২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দোচালা ছাদ

-

শুদ্ধতার নেশা আমার সমগ্র সত্তাকে রীতিমতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে নেশায় আমি বারংবার ডুবে যেতে চাই। মরতে চাই হাসতে হাসতে। তাই তো, আমি পবিত্রতায় স্নাত হতে ছুটে যাই শুদ্ধতার প্রতীক আমার গর্ভধারিণী মাতার কাছে। ত্যাগ-তিতিক্ষার পবিত্র জিলহাজ মাসে এসেও আমার দৈনন্দিনকার রুটিনের কোনো হেরফের হয়নি। প্রতিদিন সকালবেলা কাজে বের হওয়ার সময় সোজা মায়ের রুমে চলে যাই। পা ধরে মাকে কদমবুসি করি। মাকে জড়িয়ে ধরে ভালোমন্দ খোঁজখবর নিই। মাও যেন এই সময়টা আমি আসব বলে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকেন। উন্মুখ হয়ে থাকেন খোকা কখন আসবে। হাসিমুখে মা আমার নিখাঁদ ভক্তি ভালোবাসাটুকু গ্রহণ করেন। সহাস্যে অতিশয় আনন্দে সুন্দর করে কথা বলেন।
‘খোকা, তুই বের হচ্ছিস বুঝি? সাবধানে যাস।’
‘জ্বি মা, আমি কাজে যাচ্ছি। তুমি কেমন আছ? শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছে তো?’
‘আমি খুব ভালো আছিরে খোকা। অযথা এই বুড়ো মা’টাকে নিয়ে চিন্তা ফিকির করিস না।’
আমিও নাছোড়বান্দা। নানান কথা বলে যাই। কখনো কখনো মায়ের সাথে নির্মল হাসিঠাট্টা ও খুনসুটিতেও মেতে ওঠি। কথার ছলে কৌশলে মায়ের মুখ থেকে তার পছন্দ-অপছন্দ কিংবা ভালোলাগার বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করি।
‘মাগো, কোরবানি তো এসে গেল। সুন্দর মোটাতাজা একটা পশু কিনতে হবে। তা ছাড়া তোমার জন্যও তো এখনো কিছুই কেনাকাটা করা হয়নি। কী কিনতে হবে আমাকে বল?’
মা আমার কথা শুনে হাসে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব আমার দিকে স্নেহাতুর চোখে চেয়ে থাকে।
‘কিচ্ছু লাগবে নারে খোকা। শুধু শুধু ব্যস্ত হস না। বুড়ো মায়ের আবার ঈদ। কোরবানি দেয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নেইরে খোকা। তাই বরং না দেয়াই ভালো। সবসময় স্মরণ রাখবি, মনের পশুকে কোরবানি দিলেই, ওপরঅলা সবচেয়ে বেশি বান্দার ওপর খুশি হন। দোয়া করি, আমার মাথায় যত চুল আছে আল্লাহ তোকে তত বছর বাঁচিয়ে রাখুক। কাজ শেষে তাড়াতাড়ি সহিসালামতে বাসায় ফিরে আসিস। এতেই আমি খুশি।’
জগতের মায়েরা এমনি। মুখ ফোটে কোনো দিন কখনো সন্তানের কাছে কিছু চায় না। তেমনি আমার মাও। কোনো দিন আমার কাছে কিছু চায়নি। উল্টো সবসময় এসব জানা কথাগুলোই আমাকে ঘুরে ফিরে বারবার শুনিয়ে দেয়। প্রায়ই পরিচিতজনের কাছে এও বলতে শুনেছি, ‘আমার ছেলের আয় রোজগার কম। কিন্তু ভক্তি ভালোবাসাটুকু অনেক বেশি ও নিখাঁদ।’ আমি বেশ বুঝতে পারি আমার আয় রোজকার কম বলে, আমার কাছ থেকে তার চাওয়া-পাওয়াগুলোকেও বেশ সযতেœ গুটিয়ে রাখেন। আমিও কম যাই না। প্রতিদিন কাজ শেষে মায়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে ঠিকই ফিরে আসি। আজো আমার নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং মায়ের একপেশে কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। মায়ের হাসিখুশি বদন মুখখানা না দেখলে সারাটা দিন যেন একদণ্ড শান্তি পাই না। একবার যদিওবা কখনো একটু ব্যতিক্রম হয়, সেদিন আর কোনো কিছুতে কাজে মন বসে না। পুরোটা সময় অস্বস্তিকর লাগে। অথচ সেই প্রাণপ্রিয় মাই আজ দু’দিন ধরে নেই। ঈদের আগে শোক সাগরে ভাসিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। নীরবে নিভৃতে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পৃথিবীর