২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদুল আজহা কবিতাবলী

-

আসাদ চৌধুরী
কোথায় যাই আমি

কিভাবে কথা বলে পুষ্প ভুলে গ্যাছে।
তাহলে এই ভর সাঁঝের মুহূর্তে
কোথায় যাই আমি?

মাঝারি প্রতিভার তুমুল হুঙ্কারে
কাঁপছে দশদিক।
হাতি ও আরশোলা কেবল প্রতিযোগী
বাঘ ও সিংহের অনুপস্থিতি
প্রশ্ন রাখে মনে
তবে কি পলাতক সাহসী পশুরাজ?

ওষ্ঠহীন এক বেয়াড়া শিল্পীর
বশ্য বংশীতে আনাড়ি কসরত
কোথায় যাই আমি?

জোসনা গায়ে মেখে পোকার সংসারে
কী করে ঢুকলে হে শুদ্ধ প্রজাপতি?

কিভাবে কথা বলে পুষ্প ভুলে গ্যাছে,
এ ভর সন্ধ্যায় কোথায় যাই আমি?

 


সানাউল হক খান
জেদ ও জীবন

‘জেদের মূল্য জীবনের চেয়ে কখনোবা বেশি’
চমৎকার কথাটির জন্য আ-নতশির ধন্যবাদ তোমাকে, মনি
জীবনের কী এমন মূল্য
জেদ ছাড়া জীবন তো কচুপাতার ওপর এক ফোঁটা জল
টলছে তো টলছেই, যে কোনো মুহূর্তেই নিঃশব্দে, নীরবে, নিভৃতে....
জেদ আছে বলেই শব্দেরা এমন প্রতিযোগিতায়;
কে কার আগে যাবে, আগে পাবে
মুকুটে নতুন পালক বসাবে-
মাল্য নেবে, কপালে তিলক পরবে,
তুমুল হাততালিতে রক্ত আরো জেদি হবে
আরো-আরো প্রভু আরো... আরো...

জেদ না-থাকলে আমি কি মাঠে যেতাম
টিভি খুলে হাতের এমন ফাটাফাটি হতো?
কবিতা পাঠের আসরে যেতাম কিংবা সঙ্গীতের আসরে?
লতা-সন্ধ্যা-হেমন্তদের গান শুনতাম, বন্যার কণ্ঠে কসরৎ শুনতাম
.... তারই সে আড়ালে চরণ বাড়ালে ডোবালে সে সুধা সরসে
জীবনসীমাবদ্ধ, জেদ অপরিহার্য, দশ-দিগন্তের অনাবিষ্কৃত ক্রোধ
মনি, তুমি কি বুঝেছ কী-বললাম জেদের অগ্নিপরশে?
জেদ আর জীবন চিরকাল অলঙ্ঘিত ঋণশোধ


ইমরুল চৌধুরী
আমার ফ্লাইওভার নেই

যে রাস্তায় সচরাচর আমার গমনাগমন
সেখানে নির্মিত হয়েছে ফ্লাইওভার
আমার মাথার উপর থেকে এখন স্বচ্ছ আকাশ উধাও
এমনকি বর্ষা-বাদলে-বৃষ্টিস্নাত হবো এমন আশঙ্কাও নেই
আমি একধারে যেমন আপ্লুত তেমনি বিষণœ
কেননা ওই ফ্লাইওভার আমার যাতায়াতের পথ নয়
সেখানকার ধাবমান শকটগুলোর সঙ্গে
আমার শ্লথ গতির তুলনা চলে না

অথচ গতিই যে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য
এই উপলব্ধির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততায়
একদা আমি ফ্লাইওভারে চড়েছিলাম
মনে হয়েছিল যেন নির্ভার শূন্যতায় চেপে বসেছি
আমার চোখের সামনে যা কিছু ছিল চক্ষুস্মান
বলা যায় ফ্লাইওভার বলতে কিছু দেখিনি
আমি যেন নীলিমাকে নখাগ্রে খুঁটে খুঁটে দেখছিলাম

শাহরিক ফ্লাইওভার অবতরণ ক্ষেত্রে গিয়ে চালু হয়ে যায়
যে ফ্লাইওভার দিয়ে আমার দ্রুতযান শোঁ শোঁ করে যাচ্ছিল
গতির আনন্দে আমি এতই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম যে
আমারও যে অধোগতি আছে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম

