারা যেন ডাকে
বেরিয়ে এলো নতুন পাতা পল্লবহীন শাকে।
ক্ষুদ্র আমার শুকনো ডালে
দুঃসাহসের রুদ্র ভালে
কচিপাতার লাগলো নাচন ভীষণ ঘূর্ণিপাকে॥

এই গানটিতে ঝড়ের কথা বলা হলো। কেমন করে ঝড় আসছেÑ অর্থাৎ কেমন শব্দে। ঝড়ের বিভিন্ন শব্দকে তিনি কারো ডাক ভাবছেন। ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি শুনতে পেয়েছেন তিনি। সেই তাণ্ডবে নতুন পাতা সাড়া দিলো শুকনো ডাল থেকে আবার কচিপাতার নাচন ভীষণ নাচনে। ঝড়ের প্রলয়-মাতনকে বুঝিয়েছেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের বৈশিষ্ট্যই এই ধরনের রচনায়। তিনি যেমন শান্ত থাকেননি। প্রকৃতির মতোই ছিল তার চলা, ভাবনা এবং কার্যক্রম। তার রচনায়ও সেই চারিত্রিক ছাপটি সুস্পষ্ট।
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি
আকাশ কাঁপে সে সুর শুনে সর্বনাশী।
বন ঢেলে দেয় উজাড় করে
ফুলের ডালা চরণ পরে
নীলগগনে আসে ছুটে মেঘের রাশি॥
বিপুল ঢেউয়ের নাগর দোলায় সাগর দোলে
বান ডেকে যায় শীর্না নদীর কূলে কূলে।
ললিত-পঞ্চম রাগের-তেওড়া তালের এই বিখ্যাত গানটিতেও ঝড়ের গর্জন শোনা যায়। আবার সাথে সাথে বলেছেন ‘তোমার প্রলয় মহোৎসবে বন্ধু ওগো ডাকবে কবে’Ñ অর্থাৎ সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরের সাথে মিশেও তিনি পরিশুদ্ধ হতে চেয়েছেন। তাই তো শেষ লাইনে বললেন, ‘ভাঙবে আমার ঘরের বাঁধন কাঁদন হাসি’॥
এ ধরনের অবিমিশ্র আনন্দ-বেদনার স্বাদ তিনি ঝড়ের প্রচণ্ডতার ভেতরেও খুঁজতে চেয়েছেন। এটি তিনি অর্থাৎ কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখনী তারই মতোন। মানুষ, প্রকৃতি, মানুষের চলমানতা, সামাজিকতা প্রকৃতির ভেতরেই। তিনি বারবার আবাহন করেছেন প্রকৃতিকে প্রকৃতির কাছেই। আরেকটি গানÑ
ওগো বৈশাখী ঝড় লয়ে যাও অবেলায়
ঝরা এ মুকুল।
লয়ে যাও বিফল এ জীবনÑ
এই পায়ে দ’লা ফুল॥
ওগো নদীজল লহো আমারে
বিরহের সেই মহা-পাথারে,
চাঁদের পানে চাহে যে পারাবারে
অনন্তকাল কাঁদে বিরহ-ব্যাকুল॥

