২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নীল কষ্ট

প্রচ্ছদ : হামিদুল ইসলাম -


গ্রামের বাজারের আঁকাবাঁকা গলি ধরে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে ছোট্ট একটা চা দোকান। বাজারের এক পাশে হওয়ায় এখানে মানুষের জটলা খুব চোখে পড়ে না। দোকানটাও প্রায় শূন্য। তাকগুলো খালি পড়ে আছে। মনে হচ্ছে অনেক দিন জিনিসপত্র উঠানো হয়নি। তিন তাকের ওপরের তাকে কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট। ধুলা পড়ে আস্তরণ জমে আছে প্যাকেটে। দ্বিতীয় তাকে বিভিন্ন ধরনের বিড়ি-সিগারেট। দোকানে এই জিনিসটাই বেশি আছে মনে হয়। তিন নম্বর তাকে কয়েকটা মশার কয়েলের খালি প্যাকেট। একটা প্যাকেটে দুই তিনটা কয়েল আছে। তার পাশেই ছোট্ট একটা টিভি আছে। যেখানে সবসময় বাংলা সিনেমা চলে। দোকানের নাম সাদেক টি-স্টল। দোকানে ঢুকতেই এই লেখাটা চোখে পড়বে। লেখাটার নিচে খুব সুন্দর করে ভুল বানানে লেখা আছেÑ এখানে চা, সিগারেট, বিস্কুটসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। যদিও প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসই তেমন পাওয়া যায় না। বোঝাই যাচ্ছে দোকানদার নিজেই এগুলো লিখেছে। সাদেক টি-স্টলের দোকানদার সাদেক। বয়স ২২-২৩ হবে। বেশ সহজ-সরল টাইপের একটি ছেলে। মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। গ্রামে আসলে আমরা বন্ধুরা এখানেই আড্ডা দেই। সাদেকের সাথে আমাদের এক অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাদেক বেশ প্রতিকূল পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনা করতে পারেনি। ছোটবেলায় ওয়ার্কশপে কাজ করত। ওয়ার্কশপের অমানুষিক খাটুনি সাদেকের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। দোকানে বসলে প্রায়ই সাদেক ওই সময়গুলোর কষ্টের কথা বলতে থাকে। আমরাও মনোযোগী হয়ে শুনি। একবার কাজ করতে করতে বেশ হাঁপিয়ে ওঠে সাদেক। ওয়ার্কশপের ভেতর ছোট্ট একটা টুল ছিল। সাদেক সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। মালিক এসে সাদেককে খুব মারে। সে শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি। পিঠে গরম লোহার ছ্যাঁকা লাগিয়ে দেয়। কথাগুলো বলতে বলতে জামা খুলে পিঠ দেখাচ্ছে সাদেক। এখনো কালো হয়ে আছে। সাদেকের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আর কথা বলতে পারছে না। সাদেকের পাশে গিয়ে তার মাথায় হাতটা বুলিয়ে দিয়ে বললাম, কাঁদিস না। সাদেক আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল। আমি অবাক হয়ে যাই। তার মনে এত কষ্ট জমা হয়ে আছে তা জানতাম না।
এরপর কান্না থামিয়ে বলে, ভাইয়া আমারে মাফ কইরা দেন।
আমি বললাম, মাফ মানে কী?
Ñআমি আপনেরে জড়াইয়া ধরছি। আমার গায়ের ঘাম আপনের শরীরে লাইগা গেছে, হের লাইগা মাফ চাইছি।
এবার সত্যি সত্যি আমার নিজের চোখে পানি চলে এলো। এত সহজ-সরল মানুষ এখনো পৃথিবীতে আছে। দোকানে বসলে সে বুঝত আমরা চা খেতে এসেছি। দূর থেকে দেখলেই চা-বানানো শুরু করে দিত। মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। চা খাওয়া উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু সে চা খাইয়েই ছাড়ত আমাকে দেখলে নানা প্রশ্ন করত। পৃথিবী নিয়ে তার অনেক প্রশ্ন। কোনো কিছুই নাকি তার মাথায় ধরে না। আকাশে প্লেন কেমনে ওড়ে। জাহাজ পানির ওপর কিভাবে ভেসে থাকে; আরো নানা প্রশ্ন। একবার আমি আর আমার বন্ধু শাহাদাত বসে বসে বান্দরবান ভ্রমণ নিয়ে কথা বলছিলাম। তার কিছু দিন আগে আমরা বান্দরবান থেকে ঘুরে এসেছিলাম।
সাদেক আমাকে প্রশ্ন করে, ভাইজান আপনেরে একটা প্রশ্ন করুম?
-হ্যাঁ, অবশ্যই
-আইচ্ছা,বান্দরবানে কী সব বান্দর থায়ে? চাইর দিকে কী সব বান্দর আর বান্দর?
তার কথা শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়। আমাদের বন্ধু ইমন সদ্য নৌবাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিয়োগ পায়। তাকে অনেক দিন আমাদের সাথে না দেখে সাদেকের প্রশ্ন, ভাইয়া, ইমন ভাইরে দেহি না কেন?
Ñও তো নৌবাহিনীতে ঢুকছে।
Ñ হ, ঢুকবোইতো উনিতো লম্বা মানুষ। আইচ্ছা ভাইয়া,আমিতো লম্বা আমি কি ঢুকতে পারুম না?