পতনমুখী নয় এমন আনন্দে যখন আবিষ্ট
হঠাৎ মনে হলো আমার শকটে কোনো আরোহী নেই
এমনকি দক্ষ চালকও অপস্রিয়মাণ
জানি না আমি একাকী কোথায় শূন্যতা চিরে চিরে যাচ্ছি
অথচ আমার চতুষ্পদ যানে আদৌ যে গতি ছিল না
তখন বুঝতে পারিনি

 


হাসান হাফিজ
বিদায়ের আসন্ন সানাই

ডর লাগে মরণের ডর
অনিচ্ছায় ছেড়ে যাবো প্রিয় বাড়িঘর,
একলা নাও মাঝগাঙে বৈঠা হাল কই
পৌঁছানো সম্ভব তীরে
এরকম আশা ভরসা সামান্যইÑ
ডর লাগে, স্বীকার করার মধ্যে
শরমের প্রশ্ন কেন ওঠে
প্রস্থানের পরেও কী আশ্চর্যরকম সত্য
ঠিকঠাকই চন্দ্র সূর্য
স্বাভাবিক ওঠে!

 


জাহাঙ্গীর ফিরোজ
যে আমায় ভাবিয়েছে

চম্পক বনে নিকষ আঁধার নামে
গাঢ় নীল যন্ত্রণায় পাখি
আঁধারে হারায় পথ ভালোবেসে;
ভালোবাসা কোন দিকে?
যে আমায় ভাবিয়েছে
ঘুমের ভেতর থেকে জাগিয়েছে
তাকে ছাড়া জীবন! জীবন নয়।

 

শাহীন রেজা
কাকরঙ জলে জ্বলে পূর্ণিমা

বলছিলাম, কাকরঙ কবিতার কথা।

তুমি ক্ষেপে গিয়ে জানতে চাইলে, কবিতার আবার রঙ আছে না’কি?
সেদিন সেই বাগানে আমরা ছাড়াও ছিল দুটি

ডানাভাঙা কবুতর এবং মাথানত দুধরাজ।

তোমার প্রশ্ন শুনে তারাও উদগ্রীব।

আমি বললাম, কালোর নির্যাস থেকে আলো আসে ভালো আসে।
কবিতা তো ভালোর প্রতীক আলোর আধার।

কাকরঙ জলে জ্বলে পূর্ণিমা।

তোমার বিস্মিত চোখে খ্যাপা ব্যোমকেশ।

কবুতর উড়ছে, দুধরাজের মাথা আকাশ ছুঁইছুঁই।

 


ফজলুল কাশেম
বালিকার চিঠি

রক্ত দিয়ে লিখলাম চিঠি
রঙ হবে খুব লাল
মন খারাপের আর কী বাকি
সেই তো হলো কাল।

রাঙা রেখা শিউলি বোঁটার মতো
পানসে কেন হয়
তার উত্তর জানা নাই
সেকি আমার পরাজয়?
তুমি শাদা মনের ‘শানু-বিবি’ হয়ে
একটিবার হৃদয় খুলে শোনো
তবে কি তোমার প্রেমে
ঘাটতি আছে কোনো?

 

সৈয়দ রফিকুল আলম
আগ্রাসী প্রতিযোগ

বাঘে মহিষের বুনো যুদ্ধ চলে বীরত্ব শক্তির আগ্রাসনে
আজ বারুদ কুণ্ডলি গন্ধে বজ্র নির্ঘোষ তাণ্ডবে ধসে পড়ে
হতোশ্বাস মিশুকের বিভ্রম করুণা চোখে অশ্রুকণা ঝরে
আগপিছে শূন্য শুধু পথের পাথেয় ঘুরে অনিশ্চল মনে।

গ্রিসিয় মিথিক হতে ক্ষীণ ব্রহ্মাণ্ড সূতিকাগারে আগ্রাসনে
ক্রমাবর্তন কৌশল মেকানিজমে বোতাম স্পর্শের বশংবদ
সভ্যতা ও প্রগতির সত্যনিষ্ঠা বিধ্বংসী দূষণ হাওয়ায় অর্বুদ
অধুনা ডেবিলিজম প্রকটে ভাস্কর মর্মন্তুদে লেলিহান।

গডজিলা শ্বাসের জ্বালামুখী মূর্তিমান সাদৃশ্যের অশ্রু
কোথায় বা পাবে তারা মিশুকে উদ্বেগহীন আনন্দ পরমা?
ঘরে ও বাইরে নিত্য ভর করে হৃৎপিণ্ড সঞ্চালনে অমা
কাক্সিক্ষত আশার দীপ মৃতঘোড়া, পায়ের জমিনে ঝরে সাশ্রু।

