১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

থ্যালাসেমিয়া যখন ঈদের আনন্দ ম্লান করে

-

আনিকা। বয়স দশ। তিন দিন ধরে গায়ে জ্বর। বাবা-মা প্যারাসিটামল খাওয়াচ্ছেন। ভাবছেন আর মাত্র পাঁচ-ছয় দিন পরেই তো চেকআপে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল ঈদের দিন সকালেই। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই জ্বর বেড়ে এক শ’ পাঁচ। কিছুতেই নামছে না। একপর্যায়ে খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল। বাধ্য হয়েই ঈদের দিন সকালে সিএনজি ডেকে আনিকাকে হসপিটালে নিতে হলো। আনিকা থ্যালাসেমিয়া মেজরের রোগী। প্রায় প্রতি মাসেই রক্ত নিতে হয় আনিকাকে। এসব ইতিহাস জানার পর হসপিটালের ডাক্তারেরা আনিকার ব্যাপারে আরো সতর্ক হয়ে গেলেন। বললেন, ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে। কারণ আনিকার শরীর খুবই দুর্বল। ঝটপট রক্ত পরীক্ষার পর দেখা গেল হিমোগ্লোবিন কমে মাত্র ছয় গ্রামে (পার ডিএল) এসেছে। জ্বরের মধ্যে রক্ত দিতে গেলেও অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। আনিকার বাবা-মা দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এ জন্যই আনিকার থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগটি হয়েছে। বাবা-মা একজন বাহক হলে রোগের তীব্রতা কম থাকে। এ জন্য এখন সব অঙ্গন থেকে আওয়াজ উঠেছে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করুন। আনিকার মতো এত অসুস্থ সন্তান জন্মদান থেকে আগেই সচেতন হোন। আনিকার লিভার, প্লীহা সবই স্বাভাবিক আকারের চেয়ে অনেক বড়।
আগে দুই তিন মাস পর পর রক্ত নিলে চলত। কিন্তু এখন এমনও হয় যে, মাসে দু’বার রক্ত নিতে হয়। কাশি সারা বছর লেগেই থাকে। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। ক্লাসের পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে পারে না। ঘন ঘন জ্বর আসে। দুই পা হাঁটাহাঁটি করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ঠিকমতো খেতেও পারে না। আনিকার মা সারাক্ষণই নীরবে কাঁদেন। কেন এমন হলো? আনিকার মায়ের ধারণা, উনি জীবনে এমন কোনো অন্যায় করেছেন যার জন্য চোখের সামনে আনিকা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে আর ওনাকে দেখতে হচ্ছে। কষ্টে কষ্টে মাঝে মধ্যে মনে হয় আনিকার মায়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিয়মিত চেকআপের পরেও আনিকা সারা বছরই প্রায় একটা-না-একটা সমস্যায় ভুগতে থাকে। আনিকার ছোট বোনটিও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। তবে তীব্রতা কম। সেটাকে বলা হয় থ্যালাসেমিয়া মাইনর। বছরে দু-তিনবার রক্ত নিলে চলে। আনিকার বাবাও আস্তে আস্তে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সাইকোলজিস্টের কাছে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে। রাতের পর রাত ঘুম আসত না। কারণ ছাড়াই বুকে প্রায়ই ব্যথা করত। এখন দু-তিন পদের ওষুধ খেতে হয়। তার পরেও মাঝে মধ্যে ইচ্ছা হয় চিৎকার করে কাঁদতে। এই সমস্যার কি কোনো সমাধান নেই? আমাদের দেশে কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