এই গানের মধ্যেও সেই প্রার্থনা। হে রুদ্র বৈশাখ তুমি এসো, আমার বিফলতা, আমার জীর্ণতা ধুয়ে আমাকে নতুন জীবন দাও, এ যেন এক অপূর্ব বিরহ কাতরতা। একটি বছরের পুষে রাখা ভালোবাসার স্মৃতি। নদীজলের কাছে, চাঁদের কাছে প্রকাশ করছেন সেই বিরহের কথা। ‘মনোরঞ্জনী’ রাগের উপরে এই বাণী যেন কান্নার সুরে নিবেদিত বোশেখ-বন্দনা।
মেঘবিহীন খর বৈশাখে
তৃষায় কাতর চাতকী ডাকে॥
সমাধি-মগ্ন উমা-তপতী
রৌদ্র যেন তার তেজঃজ্যোতি,
ছায়া মাগে ভীতা ক্লান্তা কপতী
কপোত-পাখায় শুষ্ক শাখে॥
খরতাপের যেন অবসান নেই। অসীম শুষ্কতা আর তাপের পরিচয় জানান দিচ্ছে চাতকের তৃষ্ণা। দগ্ধ ধরণী কি প্রখর শুষ্কতায় আষাঢ়ের পানি প্রার্থনা করছে?
চরাচর আর আকাশ-নীলিমার মাঝের অসীম পিপাসা, কাতর ডাকে চাইছে আশীষ। সেই রুদ্র ভয়ঙ্কর শুষ্কÑ সুন্দরের কাছেই যেন সেই চাওয়া। সে আসুক। ভরিয়ে দিক আষাঢ়ের মেঘের আশীষে নিদারুণ দগ্ধ অঞ্জলিটুকু। শুধু সঙ্গীতই নয়। কাজী নজরুল ইসলাম যখন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে লিখেছেন সাথে সাথে তাকিয়েছেন সমাজ, মানুষ জীবন, জীবনের প্রয়োজন এসব দিকেও। তাই তিনি বাঙালি জাতির জীবনের উপজীব্য কৃষি, ফসল, দিনযাপন সব কিছুতেই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন একই সাথে। আর একটি গানেÑ
নিদাঘের খরতাপে ক্লান্ত এ ধরণি
মাধুরী হারায়ে হল পাণ্ডুর বরণী॥
পিঙ্গল জটাজাল, তেজ তার অশনি
বৈশাখী ভোরে স্মরি রুদ্রানী জননী॥
প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত আসা-যাওয়াকে তিনি ধরে নিয়েছেন নিয়ত আশীর্বাদরূপে, তা শুধু গান কিংবা রাগভিত্তিক গানেই নয়। এসব গানে বাণী যেমন বক্তব্যে অলকৃত, তেমনি বিভিন্ন আঙ্গিকের গানের বাণীতে তার অতুলনীয় সব বর্ণনার ছটাও রশ্মিত হয়ে আছে। এই বৈশিষ্ট্যই ছিল তার খেলা। তার তুলনা তিনিই। তাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ বা ফাঁক কোথাও নেইÑ শুধু মানসিকতা ছাড়া?
আরেকটি গানে একেবারেই অন্যরকম ভাবের কথা প্রকাশিতÑ
হংসমিথুন ওগো যাও কয়ে যাও
বৈশাখী তৃষ্ণার জল কোথা পাও।
কোন মানস-সরোবর জলে
পদ্মপাতার ছায়া-তলে
পাখায় বাঁধিয়া পাখা দু’জনে
প্রখর বিরহ দাহন জুড়াও॥
বিরহ জ্বালা যেন বৈশাখী তৃষ্ণার মতোনই। কী গভীর প্রেমকাতরতার সাথে প্রখর দহনের তুলনা। দুটো পাখি সেই বিরহ এবং তৃষ্ণার প্রতীক। চাতকি যেমন চাতকের তৃষ্ণায় কাতর। যেন ঘনশ্যামের অপেক্ষায়। অপূর্ব ভাব কল্পনার কথা কবি মূর্ত করেছেন এই গানে। ‘বড় হংস সারং’ রাগ এবং ত্রিতালের সন্নিবেশে এই গান। লিখতে লিখতে মনের মধ্যে সুরটা ভীষণ আন্দোলিত হতে হতে যখন মন চাইছে মিটুক সেই তৃষ্ণা, বিরহ কাতরতা, ঘনশ্যামকে নভোনীলে পাবার অপেক্ষার শেষ হোক। সূচনা হোক প্রশান্তির। অঝোরে ঝরুক প্রেমবারিধারা সূচনা হোক প্রশান্তির। হ


আরো সংবাদ



premium cement