প্রভাব বিস্তারী স্বার্থে উন্মাদে আকুল বিশ্ব, দাপটে তুরুপ
ধ্বংস হোক রক্তলাল লাশের মিছিল, অমানবিক স্বরূপ।

 

মোশাররফ হোসেন খান
শরত সকালে

অতি শৈশবেই শরতের চাঁদ-ধোয়া জোসনা
পান করানোর অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন আমার
প্রাজ্ঞ পিতা।
সেই থেকে প্রতিটি শরতেই আমি সেটা পান করে আসছি।
এ এক অব্যক্ত, বিরল অনুভূতি!
যা কেবল কবিরাই অনুভ করতে পারেন।
সেই শৈশব-কৈশোর থেকেই ক্রমাগত হাঁটছি।
কখনো গন্তব্য স্থির করতে পারিনি।
কিন্তু এই শরতে, চাঁদ-ধোয়া জোসনা পান করতে করতে
আমি আমার গন্তব্য স্থির করে ফেলেছি।

যেখানে যাচ্ছি, সে-পথ যদিও বন্ধুর!
সেখানে যেতে হলে পার হতে হবে আগুনের দরিয়া
টপকাতে হবে বরফের পর্বত
আঁধারের গুহা পেরিয়ে, স্থাপিত সর্পিল ফণা উপেক্ষা করে
সেখানে পৌঁছুতে হবে।

আমার গন্তব্য যেহেতু স্থির, সুতরাং এখন কোনো
বাধা কিংবা শঙ্কাই আমাকে আর তাড়িত করে না।

এইতো চলেছি নিঃশংসয়ে আমার গন্তব্য পথে
আর শরতের শিউলি-ভেজা শিশির
আমার দু’পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে!

 


খুরশীদ আলম সাগর
কে ডাকে কাছে আয়

যখন তোমার কথা ভাবি হৃদয়ে কাতরতা বাড়ে,
পূর্ণিমা চাঁদ যেন আড়াল হয়ে থাকে ঐ বাঁশঝাড়ে।
গানের পাখিরা সুর তুলে না আজ কোনো মতে,
বিরহ অমানিশা ঝুলে আছে প্রকাশ্য রাজপথে।

চলার পথে টলে না পা হয়ে গেছি রাশভারী,
অসময়ের রোদ খোঁচা দিয়ে যায় যেন তরবারি।
গভীর রাতে ইঁদুর খোঁজে না সাহসী বিড়াল-চোখ,
বালিশে মাথা রেখে ঘুমায় সিঙ্ঘ-সবল লোক।

কোথায় পড়ে গেছে কে জানে সিংহ-দরজার চাবি,
আলমারিতে হাওয়া-মিঠাই ফ্রিজে ঠাঁসা দাবি।
ধার করা সিগারেট ফুঁকি রিং-কুণ্ডলি,
শকুন উড়ে যায় ঠোঁটে নিয়ে মরা মানুষের ঠুলি।

তোমার জন্য তীব্র রোদন দরজায় লাগাইনি খিল,
ঝড়গতি পেছনে ফেলে এগিয়ে থাকে স্বপ্ন মিছিল।

 


শাহাজাদা বসুনিয়া
হৃদয়াশ্রম

তুমি ছিলে চঞ্চলতার সন্ধিক্ষণে
আমি ছিলাম বিবেকের দংশনে।
সকালে আমাদের অভিসার
বিকেল গড়িয়ে গেল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো
চৈতন্যের অলস বেলায় আমাদের অভিযাত্রা।
নিকষ অন্ধকারে আলো চাই
আলো চাই, আরো আলো চাই
আলোকিত হতে চাই।
অন্ধকারে ফুটে উঠুক রজনীগন্ধা
উপহার !
হাত বাড়িয়ে দাও, হাতের ওপর
তুলে নাও রজনীগন্ধা।
হৃদয় গহিনে যাতনা যত
গন্ধ-সৌরভে দূর হোক তত।
বিশুদ্ধ ভালোবাসা এখন সর্বত্রে
নিখুঁত ভালোবাসা এখন সর্বাগ্রে।
চৈতন্যের অলস বেলা কেটে যাক
ময়ূর মেলে দিক তার পেখম
পাখার বিচিত্র রঙে শোভিত হই
রঙ্গিলা হই তুমি আর আমি।
সূর্য উঠেছে আবার
চন্দ্র আলোকিত চৈতন্যের অলসে
তোমার চঞ্চলতার সন্ধিক্ষণে
আমার বিবেকের দংশনে
হৃদয় উড়ে উড়ে চলে আকাশে।

 