নিপা, বয়স ২৭। মাত্র চার মাস হলো বিয়ে হয়েছে। চাকরিতে ঢুকেছে বছরখানেক হলো। অ্যাকাউন্টিংয়ের কাজ। একটু তো নড়াচড়া করতে হয় অফিসে। এ টেবিল ও টেবিলে খোঁজখবর নিতে হয়। কিন্তু বেলা গড়ানোর সাথে সাথে শরীরটাও ঝিম মেরে আসে। একটুতেই ক্লান্তি লাগে। মাঝে মধ্যে দম নিতে কষ্ট হয়। মাথাটা ধরে থাকে। ইদানীং ক্লান্তিটা আরো বেড়ে গেছে। বাসায় যেতে যেতে রাত গড়ায়। তখন সম্পূর্ণ দেহ যেন অবশ হয়ে আসে। এক কাপ চা-ও বানিয়ে খাওয়ার শক্তি পায় না। এর মধ্যে আবার নতুন সংসার। কিছু কাজকর্ম তো করতেই হয়। নিপা ওর স্বামীকে সব কিছু খুলে বলায় দু’জনে সিদ্ধান্ত নেয় দুর্বলতার জন্য ডাক্তারের কাছে যাবেন। ডাক্তার বললেন, নিপার রক্তশূন্যতার জন্য এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সাত দশমিক পাঁচ। অন্তত দই ব্যাগ রক্ত এক্ষুনি দিতে হবে। নিপা ভয় পেয়ে যায়। কেবল বিয়েশাদি হলো, বেবি নেবে; সামনে একটি নতুন জীবন অপেক্ষা করছে। হেসেখেলে জীবনটা কাটাবে কিন্তু শরীরে এ আবার কী অসুখ বাসা বাঁধল? নিপা ভয় ও টেনশনে কেঁদে ফেলে। ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে পরপর দুই দিন দুই ব্যাগ রক্ত শরীরে নেয়। ডাক্তার আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন। হঠাৎ করে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা এত কমে যাওয়ায় ডাক্তার আনুষঙ্গিক কিছু পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ে নিপা থ্যালাসেমিয়া মাইনরের রোগী। এদের শরীরে পর্যন্ত রক্ত তৈরি হয় না।
সবসময় একটা ক্লান্তি ভাব লেগেই থাকে। এই থ্যালাসেমিয়ার বাহক যদি নিপার স্বামীও হয় হবে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বেবি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হবে। ডাক্তার নিপার স্বামীর রক্তেরও পরীক্ষা করতে দেন। রিপোর্টে দেখা গেল নিপার স্বামী থ্যালাসেমিয়া মাইনরের বাহক। স্বামী স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয় তখন তাদের সন্তানের মেজর থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগ এবং সুস্থ বেবি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে মাত্র শতকরা পঁচিশ ভাগ। এ জন্য কেউ একজন যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তাহলে অবশ্যই জীবনসঙ্গীর রক্তের পরীক্ষা করবেন। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্মের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। থ্যালাসেমিয়া রক্তের একটি রোগ। এর নির্দিষ্ট কোনো কোনো চিকিৎসা না থাকলেও রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পারলে সমস্যা কম হয়। তার পরেও এদের শরীরে মাঝে মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। কারণ ছাড়াই মাঝে মধ্যে এমন দুর্বল লাগে যে স্বাভাবিক কাজকর্মও করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঘন ঘন কাশিতে ভোগেন। অনেক মহিলার মাসিকে রক্তক্ষরণ বেশি হয়। এমনও হয় যে মাসে মাসে রক্ত নিতে হচ্ছে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার জন্য। এ জন্য যাতে এ রকম সমস্যায় পড়তে না হয় সে জন্য আগে থেকেই সতর্কতা জরুরি। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিও জরুরি। সুস্থ জীবনের জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। থ্যালাসেমিয়ার নতুন বাহক যেন আর না সৃষ্টি হয় সে জন্য সেভাবে রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। যেমন বিয়ের আগে দুজনেরই রক্তের চেকআপ করিয়ে নিতে পারেন। আনিকার মতন আর একটি শিশুও যেন ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয় সে জন্য সবার মধ্যেই সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সবাই সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন। আনিকার জন্য দোয়া করুন। ঈদ আনন্দ যেন আনিকাও উপভোগ করতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল