২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সদা সত্য বলবে

অলঙ্করণ : হামিদুল ইসলাম -

পথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিমাকি করল মাহিন। তার এক হাতে কাঁটাঝোপ, অন্য হাতে ছেনি। এখন সকাল। সূর্য তেমন ওপরে ওঠেনি। তার স্কুলও শুরু হবে আরো দুই ঘণ্টা পর। পথে লোক চলাচল এ মুহূর্তে নেই। হাতের ছেনি দিয়ে দ্রুত গর্ত খুঁড়ে পথের মাঝামাঝি কাঁটাঝোপটা পুঁতে দিলো সে। তারপর দৌড়াল। আঙিনা পেরিয়ে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়াল সে। তার মা বললেন, কী ব্যাপার মাহিন, কী হয়েছে তোমার? এমন অস্থির দেখাচ্ছে! আচারের বৈয়ামটি কই? দেয়নি তোমার খালামণি? নাকি ক্যাচ খেলতে গিয়ে ওটারও সর্বনাশ করেছ?
আম্মু, আসলে আমি... । আসলে, আম্মু...।
মাহিন আমতা আমতা করল।
কী আমতা আমতা করছ? সত্যি বলো তো কী হয়েছে। আম্মু বিস্ময়ে বললেন।
মাহিন মনে মনে অনেকক্ষণ ধরে নেয়া প্রস্তুতি মতো বলতে লাগল, আম্মু হয়েছে কি, আমি আসলে খুব সাবধানেই বৈয়ামটা নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু খেয়ালই করিনি আজ ওই পথটার ওপর কে যেন এমনভাবে কা... আ...।
মাহিন কথা শেষ করতে পারল না। কারণ এটুকু বলতেই মাথার ওপরে ঘরের চাল থেকে ওদের পোষা টিয়া পাখিটা চেঁচিয়ে বলল, মাহিন, মাহিন, সদা সত্য কথা বলবে। কখনো মিথ্যা বলো না, মিথ্যা বলো না। টিউ! টিউ! টিউ-উ-উ! খুব চেঁচাতে লাগল টিয়াটা।
মাহিন ভয় পেয়ে থমকে গেল। ভাবল, নিশ্চয়ই এ পাখি দূর থেকে তাকে পথের ওপর কাঁটাঝোপটা পুঁতে দিতে দেখেছে। কাজেই তার কারসাজিটা ব্যর্থ হলো। অতএব এখন নতুন কিছু করা চাই। পাখি তাড়ানোর ছলে আবোল-তাবোল বকতে বকতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে। দূর থেকে দেখতে পেল বেশ কিছু মানুষ অদূরে দাঁড়িয়ে পথের কাঁটাঝোপটা দেখছে। কারো কারো পোশাকে কাঁটা লেগেছে সম্ভবত। কাঁটা রোপণকারীকে মনে হচ্ছে অভিশাপ দিতে দিতে চলে গেল তারা।
জায়গাটা এখন একেবারে নির্জন। ফাঁকা পেয়ে মাহিন দ্রুত চলে এলো পথটার ওপর। তার হাতে সয়াবিন তেলের বোতল। এবারে পথটার ওপর সয়াবিন তেল ঢেলে তড়িঘড়ি তার ওপর পায়ের তালু ও হাঁটু ঘষে নিল সে। তারপর দৌড়াল বাড়ির উদ্দেশে। আবারো সে তার মায়ের মুখোমুখি হলো। মা বললেন, কি মাহিন, কী হয়েছে আসলে? খুলে বলো তো।
আম্মু, আমি খুব সাবধানেই আসছিলাম বৈয়মটা নিয়ে। একটুও ক্যাচ খেলিনি। কিন্তু কারা যেন পথের ওপর তে...এ...।
মাহিন এবারো কথা শেষ করতে পারল না। টিয়া পাখিটা চেঁচিয়ে উঠল : মাহিন, মাহিন, কখনো মিথ্যা কথা বলো না। সদা সত্য কথা বলো। টিউ, টিউ! টিউ-উ-উ! টি-ই-র!
মাহিন এবার পেটব্যথার ভান করে দৌড়ে বাইরে চলে এলো। পথটার ওপর এসে দেখল আবারো লোকজন জটলা করছে। কেউ কেউ পথের ওপর সম্ভবত আছড়ে পড়েছিল। হাঁটুতে হাত রেখে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল তারা। মাহিন এবারে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে ভালোমতো লক্ষ করল চার দিকের গাছপালা বা শূন্যে কোথাও টিয়া পাখিটাকে দেখা যায় কি না। নাহ, কোথাও নেই পাখিটা। অতএব এ-ই সুযোগ যায়। পাশের ইটের স্তূপ থেকে কতগুলো ইট এনে বিছিয়ে দিলো সে পথের ওপর। বালুর ঢিবি থেকে কলাপাতা করে বালু এনে ইটগুলোকে ঢেকে দিলো। এখন দেখে মনে হবে ওগুলো যেন বালুর ঢিবি।
আবারো দৌড়ে বাড়ি এলো মাহিন। তার মাকে বলল, আম্মু, আসলে হয়েছে কি, কারা যেন ওই পথটার ওপর বা... আ... । এটুকু বলতেই রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠল টিয়া পাখিটা : মাহিন, কখনো মিথ্যে বলো না। সত্য কথা বলবে। টি, টিউ! টিউ! টিউ-উ-উ! অদ্ভুত চেঁচাচ্ছে টিয়া পাখিটা।
মাহিনের মা বিরক্ত হয়ে টিয়াটার দিকে চেয়ে বললেন, কী হয়েছেরে, টিউ? তুই কি কিছু জানিস? টিয়াপাখিটা কিছু না বলে চেঁচাতে চেঁচাতে উড়তে লাগল। সে বলছে, পথে-প-থে,প-থে। মাহিনের মা তার পেছন পেছন পথে চলে গেলেন। দেখলেন, পথে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। তারা একদৃষ্টে পথের দিকে চেয়ে আছে। সবাই বলছে, কে করল এমন মন্দ কাজগুলো? পথটার ওপর কাঁটা পুঁতেছে, তেল ঢেলেছে, ইট বিছিয়ে বালু ঢাকা দিয়েছে। টিয়াটা চেঁচিয়ে বলল, কে করেছে? মাহিন! মাহিন! মাহিন করেছে!
মাহিনের মা এবার সবকিছু বুঝতে পারলেন। তিনি দেখলেন কাচের বৈয়ামটা পথের পাশে ভেঙে চুরমার হয়ে আছে। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ছি মাহিন। একটা মিথ্যাকে ঢাকতে তুমি কতগুলো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছ। এতে করে কতজনের ক্ষতি হয়েছে। অথচ তুমি প্রথমেই সত্যিটা বলে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতে। সংশোধনের প্রতিজ্ঞা করতে পারতে। মনে রাখবে, সত্যকে কখনো মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। এতে বরং আরো বেশি ক্ষতি হয়। বেশি বিপত্তি হয়।
মাহিন কিছু না বলে তার মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। বলল, মা, আর ভুল হবে না। আর কখনো অমন ক্যাচ খেলব না। এ সময় টিয়া পাখিটা কোত্থেকে এসে মাথার ওপর উড়ে উড়ে বলতে লাগল, মাহিন, মাহিন, সদা সত্য কথা বলবে! সদা সত্য। টিউ! টিউ! টিউ-উ-উ! মাহিন মনে মনে ভাবল, এ-ই শেষ। জীবনে আর কখনো সে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেবে না।


আরো সংবাদ



premium cement