২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও আমেরিকার অবরোধ

-

ট্রাম্পের আমেরিকার এর আগের আমেরিকার প্রায় সব প্রেসিডেন্টের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্থনীতির নিয়মশৃঙ্খলার এক কাঠামোতে দুনিয়াকে সাজানো হয়েছিল। এর প্রধান বৈশিষ্ট ছিল আমেরিকা ন্যাশনালিস্ট অর্থে কেবল নিজের জন্য কোনো অর্থনীতি সাজায়নি, বরং আমেরিকা ছিল এক গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা, প্রধান পরিচালক। ফলে আমেরিকার নেতৃত্বে সেটা ছিল এক গ্লোবাল অ্যাম্পায়ারের অর্থনীতি।
পরবর্তীতে এই বৈশিষ্ট্যের গায়ে আরো এক পালক লাগে। সত্তর দশকের শেষে ওই গ্লোবাল অর্থনীতিকে আরো ‘গ্লোবালাইজেশনে’ মোড় নেয়ানো হয়। আমাদের মতো দেশগুলো রফতানিমুখী করে নিজ নিজ অর্থনীতি সাজিয়ে নিয়েছিল, ইপিজেড তৈরি যেখানে এর আরেক বৈশিষ্ট্য। আর আমেরিকা হয়ে উঠেছিল সেই গ্লোবালাইজেশনের কেন্দ্র, প্রধান নিয়ামক। এতে আমেরিকান অর্থনীতি ফিরে আর ‘আমেরিকান ন্যাশনালিস্ট’ বলে কোনো অর্থনীতির দিকে যাওয়ার বদলে যেন স্থায়ীভাবেই ‘গ্লোবালাইজেশন’ এর গ্লোবাল অর্থনীতিতে আরো পোক্ত হয়ে ঢুকে যায়; আর লিড করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ‘গ্লোবাল নেতা আমেরিকার’ এ’এক লম্বা সত্তর বছরের যাত্রা; যতক্ষণ না ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নতুন ধরনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের হাতে পড়ে আমেরিকা নেতৃত্বসহ গ্লোবালাইজেশনের সব কিছু থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেছিল। প্রায় সত্তর বছর পরে গ্লোবাল অর্থনীতির আম্পায়ার আমেরিকা এই প্রথম ‘আমেরিকা ফাস্ট’ সেøাগান তুলে ‘ ‘গ্লোবাল সাম্রাজ্যের’ নেতাগিরি, আর এর দায় বহনে অস্বীকার করে। ট্রাম্পের হাতে পড়ে আমেরিকার পুরানা নীতি-পলিসিতে বড় ধরনের বদল আসে। এটা পরিষ্কার যে, আমেরিকান পুঁজিবাজার-বিনিয়োগের যে ‘সামাজিক গোষ্ঠী’ গত সত্তর বছর ধরে প্রত্যেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের বা সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল তারা এবার আর উপস্থিত নেই। ট্রাম্পের ওপরে সবচেয়ে বড় আধিপত্য নিয়ে এখন যারা হাজির হয়েছে, এরা পুরনো বড় বিনিয়োগ কোম্পানির গোষ্ঠী ‘ওয়াল স্ট্রিট’ নয়, আবার এরা প্রভাবশালী ‘বহুজাতিক কোম্পানির’ জোট গোষ্ঠীও নয়। খুব সম্ভবত এরা আমেরিকান ম্যানুফেকচারার একটা গোষ্ঠী যাদের সেøাগানÑ আমেরিকা ফাস্ট, আমেরিকানদের চাকরি, আমেরিকান বাজার ইত্যাদি।
