২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জলসা

-

তোদের কাউকে দিয়েই কোনো কাজ হবে না। কেউ কোনো কাজের না। এক শ’বারের মতো হয়েছে তোদের বলছি যে, ঘরের ভেতর একটু গোজগাজ কর। সময় কি আমাদের জন্য বসে থাকবে নাকি। শীতের রাত। তা ছাড়া কিছু নতুন মানুষও আসছে। তাদের দাওয়াত দিয়ে এনে দাঁড়িয়ে রেখে কি গোজগাজ করবি তোরা। বলে চোখ গুচিমুচি করে নিজেই গোজগাজ করতে শুরু করল সেলিম ভাই। এক মাস ধরে শুধু প্ল্যান-প্রোগ্রাম চলছে একটা গানের জলসা করতে হবে। বিষয়টা প্রথম সেলিম ভাইয়ের চিন্তা হলেও পরে এটার জন্য তাগিদ দাতা বলতে শুধু সনতের নাম আসে।
জর্দ্দার কৌটা দিয়ে বানানো বিড়ির ছাই রাখার অ্যাসট্রেটা জোরে ছুড়ে মারে সেলিম ভাই। আর গজগজ করে বলে শালারা বিড়ি না খেয়ে বিষ্ঠা খেতে পারিস না। খাবি খা তো অ্যাসট্রেটাও একটু পরিষ্কার করতে পারিস। আহা কি ঘ্রাণ পেটের ভেতর পাগাল মারছে। আর ওদিকে সনত বিকালে সাইকেল নিয়ে ছুটেছে শিল্পীকে আনতে। শিল্পীর এখনো কোনো খোঁজ নেই। অথচ মাত্র বিশ মিনিটের পথ। তিন-চার ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে কোনো খোঁজ নেই। আমি গ্যাসের একটা সিলিন্ডারের ওপর বসে ভাবছি কোথায় ক্যামেরা বসাব। সেলিম ভাই গ্যাসের ডিলার সাথে কম্পিউটারের কাজকর্মও করে। ক্যামেরার চিন্তা মাথায় আসতেই মনে পড়ল মেমোরি কোথায় রাখলাম? এ রোগটা আমার নতুন না। এ পযর্ন্ত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে গিয়ে খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি ওই ক্যামরার মেমোরি ভুলে রাখার জন্য। বাড়ির বাইরে বের হলে ছবি তুলি, ভিডিও করি। বাসায় গিয়েই মেমোরিটা খুলে লাগিয়ে দেই ল্যাপটপে। আর পরে কোথাও যাওয়ার সময় সেই মেমোরি ল্যাপটপের ভেতরেই থেকে যায়। মেরোরি পেলাম ক্যামেরার ব্যাগেই। সনত এসে হাজির হলো শিল্পীকে নিয়ে। শিল্পী জন্মান্ধ। দু’চোখে কিছু দেখেন না। সনতের আসতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে খাড়া করল অ্যাকসিডেন্টের মামলা। শিল্পীকে নিয়ে কালীবাড়ির ওখানে পড়েছে। প্রমাণ হিসেবে পিচের রাস্তায় পড়ে থেতলে যাওয়া হাত দেখাল। সনতের সাথে আর এক সাইকেলে ছিল রিয়াজ। সে এসেই নেতিয়ে পড়েছে। সে আর কোনো কিছু করতে পারবে না এমন ভাব দেখাচ্ছে।
দোকানের মধ্যে জায়গা করা হলো। সনতের বাড়ি থেকে আনা বিছানার চাদর পাতা হলো। সেলিম ভাইকে দিয়ে আবার ফোন করালাম বাদ্যযন্ত্রওয়ালাদের। ওপাশ থেকে ফোনে জানাল, লোক নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। খোল বাজানোর লোক মিলছে, কিন্তু তবলা ধরার মানুষ মিলছে না। অথচ ওই লোকটা আমার সামনেই গত এক মাসে কম করে চল্লিশবার জোর গলায় বলেছে, দুই লাখ টাকার ওপরে প্রায় ৩০ প্রকারের যন্ত্রপাতি রয়েছে তাদের। লোকের ও অভাব নেই। শুধু আধা ঘণ্টা আগে বললেই সব ম্যানেজ করে চলে আসব। সেই লোকের মুখে এখন তবলা বাজানোর মানুষ না পাওয়ার কথা কতটা বেমানান ও বলদের পরিচয় বহন করেÑ ভাবার সুযোগ পেলাম না। সেলিম ভাই ফোন রেখে