২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদ আন্তর্জাতিক উৎসব

-

ঈদ আন্তর্জাতিক উৎসব। প্রতি বছর আনন্দ ও খুশির বার্তা নিয়ে এ উৎসবের আগমন ঘটে। এ আনন্দ-উৎসব জাতি-ভৌগোলিক গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়ে থাকে। এতে সব দেশের ও সব পেশার মুসলমানের অংশগ্রহণের সমান অধিকার আছে। নির্দিষ্ট কোনো দেশ-জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য নেই ঈদের আনন্দ-উৎসবে। অধিকন্তু গরিব-অসহায় মুসলিমদের এ আনন্দ-উৎসবে সম্পৃক্ত করতে ধনী-বিত্তবানদের উৎসাহিত ও বাধ্য করা হয়েছে। তাই ধনীর অট্টালিকার পাশাপাশি দরিদ্রের জীর্ণকুঠিরেও ঈদের আনন্দ সমীরণ প্রবাহিত হয়ে থাকে। তবে ভৌগোলিক ব্যাপকতায় ও সংস্কৃতির ভিন্নতায় বিভিন্ন দেশে এ উৎসব উদযাপিত হয় নিজস্ব আঙ্গিকে।
পুণ্যময় ঈদ উৎসবে মুসলমানদের মহাসম্মিলন ঘটে। সব মুসলিমের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে বিশ্বের বিভিন্ন ঈদগাহে কিংবা মসজিদে একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে এ সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এতে ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, অধিবাসী-অনাবাসী সব মুসলিমের অংশ নেয়ার বিধান আছে। জেলে-কুমার, তাঁতি-কৃষক, ধোপা-মুচি, প্রভৃতি ভাষা-বর্ণের বৈষম্য-ভেদাভেদ নেই এ মহাসম্মিলনে। বিশ্বের যেকোনো মুসলিম উপস্থিত হতে পারেন যেকোনো ঈদের ময়দানে। এতে সারিবদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন অবনত মস্তকে। অধিকন্তু হাতে হাত, বুকে বুক রেখে পরস্পর কোলাকুলি করেন পরম মমতা নিয়ে। পুরনো দিনের হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মুসলমানেরা পরস্পরে আবদ্ধ হন ভালোবাসার বন্ধনে। ঐক্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুসংহত হয় ঈদের পবিত্র উৎসবে।
জামাতে নামাজ আদায় ঈদ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ। আর ইমাম বা খতিবের ভাষণ ঈদ জামাতের অপরিহার্য অঙ্গ। মুসলিম সমাজের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা এ ভাষণের মূল লক্ষ্য। ধর্মীয় অনুরাগ-অনুভূতি, সামাজিক শিষ্টাচার-সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক সহনশীলতা, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য। মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সামগ্রিক বিষয় উল্লেখ করে জাতীয় চেতনার জাগরণ এ ভাষণের বৈশিষ্ট্য। এ ভাষণে কোনো নেতা-নেত্রীর বন্দনা নয়, দলীয় কোনো স্লোগান নয় বরং মহান স্রষ্টার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়। এ সময় দেশ-জাতির বিভাজন নয় বরং মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের সুর ধ্বনিত হয়। ভৌগোলিক দূরত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অনৈক্য, সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও সব মুসলমান ঈদের জামাতে একত্র হয়। এতে ঐক্যবদ্ধভাবে মহান আল্লাহর স্তুতি-মাহাত্ম্য গাওয়া হয় এবং মুসলিমসহ সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য শান্তি-সমৃদ্ধি চাওয়া হয়। অধিকন্তু নির্যাতিত-বঞ্চিত মুসলিমদের জন্য দোয়া করা হয়। এ সময় সমবেত কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে ঈদের ময়দান মুখরিত হয়। সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি ঈদগাহে ঈদ উৎসবের একই রকম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়।
ঈদ উৎসব মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতি ও সংহতির প্রতীক। সুস্থ বিনোদন ও আনন্দ উপভোগ ঈদ উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তাই ঈদের উৎসবে আনন্দ-খুশিতে মেতে ওঠে গোটা মুসলিম বিশ্ব। এ উৎসব উদযাপনে নেই কোনো শ্রেণি-বৈষম্য। কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতি, কামার-কুমার, ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা ঈদ উৎসবে অভিন্ন। সৌহার্দ্য-সদ্ভাব এ উৎসবের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সহমর্মিতা-ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করা ঈদ উৎসবের উদ্দেশ্য। সম্মিলিতভাবে মহান আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন এ উৎসবের লক্ষ্য। তাই সক্ষম ও বিবেকসম্পন্ন বিশ্বের সব মুসলিমের এ উৎসবে অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
ঈদ আন্তর্জাতিক উৎসব হলেও এতে স্থানীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব আছে। ঈদের মূল চেতনা ও মৌলিক বিধানাবলি অপরিবর্তিত রেখে স্থানীয় সংস্কৃতিতে উৎসব করা যেতে পারে। তাই দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপিত হয় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে। বাঙালি মুসলমানরা সকালে সেমাই-পায়েস ও অন্যান্য মিষ্টান্নজাতীয় খাবার খেয়ে ঈদগাহে যান। আর বিকেলে বা রাতে গোশত-খিচুরি, পোলাও-কোরমা ইত্যাদি মুখরোচক খাবার খান। ঈদের দিন সাধারণত বাঙালি পুরুষ ও ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং নারীরা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে ঈদ উদযাপিত হয় বাঙালি সংস্কৃতিতে। এমনিভাবে মালয়েশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ, সৌদি আরব ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করেন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। অধিকন্তু কালপরিক্রমায় ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কারণে ঈদ উৎসবের ধরনেরও পরিবর্তিত হয়েছে। প্রায় ১৪ শ’ বছর আগে অর্থাৎ ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় প্রবর্তিত ঈদ উৎসব কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের রূপ ধারণ করেছে।