এরই আরেক রূপ হলোÑ গ্লোবালাইজেশনের পুরো বিপরীতে এদের রক্ষণশীল অবস্থান, আমেরিকান বাজার সংরক্ষণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী আমদানি পণ্যের আমেরিকায় প্রবেশের ওপর অতিরিক্ত (২৫ শতাংশের বেশি) শুল্ক আরোপ করা। এটাই চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ। আর তা চলতি ২০১৮ সালের শুরু থেকেই গুছিয়ে বিস্তার হয়ে চলেছে। তবে এটা কেবল চীনের বিরুদ্ধে নয়, বরং এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার ক্ষেত্রে কোনো বাছবিছার নেই, কোনো রাষ্ট্রের জন্য কোনো ছাড় নেই, আমেরিকান পুরনো বা নতুন স্ট্রাটেজিক দোস্ত-বন্ধু হলেও (যেমনÑ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ভারত হলেও) কোনো মাফ নেই। তবে চীনের সাথে বাণিজ্যে বিরোধগুলোই বেশি প্রকট আর তা সাইজ ও প্রভাবের দিক থেকেও বড়।
ক্রমে তাই প্রশ্ন উঠছে এই ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ থেকেই কী দুনিয়া এবার আরেক বিশ্বযুদ্ধ দেখবে, প্রবেশ করবে? এ ছাড়া ব্যাপারটা কী আসন্ন যে পরিস্থিতি দ্রুত সেদিকে মোড় নেবে? এমন কিছু উত্তেজনা আর হুমকি-পাল্টা হুমকি দেয়া দেখা দিতে শুরু হয়েছে গত কিছুদিন ধরে। যদিও এক, আপাত কিছু ঠাণ্ডা প্রলেপের দেখা মিলছে, অন্তত সাময়িক হলেও ঠাণ্ডা হওয়ার পথে যেতে শুরু করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত নভেম্বর ২০১৮, জি-২০ গ্রুপে বৈঠকের সাইডলাইনে চীন-আমেরিকা দুই প্রেসিডেন্ট মুখোমুখি হয়েছিলেন। যদিও এটি হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকবার তাদের দেখা সাক্ষাৎ ও আপস মীমাংসার বিভিন্ন প্রচেষ্টা হয়েছে; কিন্তু কোনো ফলাফল ছাড়াই তা শেষ হয়েছে। আর এবার যে আশার আলো তা হলো, আগামী তিন মাসের জন্য তাদের মধ্যে একটা সন্ধি হয়েছে, যাতে এই সময়ে তারা পরস্পরের যা কিছু আলাপ প্রস্তাব আছে, সেগুলোর সম্ভাবনা বিস্তারে বিচার করে দেখার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু এর মাঝেই আবার ভিন্ন এক কোণ এবং ইস্যু থেকে, খুবই সিরিয়াস উত্তেজনা ও হুমকির সূত্রপাত ঘটেছে।
চলতি মাসের খবর হলো চীনা স্মার্টফোন কোম্পানি হুয়াওয়ে (ঐঁধবির) এই কোয়ার্টারে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল কোম্পানিকে ছাড়িয়ে বাজার দখলে স্যামসাংয়ের পরে দ্বিতীয় স্থানে এসেছে। বাংলাদেশে হুয়াওয়ে ফোনের বাজারও যথেষ্ট ভালো। ফলে এই নামটা পরিচিত। তবে এটি শুধু স্মার্ট ফোনই তৈরি করে না, বরং পাবলিককে ফোন নেটওয়ার্ক সার্ভিস দেয়ার কোনো কোম্পানির (যেমন গ্রামীণ) এদের ব্যাক অ্যান্ডে যেসব টেকনোলজি লাগে এমন বহু যন্ত্রপাতির নির্মাতা ও উৎপাদক কোম্পানি হলো এই হুয়াওয়ে। এদিকে স্মার্টফোনের নতুন জেনারেশন টেকনোলজি-৫জি-এর আত্মপ্রকাশ আসন্ন। এই হুয়াওয়ে কোম্পানির ওপর চীনের বিরাট ভরসা যে; এই প্রাইভেট কোম্পানির এবার দুনিয়াতে ৫জি টেকনোলজির লিড করবে। অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, হুয়াওয়ে ১৯৮৭ সালের জন্ম থেকেই এটি প্রাইভেট কোম্পানি। এখন সে দুনিয়ার ১৭০ দেশে তার ব্যবসার ছড়িয়েছে। যেখানে তার বার্ষিক মোট বিক্রির পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মালিক হলেন রন ঝেংফাই (জবহ তযবহমভবর)। তিনি আবার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১২তম কংগ্রেস থেকে এক নির্বাচিত সদস্য। এই কোম্পানির আরেক প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটা প্রাইভেট কোম্পানি হলেও প্রতিষ্ঠাতা মালিক রনের নিজস্ব মালিকানা মোট শেয়ারের মাত্র ১.৭ শতাংশ। আর বাকি শেয়ারের মালিক কোম্পানির জন্মের সময় থেকে ওই কোম্পানির সব কর্মচারী।
