২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বসন্তে

-

ওদের দেখেও না দেখার ভান করল ছেলেটা। আমগাছের মাথার দিকে তাকিয়ে গান ধরল : বসন্তে আজি চাঁদ চকোরে। লা-লা-লা-লা লা লা লা।
পাপ্পু ফিসফিস করে বলল, ওই দেখ মিকদাদ আলীর কাজ। চিনিস না ওকে? এক ক্লাস নিচে, মানে ক্লাস ফাইভে যে পড়ে। আগে তো আমাদের সাথেই পড়ত। এখন এক ক্লাস পিছিয়ে গেছে। আমাদের দেখাতে চাইছে কত ভালো গান গাইতে পারে। অথচ না পেরে লা-লা-লা করছে।
হ্যাঁ, ওই গানটা তো বিচিত্রানুষ্ঠানে আমাদের হেডস্যারই গত বছর গেয়েছিলেন। মুহিন বলল।
মিকদাদ সব সময়ই এমন করে। কোনো গানই ভালো মতো গাইতে পারে না। অথচ বুঝাতে চায় কত ভালো গান গাইতে পারে। এখন কিন্তু আমাদের শোনানোর জন্যই গাইতেছে, বুঝলি?
হুম।
মিকদাদ আলী লা-লা-লা থামিয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে ওদের এক নজর দেখে নিলো। এও বুঝে নিলো বিকাল বেলা ওরা ক’জন স্কুল চত্বরেই ঘুরতে এসেছে। আবারো ওদের না দেখার ভান করে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে স্কুলঘরের খোলা দরজা পথে ঢুকে গেল সে।
পাপ্পুরা এরই মধ্যে স্কুল চত্বরে এসে উঠেছে। ওরা শুনতে পেল স্কুলঘরের ভেতরে গান হচ্ছে : আহা আজি এ বসন্তে। এত ফুল বাজে/এত পাখি ফুটে/লা-লা-লা-লা। গানের সাথে হওয়া শব্দটা সম্ভবত হাতের আঙুল দিয়ে কাঠের বেঞ্চে করা শব্দ। পাপ্পু দাঁড়িয়ে বলল, শোন, কী উল্টাপাল্টা কথা ও সুরে গান গাচ্ছে। ফুল কি বাজে? পাখি কি ফুটে? সুর কি অমন? আর যেটুকু আসলে পারে না সেটুকুই লা-লা-লা করছে।
সমস্বরে হেসে উঠল ওরা। এবার ভেতরে গান থেমে গেল। পাপ্পু বলল, চল যাই, দেখি কিভাবে গান গাইছে। ওরা বলল, চল।
ওরা একযোগে স্কুলের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল মিকদাদ আলী বেঞ্চের ওপর চিত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে দুই হাতে বেঞ্চ চাপড়ে গান গাইছে। দু-এক লাইন বেসুরো গাওয়ার পর রীতিমতো দুই পা নাচিয়ে লা-লা-লা করছে। ওরা একযোগে হো হো করে হেসে উঠলে মিকদাদ আলী চমকে ওঠে। দরজায় তাকাতে গিয়ে বেঞ্চ থেকে কাত হয়ে নিচে পড়ে যায় সে। ওরা আবারও হো হো করে হেসে ওঠে। মিকদাদ এরই মধ্যে উঠে বসেছে। লজ্জায় মাথা নিচু করেছে সে। পাপ্পু বলল, কি মিকদাদ আলী, ভালোমতো গান গাইতে হলে ভালোমতো গান জানা ও শেখা চাই। কত ফুল বাজে, নাকি কত ফুল ফোটে? কত পাখি ফুটে, নাকি কত পাখি গায়?
মিকদাদ আলী মাথা নিচু করেই রইল। পাপ্পু বলল, চল মিকদাদ, আমরা সবাই মিলে তার চেয়ে বাইরে গিয়ে বসন্তের ফুল, ফল, পাখি দেখি। এ স্কুলচত্বরে তো প্রচুর গাছ, প্রচুর ফুল, ফল, পাখি আছে। চল আমরা ঘুরে ঘুরে সেসব দেখি। কবি তো সেসব দেখেই এ গান লিখেছেন।
চল তবে। ওরা সমস্বরে বলল।