তার এ প্রশ্নের কী জবাব দেবো? পরে তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম। সাদেকের বড় একটা গুণ ছিল সে আমাদের খুব সম্মান করত। একবার সাদেক দোকানে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে চা। আমাদের দেখে তাড়াহুড়ো করে সিগারেট ফেলতে গিয়ে ভুলে চায়ের কাপটা ফেলে দেয়। আমরা তো হেসেই খুন হয়ে যাই। গ্রামে গেলে সাদেকের দোকানে চা না খেলে একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। সাদেককে আজ কেমন লাজুক লাজুক লাগছে। কী যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।
সাদেকÑ কিছু কি বলতে চাচ্ছ?
না ভাইয়া, কিছু না
আরে বল বল, কী বলতে চাও।
আমার গায়ের টি-শার্টটি দেখিয়ে ভাইয়া, আপনের গায়ের গেঞ্জিটা কত?
কী জন্য বল তো?
না, এমনিতে। নীল কালার আমারও ভালা লাগে। তাই জিগাইলাম।
টি-শার্টটা তোমার ভালো লেগেছে?
জ্বি ভাইয়া, আপনেরে আমি টেকা দিমু আপনি শহর থেকে আসার সময় আমার লাইগা এরকম একটা গেঞ্জি নিয়া আইসেন। এইরকম নীল কালারের। আনলে আমি এখানে টেইলার দোকানে ছোট কইরা নিমু।
আচ্ছা আমি এরকম একটা নীল টি-শার্ট নিয়ে আসব। আর ছোট করার দরকার নেই। একটু ছোট সাইজের নিয়ে আসব। আর শোনো, তোমাকে টাকা দিতে হবে না।
Ñ কী কন ভাইয়া, টেকা না দিলে আপনি কেমনে আনবেন?
Ñ ওটা নিয়ে তুমি টেনশন করো না। মনে করো এটা আমি তোমাকে উপহার হিসেবে দেবো।
আমার কথা শুনে সাদেক চুপ হয়ে যায়। চোখ ছলছল করছে। আমি সাদেককে বুকে টেনে নেই। সাদেক মনে হয় এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। যাওয়ার সময় একটা কথা বলেÑ ভাইজান, একটা কথা কই। আপনেরে কইতে ভুলে গেছি। সৌদি আরবে ভিসা লাগাইছি। অইলে চলে যামু।
সৌদিতে ভিসা লাগাইছো ভালো কথা। টাকা পেলে কোথায়।
আমগো একটা জমিন আছে ওইটা বেইচা দিছি। দেশে থাইকা বেশি ইনকাম করতে পারি না। দেহেন না কাস্টমার নাই। সৌদি গেলে অনেক টেহা হইব। তহন আপনেগো মতন জামা-কাপড় পরতে পারুম।
Ñআল্লাহ ভরসা। সৌদি যেন যেতে পারো সে দোয়াই করি।
ব্যস্ততার কারণে গত কয়েক বছর গ্রামে যাওয়া হয় না। অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার আগে হঠাৎ মনে হলো সাদেকের জন্য একটা নীল টি-শার্ট নেয়ার কথা ছিল। আমার গায়ের সেই রকম টি-শার্ট খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর ও কাছাকাছি টাইপের একটা নীল টি-শার্ট নিলাম। সাদেক নিশ্চই খুব খুশি হবে। সাদেকের মতো এত সহজ-সরল টাইপের ছেলের জন্য এই ছোট্ট উপহার কিনতে পেরে খুব ভালো লাগছে। বাড়ি এসে টি-শার্টটি ছোট্ট একটা ব্যাগে করে নিয়ে বেরুলাম। সাদেকের দোকানের সামনে এসে আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এ আমি কী দেখছি। সাদেকের দোকানে সেলুন দোকান। সাদেক টি-স্টল লেখাটা কেটে স্মার্ট সেলুন নাম দেয়া হয়েছে। খুব সুন্দর করে সাজানো সেলুন দোকানটি। কিন্তু সাদেক কই। সে কি নতুন দোকান দিয়েছে? সেলুন দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
এখানে তো সাদেকের দোকান ছিল।
হ ভাইজান, এক বছর আগে ছিল।
ও কোথায়।
ও তো নাই।
নাই মানে?
সাদেক তো গত বছর বিদেশ চইলা গেছে।
কথাটা শুনে শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। সাদেক তো আমাকে বলছিল ও সৌদির ভিসা লাগিয়েছিল। আমিতো ভুলেই গিয়েছি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। ঢাকায় চলে আসার সময় সাদেকের জন্য নেয়া নীল টি-শার্টটা নিয়ে এসেছি। ব্যাগটা আমার রুমের এক কোণে ঝুলিয়ে রেখেছি।
বহুদিন পর ব্যাগটার দিকে চোখ পড়ল। ধুলা পড়ে একাকার হয়ে গেছে। আমি ব্যস্ত মানুষ তাই রুমের সব দিকে খেয়াল রাখতে পারি না। ব্যাগটা নামিয়ে ভালো করে মুছে রাখলাম। এই ব্যাগেই লুকিয়ে আছে সাদেকের প্রতি আমার সামান্য ভালোবাসা। সাদেক হয়তো কিছু দিন এই নীল টি-শার্টের অপেক্ষায় ছিল। হয়তো আমার প্রতি খুব রাগ হয়েছে। কিন্তু সে কি জানে তার জন্য কেনা নীল টি-শার্টটি খুব যতœ করে রেখে দিয়েছি? জানার কথা না। আমার হৃদয়ের আর্তনাদ অতদূর পৌঁছানোর কথা না।

 


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি চীনের আনহুই প্রদেশের সাথে ডিএনসিসি’র সমঝোতা স্মারক সই আ’লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষ : ২ শতাধিক ককটেল বিষ্ফোরণ, আহত ৫ রাঙ্গামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে নিহত ৬, আহত ৮ প্রতিবাদ সমাবেশকারীদের গ্রেফতারের নিন্দা জামায়াতের ‘সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না’ ফরিদপুরে বেইলি ব্রিজ অপসারণ করে স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন

সকল