কথা হচ্ছিল, বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে তা আবার এক বিশ্বযুদ্ধে গড়াবে কি না! সে ঘটনায় আপাতত উসিলা হলো এই হুয়াওয়ে কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রধান ফাইন্যান্স কর্মকর্তা হলেন সাবরিনা মেঙ ওয়াংজু (ঝধনৎরহধ গবহম ডধহুযড়ঁ); প্রতিষ্ঠাতা মালিক রন ঝেংফাইয়ের নিজের মেয়ে সাবরিনা। তিনি কোম্পানির কাজে হংকং থেকে মেক্সিকো যাচ্ছিলেন, পথে বিমান বদলের জন্য তার যাত্রাবিরতি ছিল কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। এই ভ্যাঙ্কুভার বিমানবন্দর থেকে ১ ডিসেম্বর কানাডিয়ান পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।
কানাডা-আমেরিকার মধ্যে ‘আসামি প্রত্যবর্তন’ চুক্তি আছে। তাই কানাডার অভিযোগ, আমেরিকায় সাবরিনার নামে মামলা আছে; সেই মামলার কারণে আমেরিকার অনুরোধে কানাডা তাকে গ্রেফতার করেছে।
পরবর্তীতে এই আটক মামলা আদালতে উঠলে আমেরিকার মূল অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়। তা হলো, ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকা অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু আরোপিত ওই অবরোধ আইন ভঙ্গ করে হুয়াওয়ে কোম্পানি ইরানের সাথে ব্যবসায় করেছে। যদিও হুয়াওয়ে কোম্পানি স্কাইকম’ নামে এক বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে ওই ব্যবসায় করেছে। আর সেই সাথে আইনত স্কাইকম হুয়াওয়ে কোম্পানির কেউ নাÑ কোনো অধীনস্ত বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি নয় বলে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে সাবরিনা সাক্ষ্য দিয়েছে। আর আমেরিকান অভিযোগ ও দাবি হলো, মূলত হুয়াউইয়ের অধীনস্ত কোম্পানি হলো স্কাইকম, যা বকলমে চলে। তাই তারা সাবরিনার বিরুদ্ধে ‘ব্যবসায় প্রতারণার’ অভিযোগ এনেছে। আমেরিকান আইনে এতে শাস্তি হলো ৩০ বছর পর্যন্ত সাজা।
ব্যাপারটা এখানে সহজ করে বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস আর জটিল।
এ ঘটনায় চীনা কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। অনুমান করা হচ্ছে, চীনের সাথে মালিক রনের ঘনিষ্ঠতা অনেক সেটিও এর একটা কারণ। চীনে কানাডা ও আমেরিকার রাষ্ট্রদূতদের ডেকে নিয়ে চীন তার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কড়াভাবে কানাডাকে জানিয়েছে তারা যদি সাবরিনাকে মুক্তি না দেয় তবে ঘটনাটাকে কানাডা-আমেরিকার যৌথ অপহরণের কাজ বলে চীন মনে করবে এবং স্বভাবতই চীন পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।