ঈদ উৎসবের সূচনা হয় হিজরি দ্বিতীয় সন অর্থাৎ মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছর থেকে। জাহেলিয়া যুগে আরবের মক্কায় ‘উকাজ মেলা’ এবং মদিনায় ‘নিরোজ’ ও ‘মিহিরগান’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। আর সেসব অনুষ্ঠানে লোকজন অশ্লীল আনন্দ-উল্লাস করত। মদিনায় আগমনের পর মহানবী সা: এসব ক্ষতিকর ও অশ্লীল বিনোদনমুক্ত মুসলমানদের জন্য আলাদা আনন্দ-উৎসবের প্রয়োজন মনে করলেন। এ জন্য তিনি মুসলমানদের নির্মল আনন্দ উৎসব করতে মহান আল্লাহর নির্দেশিত বিধানে বছরে দু’টি ঈদ উৎসবের প্রবর্তন করেন। একটি ‘ঈদুল ফিতর’ বা রোজার ঈদ অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’ বা কোরবানির ঈদ। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলমানদের ধৈর্য-ত্যাগ ও নৈতিক-আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়। এতে তাদের মনে এক স্বর্গীয় সুখ-আনন্দ বিরাজ করে। এ মহান সুখানুভূতি উৎসবে রূপ লাভ করে পবিত্র ঈদুল ফিতরে। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মানুষের পরিবর্তে পশু কোরবানি করার বিধান করায় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশিত হয় পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসবে। মদিনায় প্রবর্তিত ঈদ উৎসব বর্তমানে প্রায় সারা বিশ্বেই বিস্তৃত হয়েছে। আর বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা এ আনন্দ-উৎসব করেন নিজস্বভাবে।
বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্য সুসংহত করা আন্তর্জাতিক এ উৎসবের প্রধান দীক্ষা। পারস্পরিক সহমর্মিতা-সহানুভূতি জাগ্রত করা এ উৎসবের বিশেষ শিক্ষা। ধনীদের পাশাপাশি দরিদ্রদেরও ঈদের উৎসব-আনন্দে সম্পৃক্ত করার জন্য ইসলামি বিধানে বিত্তশালীদের ওপর ‘সদকাতুল ফিতর’ আদায় অপরিহার্য। শুধু অসহায়-দরিদ্র মুসলমানরা এ সদকাতুল ফিতরের প্রাপ্য। বিশ্বের সব মুসলিমের জন্যই এ বিধান প্রযোজ্য। আর বিশ্বের সব মুসলিমকে ঈদের উৎসবে সম্পৃক্ত করা এর উদ্দেশ্য। ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অধীনস্থ সদস্যদের সদকাতুল ফিতর আদায় করার দায়িত্ব পরিবার প্রধানের। সদকাতুল ফিতর আদায় ও গ্রহণের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা-সহানুভূতি জাগ্রত হয়। আর কোরবানি করে তার তিনভাগের একভাগ গরিবদের দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ‘মুসলমান পরস্পর ভাই’ মহান আল্লাহর এ ঘোষণা ঈদের দিনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। ভেদাভেদ ভুলে এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে বুকে টেনে নেয় আন্তর্জাতিক এ আনন্দের দিনে। পারস্পরিক উপহার-শুভেচ্ছাবিনিময় ঈদ উৎসবকে প্রীতিময় করে তোলে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকদের শুভেচ্ছাবিনিময় আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ-সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এতে বৈশ্বিক শান্তি-সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য-সংহতি বাড়ে। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও ঈদ উৎসবের প্রভাব পড়ে। কারণ মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ঈদ উপলক্ষে ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেন বেশি হয়ে থাকে। অধিকন্তু সাম্প্রতিক ঈদ মওসুমে মুসলিম দেশসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটন-পরিবহন শিল্প চাঙা হয়ে ওঠে। এ ছাড়া ঈদ উৎসবে মুসলিম বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে নতুনমাত্রা যোগ হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ঈদ মুসলিম ঐক্য-সংহতির এক বৈশ্বিক উৎসব। বিশ্ব স্রষ্টা-নিয়ন্ত্রক মহান এক আল্লাহর সন্তুষ্টি-সান্নিধ্য এর লক্ষ্য। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব-শান্তি-সৌহার্দ্য এর উদ্দেশ্য। শোভনীয়, মোহনীয়, অতুলনীয়, অপরূপ এর দৃশ্য! আর বিশ্ব সভ্যতায় ঈদ উৎসব অনন্য!

 


আরো সংবাদ



premium cement
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ১২ উপজেলায় মানববন্ধন রোববারই খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবার ক্লাসসহ ৪ নির্দেশনা ময়মনসিংহ ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ঈদ পুনর্মিলনী বাস্তবায়নের আহ্বান ৩ গণকবরে ৩৯২ লাশ, ২০ ফিলিস্তিনিকে জীবন্ত কবর দিয়েছে ইসরাইল! মৌলভীবাজারে বিএনপি ও যুবদল নেতাসহ ১৪ জন কারাগারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট কারীদের চিহ্নিতকরণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ১২ দলীয় জোটের কলিং ভিসায় প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরার সময় মারা গেল মালয়েশিয়া প্রবাসী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিবকে আটকের অভিযোগ হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলে কার্গো জাহাজডুবি : একজন নিখোঁজ, ১১ জন উদ্ধার হঠাৎ অবসরের ঘোষণা পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়কের বগুড়ায় গ্যাসের চুলার আগুনে বৃদ্ধা নিহত

সকল