শাশ্বত হাসান
এই শহরে

অচেনা শহর, আমি এক অচেনা অতিথি
আমি বার বার যাই মতিঝিলে
কিন্তু আগের মতো না।
অচেনা শহর।

মোরগের গলাকাটা লাশ দেখি
রক্ত ঝরে, পিচঢালা পথে
ফোঁটা ফোঁটা।
আমি এই শহরের এক অচেনা অতিথি।

আমাকে কেউ চেনে না, এখানের বাতাস,
রিকশা, রাস্তা
মনিরের চায়ের দোকান।
কিংবা অশ্বঙ্খ বৃক্ষটা।

হায় প্রেস ক্লাব, শাপলা চত্বর, দোয়েল চত্বর
সাবদার সিদ্দিকী কোথায় গেলো?
তার ছালার চটের আলখেল্লা পড়ে আছে।
সম্মুখের রাস্তা যেন গ্রীষ্মের দুপুর।

আমি এই শহরের অচেনা এক বাউল অতিথি
বুলবুল ভাই, তুমি কোথায়?
আবুল হাসান হারিয়ে গেছে
রাস্তায় অশ্রুধারা বহে।

আমি এখনো রয়েছি তবু।


আবু হেনা আবদুল আউয়াল
রিমান্ডে নেবার ফলে

রিমান্ডে নেবার ফলে
স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল-
কবিতাটি তিনি একা একাই লিখেছিলেন
রাতে- মোমবাতির আলোয়, কবিতার
ভেতরের অকবিতাটুকু অলঙ্কার
দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল বিশেষ কারণেÑ
জেলের ভেতরে বসে
তার মনে পড়ত নজরুল নেরুদা
মলয়সী নাজিম হিকমতের কথা
তেল নুন চাল ডাল তাকেও বাজার থেকে
কিনে খেতে হয়, বাজারের আগুনে পুড়েছে
ক’বার তার টাকাভর্তি জেব
মতিভ্রম ঘটেনি কখনো তার, তিনি
অকপটে বলে গেছেন যা সত্য তা

রাত পেরোলেই ভোর হয় না কখনো কখনো-
কখনো কখনো রাতের পরেও রাত আসে

 


রফিক হাসান
নিরাপদ প্রেম চাই

প্রতিটা নিঃশ্বাস ফেলে মৃত্যুর মুখোমুখি সবাই
এভাবে দিনে শতশত বার আমরা মরে যাই
শ্বাস টেনে ফের বেঁচে উঠি, জীবন এগিয়ে চলে
কদমে কদমে বিপদ ভেঙে, নিরাপদ কথাটা
অর্থহীন, কোনো দিন কোনো জিনিস বিপদমুক্ত
ছিল না, থাকবে না, নয় কেউ শঙ্কাহীন, স্বাধীন

ধ্যানমগ্ন হলে খেয়াল প্রশ্বাসের দিকে, গভীর
নিরীক্ষণ, গ্রহণ বর্জন, একবার গেলে ফিরে
আসবে তো! ভ্রু-মধ্যে ভিড় করে সব কোলাহল
জানি না কোথা থেকে আসে ক্ষমতা, চালায় শরীর

ভালোবাসার পথ নয় সহজ, সরল, ভীষণ
কঠিন, কেবলই আঁকাবাঁকা চড়াই উৎরাই
নিরাপদ সড়ক বানিয়ে কী হবে? যাবো কোথায়?
পথ নয়, এবার নিরাপদ প্রেম হোক প্রার্থনা

 

 

সবুজ আহমেদ
ঈদ আনন্দের আবেদন

ঈদের চাঁদ দেখে মনের ময়লা অপসারণ হয়ে যাক
ধরার ধুলোয় আঁধার ঘোচে ধেয়ে আসুক শান্তির সুবাতাস
উদয় হোক সূর্যের অবসান হোক নিঝুম কালো দীঘল রাতের
ত্যাগের মহিমায় মুমিনের নফস নীলচে পাহাড়ের উঁচুতে চড়–ক
আবেগে নয় ভোগের ব্যাকরণ ছেড়ে সমুদ্র সেচে পরিশুদ্ধ হোক দু’চোখের জল
দেখবে অনাবিল আনন্দে গা ঘেঁষে স্বপ্নের উঠোনে নামবে নতুন জোছনা ঝাঁপি
বাগানে হাসবে কেয়া কদম যত পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে হবে সাফ
মানুষের মাঝে সৃষ্টি হবে সাম্য গাইবে গীত ধর্মের প্রতি জাগবে দরদ।


আরো সংবাদ



premium cement