এমনিতেই চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধে ট্রাম্প চীনের যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে তাদের মধ্যে দুটো টেলিকম কোম্পানি আছে হুয়াওয়ে যার অন্যতম। আমেরিকার কমন অভিযোগ, আমেরিকান টেকনোলজি বা পেটেন্ট চুরি করে চীনা কোম্পানি। এ ছাড়া ওই দুই কোম্পানির বিরুদ্ধে আমেরিকার মারাত্মক অভিযোগ হলো চীনা সরকার এই কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে গোয়েন্দাগিরি করে। আমেরিকায় এ নিয়ে এক ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ পাস করিয়েছে, যেটি বলেছে এই দুই কোম্পানির কোনো টেকনোলজি বা ফোন আমেরিকার সরকারি যেকোনো অফিসের জন্য কেনা ও ব্যবহার নিষিদ্ধ।
এমনিতেই চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ চলমান। এর ওপর এই গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ নিঃসন্দেহে মারাত্মক। তবু এই আলোচনায় মনে রাখা ভালো যে, সাবরিনার আটক মামলায় আমেরিকান অভিযোগ ঠিক বাণিজ্যযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নয়। ইরানের ওপর আরোপিত আমেরিকান অবরোধ ভঙ্গ করেছে সাবরিনা ও তার কোম্পানি হুয়াওয়ে, এই হলো আমেরিকার অভিযোগ।
অবরোধ বা স্যাঙসান (ংধহপঃরড়হ) এর মানে হলো, কোনো ধরনের বাণিজ্যিক লেনদেন নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের গ্রাম-সমাজের ভাষায় বললেÑ কাউকে সামাজিকভাবে একঘরে করা। তবে আমেরিকার ইরান অবরোধ কথার মানে হলো কেবল ‘আমেরিকা নিজে ইরানের সাথে কোনো ধরনের লেনদেন’ করবে না। এটি জাতিসঙ্ঘের আরোপিত কোনো অবরোধ নয়। প্রশ্ন হলো চীন-ইরান নিজেদের মধ্যে কোনো পণ্য কেনাবেচা করলে তাতে আমেরিকার আরোপিত অবরোধ মানা না মানার কী সম্পর্ক? আমেরিকার তাতে আপত্তি কী? আপাত দৃষ্টিতে আসলে নেই, কিন্তু আছে। কোথায়?
আন্তর্জাতিক মুদ্রা
কোনো বাণিজ্য বা পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে মূল কথা হলো, মুদ্রা ছাড়া কোনো বিনিময় নেই। ফলে বাণিজ্যও নেই। আর আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিনিময় বাণিজ্য মানে হলো সেখানে যার যার জাতীয় মুদ্রা হলে হবে না, সবার মেনে নেয়া এক ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা’ থাকতে হবে। এই মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো নিজ নিজ মুদ্রার সাথে গৃহীত ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রার’ বিনিময় হার বা মুদ্রামান কত?
১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল আমেরিকার ব্রেটনউড শহরে টানা ২২ দিনের এক আলোচনায়। অনেকে এটিকে তাই ব্রেটনউড সিস্টেম বলেন। ফলে তা থেকে এক আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য শুরু করার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কেন? এর আগে তাহলে কী ছিল?