আলো-বাতাস ও মায়া-মমতার সব জাল ছিন্ন করে, একবুক অভিমান নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে। অথচ কোরবানির এক সপ্তাহ আগেও একবারও মা আমাদের বুঝতে দেননি, তিনি নিজেই কোরবানি হয়ে যাবেন। আমাদের শোকসাগরে ভাসিয়ে এভাবে একাকী চলে যাবেন। অথচ রাতে হাসিমুখে পরিবারের সবার সাথে একসাথে খাওয়া-দাওয়াও করেছেন। শুধু তাই নয়, ফজরের নামাজ আদায় করে অন্য সময়ের মতো কিছুটা সময় জিকির আসকার ও মধুর সুরে কুরআন তিলাওয়াতও করেছেন। কিন্তু এরপর মা ঘুম থেকে আর জেগে ওঠেননি। চিরকালের মতো চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে পড়েছেন।
এবারের ঈদ আমাদের জন্য বিষাদময় দুঃখের। মায়ের এভাবে হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা কেউ মেনে নিতে পারিনি। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা গিয়ে পড়েছে আমার অসুস্থ বাবার ওপর। পাহাড়সম অটল অবিচল ও ইস্পাত দৃঢ় কঠিন মানুষটা মাত্র কয়েক মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছেন। বাবা মোটেও ভাবতে পারেননি মা তাকে ছেড়ে এভাবে সবার আগে চলে যাবেন। বাবা এখন প্রায় দিশেহারা। দিনের পুরোটা সময় মায়ের কবরের পাশে গিয়ে হন্যি হয়ে বসে থাকেন। অসুস্থ বাবাকে আমি ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসি। বাবা আবার সবার অলক্ষ্যে ঠিকই মায়ের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন। কান্না রোনাজারিতে মেতে ওঠেন। ধাক্কা সামলাতে পারিনি আমিও। বাবা-মা দুজনেই আমার প্রাণ। হঠাৎ করে মা চলে যাওয়ায় আমার মাথার ওপর থেকে যেন একটা গোটা ছাদ সরে গেছে। মাকে হারিয়ে আজ নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। বিশেষ করে বাবাকে নিয়ে এভাবে বিপাকে পড়ে যাব, কল্পনাও করতে পারিনি। আমার বাবা অনেকটা গুরুগম্ভীর ও রাশভারী চাপা স্বভাবের। জন্মের পর থেকে আমি বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম। মায়ের ক্ষেত্রে ঠিক ওল্টো। কোনো কারণে বাবা আমার প্রতি রেগে গেলে দৌড়ে মায়ের আঁচলে মুখ লুকাতাম। মা ঠিকই আমার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। অথচ আজ সেই বাবাকেই কত অসহায় লাগছে। মাকে হারিয়ে কেমন জানি শিশুর মতো হয়ে গেছেন। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে, সেটা বোধহয় মায়েরও কোনোদিন জানার সৌভাগ্য হয়নি। বাবার গুরুগম্ভীর রুক্ষ চাপা স্বভাবের নিচে এতদিন সেটা চাপা পড়ে ছিল। এখন একমাত্র আমিই বাবার সবকিছু দেখাশোনা করি। রাতের বেলায় বাবা মাঝে মধ্যে বাইরে ছুটে যেতে চায়। ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘খোকারে তোর মা ওই নির্জন একাকী জায়গায় কিভাবে থাকবে? চল আমাকে নিয়ে চল।’ বাবার কথায় আমার বুক ফেটে কান্না নেমে আসে। শুধু ছোট্ট করে বলি, ‘বাবা, তুমি শান্ত হও, ধৈর্য ধারণ করো! আমার মা ওখানে খুব সুখে আছেন, শান্তিতে আছেন।’ কথা শুনে বাবা শিশুর মতো আমার বুকে মুখ লুকায়। হু হু করে কেঁদে ওঠেন। আমিও বাবাকে শক্ত হাতে প্রগাঢ় ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরি। মাকে হারিয়েছি চিরকালের মতো। একবুক চাপা অভিমান ও কষ্ট নিয়ে নিজেকে কোরবানি করে দিয়েছেন। কিন্তু বাবাকে আর অত সহজে হারাতে চাই না। তিনিই এখন আমার মাথার ওপর দোচালা ছাদের অবশিষ্ট একমাত্র ছাদ। বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয় ও অবলম্বন।

 


আরো সংবাদ



premium cement