বলল, ওরা যন্ত্রপাতি এগিয়ে নিয়ে আসতে বলছে। ব্যাস অবলা সনত আর আমি বের হলাম সাইকেলে। সনত ওদের বাড়ি চেনে। বাড়ি গিয়ে পেলাম না। বাড়ি থেকে জানাল কোথায় যেন গান করতে বের হয়ে গেল এইমাত্র। ফিরে এলাম দোকানে। এসে দেখি নেই। সেলিম ভাইর কাছে শুনলাম কোথায় যেতে বলেছিল। বলল বুড়ো ঠাকুরের গাছতলায় নব’র দোতলা ঘরে ওরা মজমা বসায়। ততক্ষণে চার-পাঁচজন জড়ো হয়েছে সেলিম ভাইরের ঘরে। বাজারের সব দোকান বন্ধ। আবার গেলাম। গিয়ে তবলা, খোল ও জুড়িসহ আর কিছু যন্ত্রপাতি আনলাম। কিন্তু মানুষ পেলাম মাত্র তিনজন। কমলেশ, বিপ্লব ও বিশ্বকে। আমি সাইকেল চালাচ্ছি আর সনত দু’হাতে তবলা নিয়ে পেছনে বসা। পৌঁছালাম। পৌঁছাতেই সেলিম ভাই সনতকে বলল ভাজা মুড়ি কিনে আনতে। সনত ছুটল সেদিকে। দোকান বন্ধ হয়েছে প্রায় সব।
জন্মান্ধ শিল্পী সাধন মামা হারমোনিয়াম নিয়ে কচলাচ্ছেন। দুই চোখে না দেখলেও মিউজিক জগতের সব ধরনের যন্ত্রপাতি সাধন মামার কাছে পরিচিত। সে এ রকম একজন প্রতিভাবান মানুষ। হারমোনিয়াম রেখে ধরল তবলা। তবলার তালে মাতাম দিলেন সবাইকে। যন্ত্রপাতি নিয়ে বাজারের মধ্য দিয়ে আসা যাওয়া দেখে কয়েকজন খোঁজ করতে এসে হাজির হলো। রতন টাক, সত্যরূপ ও বিভূতিসহ আরো কয়েকজন। ফরিদ ভাই কালো সানগ্লাস পরে মজার সব কথায় মজিয়ে রাখছিল সবাইকে। এরই মধ্যে লাইটিং ও ক্যামেরাসহ সব ধরনের গোজগাজ সম্পন্ন হলো। সারিবদ্ধভাবে বসে আছে সজল ভদ্র জুড়ি নিয়ে, বিশ্ব ঝুনঝুনিতে, কমলেশ খোল নিয়ে, বিপ্লব হারমোনিয়াম, ফরিদ ভাই কয়েকটা ঘুগরি বাজাচ্ছে এবং সনত বসেছে তার পাশে। সাপের মতো মাথা নাচাচ্ছে বাজনার তালে। এ দিকে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, বন্ধু সেলিম, রিয়াজ ও বড় ভাই দোকানদার সেলিম। তা প্রায় চার ঘণ্টার মতো গান করল একে একে। গান-বাজনা শেষে মুড়ি ও বিড়ির পর্ব শেষ করে উঠে পড়ল সবাই। তখন অনেক খুশি সবাই । অন্ধ শিল্পী সাধন মামার কণ্ঠ শুনে সবাই চমকে গেল। সবাই বলছিল কত দিন পরে গলা ছেড়ে গান ধরতে পারলাম। বেশ ভালো লাগল। আসলে গান-বাজনা হলো পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। গান-বাজনার পরিবেশ একবার তৈরি হয়ে গেলে যে গানই করবা ভালো লাগবে ও ভালো শোনাবে বলল ফরিদ ভাই। বাজারে তখন একটা ঝিঝি পোকার আওয়াজও নেই। শীতের রাত। বাজারের কোথাও কোনো আলো নেই। বাজারের দোকানদাররা বড্ড হারামজাদা। বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে রাতে আলো জ্বালিয়ে রাখে না। অথচ অন্ধকারের ভেতর সিসি টিভি লাগানো রয়েছে কুড়ি খানেক দোকানে। বাজার কমিটির নির্বুদ্ধিতার পরিচয় মিলল। সবার থেকে দূরে বাড়ি আমার আর সনতের। সনতের কাছে জন্মান্ধ শিল্পী সাধন মামা থাকবে। সাধন মামার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় মামা বললেন ‘ভাগিনা আজকের জলসা’টা কিন্তু সেইরকম জমেছিল। লাইভ কনসার্টেও এমন মজা পায়নি ভাগিনা। বাড়ি পৌঁছে বিছানায় গিয়ে ঘড়িতে দেখি রাত আড়াইটা বাজে।
শালিখা, মাগুরা


আরো সংবাদ



premium cement