এর আগের কলোনি শাসনের দুনিয়ায় খুবই সীমিত এক আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য চলত আর তা নিয়ন্ত্রিত হতো প্রাইভেট ব্যক্তির ব্যাংকের মাধ্যমে। যদিও তাতে বিশ্বস্ততাও ছিল। সরকারি ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু এই সীমিত বাণিজ্য ব্যবস্থাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪) শুরুর পর থেকে অকেজো হয়ে যায়। মূল কারণ যুদ্ধে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন যুদ্ধের খরচের কারণে কারো মুদ্রার মানের ঠিকঠাকানা ছিল না। ইচ্ছামতো মুদ্রা ছাপানো হয়েছে ব্যাঙ্কে সমতুল্য সোনা রিজার্ভ না রেখেই। তাই সব কিছুই ভেঙে পড়েছিল। সে কারণে ১৯৪৪ সালের আগের ৩০ বছরে দুনিয়ার কেটে ছিল দুঃসহভাবে কোনো আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ব্যবস্থা ছাড়াই। তাই সবার প্রবল কাম্য ছিল ‘ব্রেটনউড সিস্টেম’। দুনিয়াজুড়ে এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মুদ্রা ও বিনিময় হার নির্ধারণ ব্যবস্থার প্রচলন করা, যাতে এক আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করা যায়।
এখন কে হবে সেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা? আগেই বলেছি, ১৯১৪ সালের পর থেকে ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রেরই মুদ্রা মানসম্পন্ন ছিল না। কারণ ভল্টে সমপরিমাণ সোনা জমা না রেখেই সবাই মুদ্রা ছাপিয়েছে। যার একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমেরিকা। মানে মানসম্পন্ন মুদ্রা বলতে একমাত্র আমেরিকান ডলারই ছিল। তাই উপায়ন্ত না পেয়ে ইউরোপসহ আইএমএফের সব সদস্য ডলারকেই একমাত্র আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ব্যবস্থার মুদ্রা বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে মেনে নিয়ে ওই গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করেছিল।
আসলে বাস্তবে মুদ্রা বলতে যেকোনো জাতীয় মুদ্রাই একমাত্র বাস্তব মুদ্রা। বিপরীতে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা’ কথাটাই অলিক, অবাস্তব। মূল কথা, ডলার তো আসলে আমেরিকান জাতীয় মুদ্রা। তাই এর ছাপানো প্রত্যাহার নিয়ন্ত্রণ সব কিছুর ওপর একক কর্তত্ব হলো আমেরিকার। অথচ পুঁজিতান্ত্রিক লেনদেন বিস্তারে এই গ্লোবাল বিনিময়ের জন্য মুদ্রা প্রয়োজন। কিন্তু এই চাহিদা কিভাবে মেটানো হবে এর কোনো বাস্তব সমাধান আজো পাওয়া যায়নি। উপায়হীন হয়ে তাই আমেরিকান ডলারকে দিয়েই আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্যব্যবস্থা যাত্রা শুরু করেছিল। আর তা বহু চড়াই-উতরাই পার হলেও আজো ৭০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ডলারেই হয়ে থাকে। আর চাইলেই এখন এটাকে বদলানো যাচ্ছে না। তবে বদলাবে না তাও নয়। যদিও ইউরোপের ইউরো একটু চেষ্টা করে অতলে হারিয়ে গেছে। এখন চীনা ইউয়ানকে দেখার বিষয় যে আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্যের কতভাগ সে ইউয়ানে করাতে সক্ষম হয়। আসলে যতক্ষণ না কেউ ডলারের চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য লেনদেনের (ডলার বিনা) অন্য মুদ্রায় না হতে পারবে ততক্ষণ কোনো পরিবর্তন হবে না।