সবাই একযোগে স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সামনে চোখ মেলতেই অবাক হয় ওরা। একটা লোক মাঠের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে ছোট দু’টি ছেলেমেয়ে। লোকটার লম্বা শুকনা শরীর, লম্বা ঘন কালো চুলদাড়ি। তার গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত গাঢ় হলুদ রঙের পোশাক। চোখে হলুদ কাচের চশমা। হাতে হলুদ রঙের একতারা। ছোট ছেলেমেয়ে দু’টিরও পরনে হলুদ পোশাক। ওরা ক’জন এগিয়ে যেতেই লোকটা একতারায় সুর তুলে গান ধরল : আহা আজি এ বসন্তে/এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গা-আ-আ-য়/আহা আজি এ বসন্তে।
চমৎকার গাইছে লোকটা। সাথের ছেলেমেয়ে দু’টিও গাইছে। ওরা কাছাকাছি যেতেই গান বন্ধ করল লোকটা। ছেলেমেয়ে দু’টি একটু দূরে দাঁড়াল। ওরা ক’জন লোকটার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পাপ্পু বলল, আপনি কে?
বসন্ত! বিড়বিড় করল লোকটা।
জি, মানে ? পাপ্পু বলল।
আমি বসন্ত। এবারে একটু জোরে বলল লোকটা।
দুঃখিত, কী বলছেন?
ঠিকই বলছি বাছা, আমার নাম বসন্ত ঠাকুর।
ও...তা আপনার বাড়ি?
বাড়ি বসন্তপুর।
গেছিলেন কোথায়?
গেছিলাম বসন্তগঞ্জের হাটে।
কেন?
গান গাইতে। গানই আমার জীবিকা, বাছা।
তা আপনার সাথে ওরা কারা?
আমার অনাথ নাতি-নাতনী। কইরে হেমন্ত? কইরে বাসন্তী? লোকটা হাত বাড়াল। ছেলেমেয়ে দুটো এগিয়ে লোকটার হাত ধরে তার সাথে একাকার হয়ে দাঁড়াল। পাপ্পু বলল, আপনি চোখে দেখেন না বুঝি?
হ্যাঁ।
কী হয়েছে আপনার চোখে?
আমি অন্ধ। ছোটবেলায় বসন্ত রোগে চোখ হারিয়েছিলাম। বাবা-মা দুঃখ করে নাম পাল্টে রেখেছিলেন বসন্ত। বসন্তকালে আমি বসন্তের গানই বেশি গাই। অকালে এদেরও মা-বাপ মরল। অন্ধ মানুষ, গানই একান্ত জীবিকা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল লোকটা।
তা এখানে দাঁড়ালেন কেন? পাপ্পু বলল।
আমার চোখ অন্ধ হলেও মনের চোখে আমি সব দেখি। শুনতে পাই সবই; নাকে গন্ধও পাই ঠিকঠাক। তা ছাড়া, ওরাও বলল এখানে অনেক গাছ, ফুলফল, পাখি, মৃদুমন্দ বাতাস। অথচ কে নাকি ভুল বাজনায় ভুল সুর ও কথায় বসন্তের গান গাইছে। তাই ভাবলাম, গানটা ভালোমতো শিখিয়ে যাই। গানই আমার একমাত্র পেশা। আবারো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল সে।
আপনি গান শেখাবেন আমাদের? ওরা একযোগে চেঁচাল।
হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। আমার সাথে একযোগে গলা মেলাও তোমরা। এই যে এভাবে গাইতে হয়। লোকটা গলাখুলে গান ধরল :
‘আহা আজি এ বসন্তে/এত ফুল ফোটে/ এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায় ...’
গোধূলির হলুদ আভায় একতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে ঘন গাছগাছালির মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা।


আরো সংবাদ



premium cement