এর সোজা মানে হলো, চীন-ইরান কোনো বাণিজ্য লেনদেন করলে সেটা আমেরিকান ডলার। এই মুদ্রায় করলে এটি সবার অধিক কাম্য। কারণ ইরান চীনকে ডলারে তেল বিক্রি করলে ইরান বিনিময়ে পাওয়া ডলার দিয়ে সহজেই যেকোনো পণ্য কিনতে পারবে। আর চীনা ইউয়ানে ইরান দাম পেলে তা দিয়ে ইরানের অন্য যেকোনো জিনিস কিনলে তার দাম পরিশোধ সহজ নয়, কারণ ইউয়ানের চেয়ে ডলার বেশি চালু মুদ্রা। আর আমেরিকান অবরোধ মানে হলো, চীন-ইরান কোনো বাণিজ্য লেনদেনে ডলারে হতে আমেরিকা আপত্তি দিয়ে রেখেছে। আসলে ডলারে দাম পরিশোধ মানেই আমেরিকান কোনো না কোনো ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া ফাইনালি লেনদেনে পণ্যের মূল্য পরিশোধই হবে না। আর আমেরিকান অবরোধ মানেই আমেরিকান ব্যাঙ্কের সংশ্লিষ্টতা ঘটানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটা ভঙ্গ করাটাই আমেরিকান আইনে জেল-জরিমানা শাস্তি হিসেবে ঘোষণা করে রাখা হয়েছে।
প্রায় ৭০ বছর হয়ে গেছে ব্রেটনহুড সিস্টেমে মুদ্রা ও বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হয়েছে। একালে এসে এই প্রথম আমেরিকান ডলারে আঁচ জাগছে আমেরিকা চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তবে ধীরে ধীরে। অন্য ভাষায় বললে, আন্তর্জাতিক পণ্য বিনিময় বাণিজ্য যথাসম্ভব ডলারকে এড়িয়ে ঘটানোর চেষ্টাÑ এই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, যদিও বড় প্রভাব ফেলার মতো অবস্থায় যেতে এখনো অনেক পথ বাকি। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসন এখন নাই কথাতেই নানান রাষ্ট্রের ওপর ‘অবরোধ’ আরোপ করে বসছে। এককথায় একালে আমেরিকার অবরোধ আরোপের হার অনেক বেশি; আমেরিকা ও ডলারের মরিয়া হয়ে নিজ প্রভাব ধরে রাখার কিছু অক্ষম লক্ষণ।
আবার ইউয়ানও ডলার মতোই বাজারে সমান বিশ্বাস-আস্থা আছে এমন নয়। ঘটনা হলো, যার ওপর বিশ্বাস-আস্থা নেই সে মুদ্রা নয় বা হয়ে উঠতে পারবে না। তাই, সন্দেহ হলেই বাজার সে নোট আর সহজে নিতে লেনদেন করতে চায় না। বাজার নয়, কমিউনিস্ট দেশে সব কিছুতেই পার্টি কন্ট্রোল করে ফলে বাজার যথেষ্ট খোলা নয় বলে ধারণা আছে। বরং মুদ্রার মানসহ যেকোনো জায়গায় পার্টি হাত ঢুকাতে পারে এই অবিশ্বাসটাই চারদিকে ছড়িয়ে আছে। মানে ডলারের তুলনায় ইউয়ানের ওপর বিশ্বাস আস্থা কম। ইউয়ানকে আগে এই আস্থা বিশ্বাস জিততে হবে।
ঠিক এ কারণে আমেরিকান অবরোধের কথা জেনেও বেনামে ইরানে পণ্য বিক্রির চেষ্টা হতে দেখা যাচ্ছে। আর একমাত্র একালেই ট্রাম্প অবরোধের নিয়ম-কানুন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। যার ফাঁদে পড়ে গেছে হুয়াওয়ে। আপাতত সাবরিনার কঠিন শর্তে জামিন হয়েছে, আর তিনি কানাডাতেই থাকবেন।
এটি পরিষ্কার যে, পরিস্থিতির ভারসাম্য এখন চীনের বিরুদ্ধে। আর আসলে একমাত্র আপস আলোচনায় হুয়াওয়ে প্রসঙ্গ শেষ হতে পারে। অতএব আমেরিকা-কানাডাকে টেবিলে আনতে পারা চীনের জন্য খুবই জরুরি। সেই পাল্টা চাপ তৈরি করতে চীন ইতোমধ্যে এক আমেরিকান সাবেক ডিপ্লোমাটকে গ্রেফতার করে ডিটেনশন দিয়েছে। চীন একইভাবে দ্বিতীয় আরেক জনকেও গ্রেফতার করেছে। হ


আরো সংবাদ



premium cement
সিরাজগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের নৈশ প্রহরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার ৬ দাবিতে উত্তাল বুয়েট, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন মোরেলগঞ্জে মাছ ধরতে গিয়ে নদীতে ডুবে কিশোরের মৃত্যু আল-আকসায় কোনো ধরণের সহিংসতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হলো তৃতীয় জুমআর জামাত ‘পেশাগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে’ গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১

সকল